X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘মাছ ধরতে গিয়ে শত শত বুদ্ধিজীবীর লাশ দেখে আঁতকে উঠি’

শাহেদ শফিক
১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৬:০৪আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৭:০৯

রবিউল আলম (ছবি: শাহেদ শফিক) ‘একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর সারাদেশে কারফিউ জারি করে হানাদার বাহিনী। কোথাও কাজের সন্ধানে যেতে পারছি না। বাসায় এসে মাকে খাবার দিতে বলি। তার মুখ দেখেই বুঝেছি খাবার নেই। রায়েরবাজার বধ্যভূমি আমাদের বাড়ি থেকে খুবই কাছে, খালের পাড়ে। আমরা সেখানে মাঝে মধ্যে মাছ ধরতে যেতাম। ৮ ডিসেম্বর থেকে পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু করে। তবে দুর্গম পথ হওয়ায় সেখানে সাধারণ মানুষের যাতায়াত তেমন একটা ছিল না। ৮ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে প্রথমে পুলপারের বটগাছের নিচে জড়ো করে চলতো নির্যাতন। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হতো ইটখোলায়’— বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন রবিউল আলম। স্থানীয় এই ব্যবসায়ী সেই বীভৎস ঘটনার সাক্ষী।

সেই সময় রবিউল আলমও রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে হানাদারদের ক্যাম্পে একটি অন্ধকার ঘরে বন্দি ছিলেন। পাকিস্তানি একজন সার্জেন্টের সহযোগিতায় প্রাণে বেঁচে যান এই মানুষটি। এখনও তার মনের কোণে উঁকি দেয় সারি সারি শহীদের লাশ। মাঝে মধ্যে শিউরে ওঠেন তিনি। কারণ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বীভৎস লাশ দেখতে হয়েছিল তাকে। কিছু লাশ তিনি বহনও করেছিলেন কাঁধে।

নিজ চোখে দেখা সেদিনের ঘটনার কথা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন রবিউল আলম। বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার না হওয়া ও বধ্যভূমি সংরক্ষণে সরকারের অনীহার কথা উল্লেখ করে হতাশা ঝরলো তার কণ্ঠে।

মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির কাছে নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে স্বাধীনতাবিরোধীদের সহযোগিতায় গণহত্যার পরিকল্পনা করে হানাদার বাহিনী। এর অংশ হিসেবে জাতিকে মেধাশূন্য করতে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে তারা। ঢাকার রায়েরবাজারের পরিত্যক্ত ইটখোলায় চালানো হয় নৃশংসতা।

রবিউল জানান— ১৯৭১ সালে রায়েরবাজারে চারটি ইটখোলা ছিল। একটির মালিক বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা সাদেক খান। বাকি তিনটির মালিক ছিলেন ইউনুছ খান, মো. হোসেন ও কাদের চৌধুরী। তাদের মধ্যে ইউনুছ খানের ইটখোলা ছিল বর্তমান রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধসহ এর সামনের বিশাল অংশ জুড়ে। আর সাদেক খানের খোলাটি ছিল বর্তমান মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড় হয়ে দক্ষিণ পূর্বদিক জুড়ে। মো. হোসেনের ইটখোলাটি ছিল শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নির্যাতনের সাক্ষী বটগাছ ও শারীরিক শিক্ষা কলেজ প্রাঙ্গণের এলাকা জুড়ে। কাদের চৌধুরীর খোলাটি ছিল আরও অনেক দক্ষিণ পাশে। এই ইটখোলাগুলোর মধ্যে ইউনুছ খান ও মো. হোসেনের ইটখোলায় বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে এসে হত্যা করা হয়েছে।

এরপর ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বরের বর্ণনা দিলেন রবিউল আলম— ‘ওইদিন সকালে মাছ ধরতে যাই। সঙ্গে ছিলেন আমার বড় ভাই মৃত সফিউল্লাহ, হোটেল পূর্বাণীর কর্মচারী সফি ও তার ভাই চাঁন মিয়া। একটু বেশি মাছ পাওয়ার আশায় দলছুট হয়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমির কাছে চলে যাই। ইট পোড়ানো চুলায় উঁকি দিয়ে দেখি শত শত বুদ্ধিজীবীর লাশ পড়ে আছে। ভয়ে আঁতকে উঠি। চিৎকার দিয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করি। ইট বানানোর পটে সবুজ ঘাসের ওপরও বুদ্ধিজীবীদের লাশ পড়ে আছে। সেদিন মাছ ধরতে গিয়ে শত শত বুদ্ধিজীবীর লাশ দেখেছি। মাটির নিচে চাপা দেওয়া কিছু লাশগুলো ফুলে উঠেছিল। লাশের নাড়িবুড়ি বের করে ফেলে কাক-শকুন।’

এই প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, ‘পাশেই ছিল রাজাকার ক্যাম্প। মাছ ধরার দিন তারা চারদিক থেকে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। বুদ্ধি করে আমরা চারজন ইট বানানোর মাটির পাশে শুয়ে পড়ি। রাজাকাররা আমাদের কাছাকাছি এসে বন্দুক তাক করে দুই হাত ওপরে উঠিয়ে রাখতে বলে। আমরা চারজনই হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকি। রায়েরবাজারে গোশতের দোকান থাকায় প্রতিদিন কোনও না কোনও রাজাকার আমার কাছ থেকে গোশত নিতো। তারা আমাকে চিনেছিল। তাই রাজাকাররা আমাদের না মেরে নিচের দিকে তাকিয়ে মাছ ধরার পাতিল দেখে। তখন তারা বুঝতে পারে আমরা মাছ ধরতে এসেছি।’

রবিউল আলম (ছবি: বাংলা ট্রিবিউন) দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রবিউল আলম জানান, এরপর তাদের হাত-পা বেঁধে কাঁটাসুর ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হয়। তার বক্তব্য— ‘সেখানে অনেক বুদ্ধিজীবী তখন অন্ধকার ঘরে বন্দি ছিলেন। কারও চেহারা দেখার উপায় ছিল না। বীভৎস নির্যাতনের কিছু সময় পর আমাদের হাজির করা হলো এক পাকিস্তানি অফিসারের সামনে। সেখানে ছিলেন পাকিস্তানি জমির সার্জেন্ট। এই সার্জেন্ট সেই সময় অনেক বাঙালিকে রক্ষা করেছেন। তিনি আমাদের দেখে ছেড়ে দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখানে একমাত্র অবাঙালি অফিসার জহির সার্জেন্টকে ফুল দিয়ে পুরো এলাকায় ঘোরানো হয়েছে। পরে সরকার জমির সার্জেন্টকে চাকরিতে বহাল রেখেছে।’

বধ্যভূমির এই সাক্ষী আরও বললেন, ‘১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়েছে। এরপর স্বজনরা বুদ্ধিজীবীদের খুঁজতে থাকেন বিভিন্ন স্থানে। ইতিহাসের নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে এসে তারা দেখেন ক্ষত-বিক্ষত শত শত লাশ। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় স্বজনের লাশ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে তাদের জন্য। তখন শনাক্ত করার ক্ষেত্রে স্বজনদের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায় লাশের সঙ্গে থাকা কাপড় কিংবা হাতঘড়ি। সেদিন তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে লাশ খুঁজেছি। অনেক বুদ্ধিজীবীর লাশ খুঁজে পেয়ে নিজের হাতে স্বজনদের কাছে তুলে দিয়েছিলাম। সেই সময় নিজের চোখে ৪০০-৫০০ লাশ দেখেছি।’

রবিউলের কাছা জানা গেলো, তখন ছবি তোলার জন্য কোনও ক্যামেরা মেলেনি তাদের। এখনকার মতো এত ক্যামেরা তখন ছিল না। বর্তমানে রায়েরবাজারের যে ছবিটা পাওয়া যায় তা ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের একজন সাংবাদিকের তোলা। তবে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই অনেকে স্বজনদের লাশ নিয়ে গেছেন। এ কারণে ওই ছবিতে লাশের সংখ্যা খুবই কম।

রায়েরবাজারের যেখানে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে মূলত সেখানে শহীদদের হত্যা করা হয়নি। হানাদারদের নৃশংসতার স্থান ছিল স্মৃতিসৌধের একটু সামনে। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর সেখানে বর্তমান বেড়িবাঁধ দেওয়া হয়। স্বাধীনতার অনেক পরে এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সময় পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা রেখে বর্তমান স্থান চূড়ান্ত হয় বলে জানান রবিউল আলম।

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের ধরে প্রথমে যে বটগাছের নিচে নিয়ে নির্যাতন করা হতো সেটি এখনও সংরক্ষণ না করা আর বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচার না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন রবিউল আলম। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এই মানুষটি দ্রুত খুনিদের বিচার ও বটগাছ সংরক্ষণ করে শহীদের সন্তানদের কাছে উপহার দেওয়ার দাবি জানান।

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
এনার্জি মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের দাবিব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
সর্বাধিক পঠিত
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান