মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিগুলোর মাসে অন্তত একটি করে বৈঠক করার কথা। এক্ষেত্রে এক মাত্র নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি নিয়মে চলছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, আইন, রেলপথ এবং মহিলা ও শিশুসহ কয়েকটি কমিটি বৈঠকে বসার ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার কাছিকাছি রয়েছে। বাকি কমিটিগুলোর কোনোটিই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এরমধ্যে কিছু রয়েছে, যাদের লক্ষ্যমাত্রার এক-তৃতীয়াংশ বৈঠকও হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী বছরে ১২টি বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও বিদায়ী বছরে কোনও কোনও কমিটি ৩/৪টির বেশি বৈঠক করতে পারেনি। অন্য কথায় বলা যায়, বৈঠকের বিষয়টি যথাযথ মানছে না সংসদীয় কমিটিগুলো।
দশম জাতীয় সংসদের সংসদীয় কমিটিগুলো গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি দশম সংসদ যাত্রা শুরু করে। তারপর থেকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রথমে ১০টি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়। এরপর মার্চের শেষ সপ্তাহ ও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বাকি কমিটিগুলো গঠন করা হয়।
এদিকে, প্রতিমাসে বৈঠক অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি চার বছরে সর্বোচ্চ ৭৪টি বৈঠক করেছে। অবশ্য আগের বছরের তুলনায় এই কিমিটির প্রথম তিন বছরের বৈঠকের হার বেশি ছিল। প্রথম তিন বছরে তারা ৬৪টি বৈঠক করেছিল।
বৈঠক অনিয়মিত হওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটির সদস্যরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিধি কম থাকা ও মন্ত্রীকে দায়ী করেছেন। তাদের মতে, মন্ত্রী ঠিকমতো সময় না দেওয়ায় নিয়মিত বৈঠক সম্ভব হয়নি।
সংসদের কার্যপ্রণালীর ২৪ বিধি অনুাযায়ী মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির প্রতিমাসে অন্তত একটি বৈঠক করার কথা রয়েছে।
৫০টি সংসদীয় কমিটির মধ্যে মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি হচ্ছে ৩৯টি। আর কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী এই কমিটিগুলোর মাসে কমপক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি রুটিন মেনে চলতে পেরেছে। দেখা যাচ্ছে, ১৫টি কমিটি রয়েছে, যারা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক সংখ্যক বৈঠকও করতে পারেনি। বিধি অনুযায়ী বিদায়ী বছরে ১২টি বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও তিনটির বেশি করতে পারেনি এমন সংসদীয় কমিটিও রয়েছে।
২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিগুলোর কার্যক্রম পর্যলোচনা করে করে দেখা গেছে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ৫০টি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা ৪২টি, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক ৪০টি, মহিলা ও শিশু ৪০টি, রেলপথ ৪০টি, পরিবেশ ও বন ৩৭টি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ৩৯টি, পরিকল্পনা ৩৬টি, ভূমি ৩৪টি, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন ৩৩টি, যুব ও ক্রীড়া ৩৩টি, সমাজকল্যাণ ৩১টি, পানিসম্পদ ৩২টি, প্রতিরক্ষা ২৮টি, ধর্ম ৩১টি, পার্বত্য চট্টগ্রাম ২৯টি, কৃষি ২৭টি, সংস্কৃতি ২৭টি, জনপ্রশাসন ২৬টি, বস্ত্র ও পাট ২৬টি, শিক্ষা ২৫টি, সড়ক পরিবহন ২৫টি, বাণিজ্য ২৪টি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ২৪টি, তথ্য ২৩টি, অর্থ ২২টি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ ২২টি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত ২২টি, খাদ্য ২১টি প্রবাসী কল্যাণ ২১টি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ ২০টি, শিল্প ২০টি, স্থানীয় সরকার ১৯টি, স্বাস্থ্য ১৯টি, মুক্তিযুদ্ধ ১৯টি, স্বরাষ্ট্র ১৮টি, পররাষ্ট্র ১৬টি শ্রম ও কর্মসংস্থান ১৬টি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিয়ষক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ১৬টি বৈঠক করেছে।
এদিকে, মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটিগুলোর বাইরে যে ১১টি কমিটি রয়েছে, সেখানে প্রতিমাসে বৈঠকের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে, প্রত্যেক অধিবেশনের আগে কার্যউপদেষ্টা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। কারণ, ওই বৈঠকে অধিবেশনের সময়সীমাসহ অন্যান্য বিষয়ের সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে। এই কমিটিগুলোর বৈঠক পর্যালোচনা করে দেখা গেছে— সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ৪ বছরে ৭৬টি বৈঠক করেছে। সংখ্যার দিক থেকে অন্যান্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে এই কমিটি। এছাড়া, সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ৩৬টি, কার্যউপদেষ্টা কমিটির ১৯টি, সংসদ কমিটি ১১টি, বেসরকারি সদস্যদের বিল ও সিদ্ধান্ত প্রস্তাব কমিটি চারটি, পিটিশন দুটি, লাইব্রেরি সাতটি, সরকারি হিসাব ৭৪টি, সরকারি প্রতিষ্ঠান ৩১টি, অনুমিত হিসাব ১৭টি ও সরকারি প্রতিশ্রুতি ৩৬টি বৈঠক করেছে।বিশেষ অধিকার ও কার্যপ্রণালীবিধি সম্পর্কিত কমিটির কোনও বৈঠক হয়নি।
সাড়ে তিন মাসের বেশ সময় পার হলেও বৈঠকে বসেনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। সর্বশেষ গত বছরের ৪ অক্টোবর এই কমিটির বৈঠক (১৬তম) হয়েছে। গেল বছরে এই কমিটির মাত্র ৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠক অনুষ্ঠানের সংখ্যার হিসাবে পেছনের দিকে থাকা এই মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আ ফ ম রুহুল হক জানান, তার মন্ত্রণালয়ের পরিধি কম থাকার কারণে বৈঠকও কম হয়েছে। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় রুহুল হক বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয় ছোট তো, এই কারণেই বৈঠকের সংখ্যা কিছুটা কম। তবে আমাদের মন্ত্রণালয়ের অধীনে রূপপুর পারমাণিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। যেটা নিয়ে কমিটি ও মন্ত্রণালয় খুবই তৎপর হয়েছে।’
গত বছর কম বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল দ্রুত কিছু বৈঠক করে হার বৃদ্ধি করা, কিন্তু মাঝখানে মন্ত্রী মহোদয় ব্যস্ত থাকায় সময় দিতে না পারা এবং আমি নিজেও দেশের বাইরে যাওয়ার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত বৈঠকের চেষ্টা করি। তবে, আমাদের মন্ত্রণালয়ের মাত্র একটি দফতর রয়েছে, এজন্য কাজের পরিধি কম। যার কারণে বেশি বৈঠকের প্রয়োজন পড়ে না।
বৈঠকের সংখ্যা কম হলেও বৈঠকের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের হারে সন্তোষ প্রকাশ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি। এ বিষয়ে কমিটির সভাপতি বলেন, ‘আমরা যা সুপারিশ করে থাকি, মন্ত্রণালয় তা গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করে থাকে।’ বাস্তবায়নের হার ৬০ শতাংশের কম হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠানে সক্ষম হওয়া নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কার্যপ্রণালী বিধির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আমরা প্রতিমাসে বৈঠক করার চেষ্টা করেছি। তবে এতেও আমি সন্তুষ্ট নই। আমি মনে করি, আরও বৈঠক করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু মন্ত্রীসহ অন্যরা সময় দিতে না পারার কারণে হয়ে ওঠে না।’
অন্য কমিটিগুলোর বৈঠক পিছিয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে এই আইন প্রণেতা বলেন, ‘অন্যরা কেন পারেননি সেটা তো আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে কার্যপ্রণালী বিধিতে মাসে কমপক্ষে একটি করে বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা আছে। কেউ যদি না করে, তাহলে স্পিকার আদেশ দিয়ে বৈঠক করাতে পারেন।’
বৈঠকের সুপারিশ বাস্তবায়নে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা যেসব সুপারিশ করি, তা বাস্তবায়নের হার ভালোই। সুপারিশ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, তা নিজেই টাইম টু টাইম খোঁজ নিই। তবে মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের বদলি বা অবসরজনিত কারণে সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন কিছুটা পিছিয়ে যায়।’
আরও পড়ুন:
পরিবর্তন আসছে অর্ধশত সংসদীয় আসনে, শিগগিরই সীমানা পুনর্বিন্যাস
