X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘শিশুদের শাস্তি দেওয়ার প্রবণতা বাংলাদেশি সংস্কৃতি থেকেই এসেছে’

মাহাদী আল হাসনাত
১১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৭:১৬আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০১৭, ১২:৫২

শারীরিক শাস্তি দেওয়া শিশু অধিকারের লঙ্ঘন

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের শাস্তি দেওয়ার প্রবণতা বাংলাদেশি সংস্কৃতি থেকেই এসেছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা। তবে আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, দেশের ৬৭ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের শৃঙ্খলিত করতে স্কুলে শারীরিক শাস্তি দেওয়াকে সমর্থন করেন। যাদের ৭৯ শতাংশই স্বীকার করেছেন, তারা বাড়িতেও সন্তানদের শারীরিক শাস্তি দিয়ে থাকেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এবং ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘করপোরাল পানিশমেন্ট অন চিলড্রেন ইন স্কুল: প্রেজেন্ট সিনারিও অ্যাণ্ড প্রিভেনটিভ রেসপনসিবিলিটি’ শীর্ষক ওই জরিপে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর এবং গ্রামের ১২৬ জন ব্যক্তি অংশ নেন। সংগঠনগুলো জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষক, শিশু এবং তাদের অভিভাবকদের সাক্ষাৎকার নেন এবং তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, মাত্র একশতাংশ অভিভাবক মনে করেন, কোনও কারণ ছাড়া সন্তানদের মারধর করা তাদের অধিকারের লঙ্ঘন। ৬৯ শতাংশ মনে করেন, ক্লাসরুমে শিশুদের শৃঙ্খলিত করতে শারীরিক শাস্তি খুবই কার্যকর, ৫৫ শতাংশ মনে করেন, শারীরিক শাস্তি শিশুদের যথাযথ উন্নয়নের একটি কার্যকর উপায় এবং ২৭ শতাংশ মনে করেন, শিশুদের শারীরিক শাস্তি না দিলে তারা বিপথে চলে যেতে পারে।

অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য

বাংলাদেশ হচ্ছে ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড (সিআরসি)-এ স্বাক্ষরকারী দেশ।  জাতিসংঘের কমিটি অন চাইল্ড রাইটস প্রতিবেদন-২০১৪ অনুযায়ী, ‘শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার গুরুত্বসহকারে নিয়েছে এবং এটা বন্ধ করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে স্কুলগুলোতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়াসহ বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার। এছাড়া, শাস্তিদানকারীকে আইনের আওতায় আনা এবং বিকল্প পদ্ধতিতে শিশুদের শৃঙ্খলিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।’

‘শিশুদের শাস্তি দেওয়ার প্রবণতা বাংলাদেশি সংস্কৃতি থেকেই এসেছে’ জাতীয় শিশু নীতিমালা-২০১১ অনুযায়ী, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের ওপর সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুবান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে শিশুরা কোনোভাবেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার না হয়।’

শিশু আইন-২০১৩’তেও শিশুদের শারীরিক শাস্তির বিরুদ্ধে আইনি নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আইনের ৭০ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘যদি কেউ নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে শিশুদের ওপর নির্যাতন, দুর্ব্যবহার, অবহেলা অথবা বরখাস্ত করে এবং এসবের কারণে যদি শিশুটির স্বাস্থ্যের কোনও ক্ষতি হয়, তাহলে সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।’

দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষককে উদ্দেশ করে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার দুটি আদেশ জারি করে। আদেশে প্রতিষ্ঠানের যেসব শিক্ষক শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেন, তাদের চিহ্নিত করতে এবং এটা বন্ধ করতে প্রতিষ্ঠানের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

 এ বিষয়ে ব্লাস্ট এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের রিট পিটিশনের শুনানি শেষে ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট জানান, ‘শারীরিক শাস্তি দেওয়া শিশু অধিকারের লঙ্ঘন।’

এ সময় হাইকোর্ট দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব ক্ষেত্রে শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

বাস্তবতা

জরিপে অংশগ্রহণকারী সব শিক্ষক বিশ্বাস করেন, শ্রেণিকক্ষে শিশুদের নিয়ন্ত্রণ করতে শারীরিক শাস্তি দেওয়া সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ।  তাদের মধ্যে ১৩ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন,  ক্লাসে শাস্তি দেওয়ার মতো বিকল্প কোনও কার্যকরী ব্যবস্থা আর নেই। অপরদিকে, শারীরিক শাস্তির বিষয়ে আইনের বিষয়ে ৬৪ শতাংশ অভিভাবক গভীর জ্ঞান রাখেন না।

জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৭৯  শতাংশ অভিভাবক বাসায় তাদের সন্তানদের শাস্তি দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন, ৯০ শতাংশ অভিভাবক জানিয়েছন, সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে শাস্তি দেওয়ার রীতি এখনও বিদ্যমান আছে।

জরিপে অংশ নেওয়া শহরের অর্ধেক অভিভাবক জানিয়েছেন, তাদের সন্তান স্কুলে নিয়মনীতি না মানলে শিক্ষকরা বিষয়টি তাদের অবহিত করেন। এছাড়া, ৫৮ শতাংশ গ্রামের অভিভাবক জানিয়েছেন, স্কুলে তাদের সন্তানরা অবাধ্য হলে শিক্ষকরা তাদের বেত্রাঘাত করে শাস্তি দেন।

‘শিশু আইন-২০১৩’তে শিশুদের শারীরিক শাস্তির বিরুদ্ধে আইনি নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে

শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া আইনে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি জানেন কিনা- প্রশ্নের জবাবে ৫৫ শতাংশ শিক্ষক জানিয়েছেন, তারা বিষয়টি জানেন না বা এ বিষয়ে কোনও নির্দেশনাও তারা পাননি।

সংস্কৃতির মূলেই আছে শারীরিক শাস্তি

স্কুলে শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়াটা বাংলাদেশের সংস্কৃতির মূলেই আছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা জানিয়েছেন, অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব ও অবহেলার কারণে শিশুরা স্কুলে শারীরিক শাস্তির সম্মুখীন হয়।

এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘অভিভাবকরা বিশ্বাস করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের সন্তানদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে দেবে। আর এটার জন্য শারীরিক শাস্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ধারণাটা আমাদের সংস্কৃতি থেকেই এসেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘চার বছর আগের একটি জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৮৬ শতাংশ অভিভাবক স্কুলে শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়ার নিয়মকে সমর্থন করেন। কিন্তু বর্তমানে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। বিভিন্ন উদ্যোগ ও প্রচারণার মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়ার চিত্র কমে এসেছে।’

এই রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন, ‘এখনও দেশের অনেক জায়গায় শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়ার হার অনেক বেশি। ওইসব জায়গায় শারীরিক শাস্তির নেতিবাচক দিক তুলে ধরে অভিভাবকদের সচেতন করতে প্রচারণা চালাতে হবে।’

তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী, শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া খুবই ক্ষতিকর এবং এটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। দেখা গেছে, স্কুলে যেসব শিশুদের শাস্তি দেওয়া হয়, তারা পরীক্ষায় বা শিক্ষা জীবনে অনেক খারাপ ফল করে এবং তাদের কাছে স্কুল একটি ভয়ানক জায়গা।

ব্লাস্ট-আইআইডির এক জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬০ শতাংশ অভিভাবক জানিয়েছেন, শাস্তির ভয়ে তাদের সন্তানরা স্কুলে যেতে চান না এবং এসব অভিভাবকদের ৪৭ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের সন্তানরা স্কুলের শিক্ষকদের ভয় পায়।

‘শিশুদের শাস্তি দেওয়ার প্রবণতা বাংলাদেশি সংস্কৃতি থেকেই এসেছে’ এক চতুর্থাংশ অভিভাবক জানিয়েছেন, স্কুলে শারীরিক শাস্তির কারণে তাদের সন্তানরা হতাশ এবং বিষণ্ন হয়ে ওঠেছে।

যেসব অভিভাবক শারীরিক শাস্তিকে সমর্থন করেন তাদের বিশ্বাস, এ ধরনের শাস্তি তাদের সন্তানদের শিক্ষকদের নির্দেশনা মানতে বাধ্য করে, শৃঙ্খলিত হতে, আচরণ ও শিষ্টাচার শেখাতে সহায়তা করে।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়াটাকে অনেক অভিভাবক ও শিক্ষক ফলপ্রসূ বলে মনে করেন। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এটা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খুবই ক্ষতিকারক।

সেভ দ্য চিলড্রেন, বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক মান্নান বলেন, ‘শারীরিক শাস্তি শিশুদের ওপর শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাবই ফেলে।’

এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেসব শিশুকে শারীরিক শাস্তি দেওয়া হয় তারা প্রায়ই অন্যদের চেয়ে আরও হিংসাত্মক এবং অপরাধমূলক মনোভাব দেখাতে থাকে। যখন তারা এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়, তখন তারাও এ ধরনের শাস্তিকে সমর্থন করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাঝে মাঝে অভিভাবক এবং শিক্ষকদেরও শারীরিক শাস্তির খারাপ প্রভাব সম্পর্কে অসচেতন হতে দেখা যায়। তাই শিশুদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে শাস্তির পরিবর্তে কাউন্সিলিংয়ের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। শারীরিক শাস্তিকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার কোনও যুক্তিই নেই।’

এ সময় বাসা এবং স্কুলে শিশুদের শৃঙ্খলিত করতে বিকল্প উপায় বের করার ওপর জোর দেন ইশতিয়াক মান্নান।

সৌজন্য: ঢাকা ট্রিবিউন

 আরও পড়ুন:
অবশেষে বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণবিধির প্রজ্ঞাপন জারি

/এসএনএইচ/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুজিবনগর দিবস পালনের নির্দেশ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই ধাপে কৃমি নিয়ন্ত্রণ সপ্তাহ পালনের নির্দেশ
টেস্ট পরীক্ষার নামে অতিরিক্ত ফি নিলে ব্যবস্থা
সর্বশেষ খবর
হাজারীবাগে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু
হাজারীবাগে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু
ব্রাজিলিয়ান মিগেলের গোলে কষ্টে জিতলো কিংস
ব্রাজিলিয়ান মিগেলের গোলে কষ্টে জিতলো কিংস
তীব্র গরমে সুপার লিগে দুই দিন করে বিরতি
ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগতীব্র গরমে সুপার লিগে দুই দিন করে বিরতি
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া