X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

যেমন থাকে নির্বাচনি বছরগুলোর অর্থনীতি

শফিকুল ইসলাম
২৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১০:০৭আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৬:০৯

টাকা রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকায় গত কয়েক বছর ধরেই দেশের অর্থনীতির মোটামুটি স্বাভাবিক। তবে এর আগে ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলোর সময় পর্যালোচনায় দেখা গেছে,  ওই ওই বছরগুলোয় এই চিত্র স্থিতিশীল ছিল না। এ সময় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কর্মসূচি, পাল্টা কর্মসূচি, মারামারি, শো-ডাউন, হরতাল, অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক গতি হারায়। আমদানি-রফতানি বাধাগ্রস্ত হয়। ব্যাংকগুলোয় চলে অস্বাভাবিক লেনদেন। এ কারণে নির্বাচনের সময় সংঘটিত হানাহানি থেকে নিজের সম্পদ মুক্ত রাখতে অনেকেই জমানো অর্থ দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যায়। ফলে রাজস্ব আহরণ থেকে শুরু করে, রিজার্ভ, রেমিটেন্স, রফতানিও কমে যায়। ব্যাংকগুলোয় বাড়তে অলস টাকার পরিমাণ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অনুবিভাগের ‘অর্থনৈতিক সমীক্ষা’ বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় এই চিত্র পাওয়া গেছে।

‘অর্থনৈতিক সমীক্ষা’ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নির্বাচনকালীন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হলেও  নির্বাচন শেষে প্রবৃদ্ধি আবারও সামনের দিকে এগোতে থাকে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কেমন হবে ২০১৮ সালের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সে বিষয়টি নিয়ে এখনই চলছে জল্পনা-কল্পনা। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, ২০১৮ সালে দেশের অর্থনীতি গত কয়েকবছরের গতিতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হতে পারে। যেমন ব্যর্থতার চিত্র দেখা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়।  একই পরিস্থিতি ছিল ২০০৮ সালের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এর আগের ২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ৭ম এবং ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরও প্রায় একই পরিস্থিতি ছিল।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০০৮-তে দেখা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের বছর (২০০৭-০৮ অর্থবছর) দেশের বাণিজ্যঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৯২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৩৯ কোটি ২১০ লাখ টাকা)। অথচ তার আগের ২০০৬-০৭ অর্থবছর দেশের বাণিজ্যঘাটির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (২৩ কোটি ৭৪০ লাখ টাকা)। রাজনৈতিক হানাহানির কারণে দেশের বাণিজ্যঘাটতি বেড়েছে।

একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে ২০০৮-০৯ অর্থবছর রেমিটেন্স এসেছে ৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৯৭০ কোটি টাকা)। ঠিক এর পরের অর্থবছর (২০০৯-১০)  রেমিটেন্স এসেছে ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১ হাজার ১০০ কোটি টাকা)। ২০১৪ সালের নির্বাচনের বছর জুন মাসের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। আর নির্বাচনের পরের বছর ২০১৫ সালের জুন মাসের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছিল ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। 

২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ দশমিক ০৫ শতাংশ। এর পরের বছর ২০০৯ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৫৭ শতংশ। একইভাবে সর্বশেষ অর্থবছর ২০১৪ সালে নির্বাচনের বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছর এ হার বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।

২০১৪ সালে নির্বাচনি বছরের ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ৩৪ বিলিয়ম মার্কিন ডলার। আর এর পরের বছর ২০১৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ২৮ বিলিয়ন মর্কিন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৪ সালে নির্বাচনের বছর স্থানীয় (শতভাগ দেশি), বিদেশি ও যৌথ—এই তিন শ্রেণিতে মোট ১ হাজার ৪৩২টি প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছিল। নিবন্ধিত এসব প্রকল্পের মোট মূলধনের পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার ১৩৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আর এসব প্রকল্পের অধীনে মোট কর্মসংস্থান ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৫৩ হাজার জনের। আর ২০১৫ সালে নিবন্ধিত এসব প্রকল্পের অধীনে মোট মূলধনের পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৮৭ হাজার ৫২৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা। সে হিসাবে ২০১৫ সালে নিবন্ধিত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা বেশি। যা শতকরা হিসাবে ২১ দশমিক ৩২ শতাংশ।

২০১৪ সালে নির্বাচনের বছর কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১৬ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। আর এর পরের বছর ২০১৫ সালে কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

২০১৪ সালে নির্বাচনের বছর প্রথম পাঁচ মাসে ২০ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছিল। আর এর পরের বছর ২০১৫ সালের প্রথম ৫ মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৪ শতাংশ।  অন্যদিকে ২০১৪ সালে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ছিল মোট ঋণের ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। আর ২০১৫ সালের বছর শেষ হওয়ার ২ মাস আগেই অক্টোবর পর্যন্ত এই হার প্রায় দাঁড়িয়েছিল ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গ জানতে চাইলে ড. সালেহ উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘আগামী বছর নির্বাচনের বছর হওয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে প্রয়োজন হবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক অস্থিরতা বা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি না হলে আগামী বছরও (২০১৮) দেশের অর্থনৈতিক অবস্থ ভালো যাবে।’ নির্বাচন কমিশন

এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ) সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ বছরের মতোই আগামী বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ হবে কিনা, তা নির্ভর করছে এ বছরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতার ওপর। আশা করা যাচ্ছে, এ বছরের মতোই আগামী বছরও এর ধারাবাহিকতা থাকবে। তবে ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান হতে পারে। তাই ওই সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে।’ তবে পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে পারলে তা অর্থনৈতিক খাতকে প্রভাবিত করতে পারবে না বলে মনে করেন তিনি।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আশির দশকে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ শতাংশ। বর্তমানে তা ৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এ গতি ধরে রাখকে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকতে হবে। শুধু নির্বাচন নয়, যেকোনও কারণে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনীতির গতি বাধাগ্রস্ত হবে, এটিই স্বাভাবিক। ২০১৮ সালের অর্থনীতির গতি কেমন হবে, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর।’ তিনি বলেন, ‘একটি দেশের উন্নয়নের জন্য প্রথমে দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, যা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। তাই উন্নয়নের পথে সব চেয়ে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে রাজনীতি। এছাড়া বিনিয়োগ থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক পরিবেশ বার বার মুখ থুবড়ে পড়ছে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ পেতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে।’

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিকে আরও অগ্রসর করতে সামনে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে দেশের ব্যবসায়ীরা অনেক পরিকল্পনা করছেন, যা দেশের অর্থনীতিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে। এখন মানুষ আত্মনির্ভরশীল হচ্ছে। সরকারের নীতিগত সহায়তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পেলে দেশ আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে। ২০১৮ সালের অর্থনীতি নির্ভর করছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশ কতটা স্থিতিশীল থাকবে, তার ওপর।’

 

/এমএনএইচ/আপ-এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
‘এমপি হতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এটা তুলবো, এটুকু অন্যায় করবো-ই’
‘এমপি হতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এটা তুলবো, এটুকু অন্যায় করবো-ই’
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
সর্বাধিক পঠিত
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা