সারা দেশবাসীর অপেক্ষা। তারা যেন ১৭ কোটি মানুষের স্বজন। যেন দেশের প্রতিটি পরিবারেরই সদস্য। তাই সারাদেশের মানুষের দোয়া, আশীর্বাদ ও রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা নিবেদনের পর অনন্তকালের পথযাত্রী হলেন তারা।
সোমবার (১৯ মার্চ) বিকাল ৪টার দিকে নেপালে ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনায় নিহত বাংলাদেশিদের মধ্যে ২৩ জনের মরদেহ নিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ১ নম্বর ভিভিআইপি টারমাকে অবতরণ করে বিমান বাহিনীর কার্গো বিমান। এর আগে সোমবার দুপুর সোয়া ২টায় (স্থানীয় সময় ২টা) নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে লাশবাহী ৬১-২৬৪০ নম্বর কার্গো বিমানটি। তার আগে নিহতদের শনাক্ত করতে নেপাল যাওয়া স্বজনদের নিয়ে ইউএস-বাংলার আরেকটি বিমান ঢাকায় আসে। এরপর আর্মি স্টেডিয়াম জানাজা ও শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মরদেহগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও বিমানমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামাল।
শেষযাত্রায় ফিরেছেন যারা
নিহত ২৬ বাংলাদেশির মধ্যে দেশে ফেরা ২৩ জন হলেন- ফয়সাল আহমেদ, বিলকিস আরা, বেগম হুরুন নাহার বিলকিস বানু, আখতারা বেগম, নাজিয়া আফরিন চৌধুরী, মো. রকিবুল হাসান, সানজিদা হক, মো. হাসান ইমাম, আঁখি মনি, মিনহাজ বিন নাসির, ফারুক হোসেন প্রিয়ক, তামাররা প্রিয়ন্ময়ী, মো. মতিউর রহমান, এস এম মাহমুদুর রহমান, তাহেরা তানভীন শশী রেজা, উম্মে সালামা, অনিরুদ্ধ জামান, মো. নুরুজ্জামান ও মো. রফিকুজ্জামান (রফিক জামান), ফ্লাইটের পাইলট আবিদ সুলতান, কো-পাইলট পৃথুলা রশীদ এবং দুই ক্রু শারমীন আক্তার নাবিলা ও খাজা হুসাইন মো. শফি।
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত ১০ বাংলাদেশির ৬ জনকে ইতোমধ্যে দেশে ফিরিয়ে এনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বাকি চারজন সিঙ্গাপুর, নেপাল ও ভারতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বিমানবন্দর থেকে আর্মি স্টেডিয়াম
বিকাল সাড়ে ৪টার কিছু পর মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সগুলো বিমানবন্দর থেকে আর্মি স্টেডিয়ামে উদ্দেশে রওনা করে। বিকাল পৌনে ৫টায় একে একে কফিনগুলো স্টেডিয়ামের মাঠে এসে পৌঁছায়। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে ২০টি লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে ১৯টিতে করে ২৩টি মরদেহ নেওয়া হয় স্টেডিয়ামে।
সোমবার দুপুর আড়াইটা থেকেই আর্মি স্টেডিয়ামে আসতে শুরু করেছিলেন নেপালে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা। ২৩টি পরিবারের কেউ কাউকে চেনেন না, কিন্তু আজ তারা যেন পরস্পরের কত চেনা। সবাই স্টেডিয়ামের একই সারিতে বসে প্রিয়মুখের জন্য অপেক্ষা করেন। এসময় অনেককেই দেখা গেছে অশ্রুসিক্ত। স্বজনহারা মানুষগুলো একে অন্যকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।
বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় নিহত ২৩ জনের জানাজা। নামাজ পরিচালনা করেন মাওলানা মাহমুদুল হক। এরপর লাশ স্বজনরা গ্রহণ করার পর নিজ নিজ এলাকায় তাদের ফের জানাজা হয়েছে।
নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন
জানাজা শেষে আর্মি স্টেডিয়ামে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষ থেকে নিহতদের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তার সামরিক সচিব এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এরপর ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
মরদেহ হস্তান্তর
মরদেহগুলো জানাজার পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মাইকে একে একে নিহতদের নাম ডেকে স্বজনদের আহ্বান জানানো হয় লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য। পুরো স্টেডিয়ামে তখন শোকের মাতম। কেউ হয়তো কাউকে চেনেন না, কিন্তু পাশে হাতটা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।
কফিন ধরে স্বজনদের কান্না
আর্মি স্টেডিয়ামে লাশ হস্তান্তরের পর স্বজনরা অস্থায়ী মঞ্চে কফিন ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এসময় তারা বিভিন্ন স্মৃতি মনে করে বিলাপ করতে থাকেন। শিশু, নারী, পুরুষ সবাই পরম মমতায় স্বজনের কফিন আঁকড়ে ধরেন। কাল পৌনে ৫টায় যখন একে একে কফিনগুলো এলো স্টেডিয়ামের মাঠে, তখন যেন আর স্বজনদের শোক বাঁধা মানে না। কেউ নিথর অশ্রুসজল চোখে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কেউ অঝোরে কেঁদেছেন, কেউ চিৎকার দিয়ে আর্তনাদ করেছেন।
জানাজার জন্য স্টেডিয়ামের ১ নম্বর গেট বরাবর মাঠে তৈরি একটি স্টেজে মরদেহ রাখা হয়। এসময় স্টেডিয়ামের চারপাশ ঘিরে ছিলেন সেনা সদস্যরা।
সাতদিন পর ‘ঘরে’ ফেরা, তবে…
আর্মি স্টেডিয়ামে লাশ হস্তান্তরের পর আঁখি-মিনহাজ দম্পতির লাশ নিয়ে আসা হয় মহাখালী ডিওএইচএসের বাসায়। লাশ নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় আহাজারি। তাদের দুজনকে শেষবারের মতো দেখতে ছুটে আসেন স্বজনেরা। চোখে পানি নিয়েই সান্ত্বনা দেন নিহতদের পরিবারকে।
রফিক জামান, তার স্ত্রী সানজিদা হক বিপাশা ও পুত্র অনিরুদ্ধ জামানের লাশ মাগরিব নামাজের পর নিয়ে আসা হয় শুক্রাবাদের বাসায়। তখন নিহতের পরিবার, স্বজন ও প্রতিবেশীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। কেবিন ক্রু শারমিন আক্তার নাবিলার বাসায়ও কান্নার রোল পড়ে। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত কয়েকজনের লাশ গাজীপুর, ফরিদপুরে নিয়ে যাওয়ার পর এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।
কার কোথায় দাফন
পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানকে বনানীর সামরিক কবরস্থানে, কো-পাইলট পৃথুলা রশীদকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে, কেবিন ক্রু শারমিন আক্তার নাবিলাকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে, কেবিন ক্রু খাজা হোসাইন মোহাম্মদ শফিকে রাজধানীর বেগমবাজারের পারিবারিক কবরস্থানে, আখতারা বেগমকে রাজশাহী, এসএম মাহমুদুর রহমানকে ফরিদপুর, মতিউর রহমানকে ফেনী, প্রিয়ক ও প্রিয়ন্ময়ীকে গাজীপুরের শ্রীপুর, রফিক জামান, তার স্ত্রী সানজিদা হক ও ছেলে অনিরুদ্ধকে ঢাকায়, ফয়সালকে শরীয়তপুরে, আঁখিমনি ও মিনহাজ দম্পতিকে বনানী, মাহমুদুর রহমানকে ফরিদপুর এবং মো. নুরুজ্জামান বাবুর দাফন মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে।
এখনও তিন মরদেহের জন্য স্বজনদের অপেক্ষা
নিহত ২৬ বাংলাদেশির মধ্যে ২৩ জনের মরদেহ শনাক্ত করে দেশে ফেরত আনা হয়েছে। এখনও আলিফউজ্জামান, পিয়াস রায় ও মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের লাশ শনাক্ত হয়নি। আলিফুজ্জামানের মা-বাবা সিআইডি কার্যালয়ে গিয়ে ডিএনএ টেস্টের জন্য নমুনা দিয়েছেন। এখন মরদেহ পাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছেন তারা।
গত ১২ মার্চ চার ক্রু ও ৬৭ যাত্রীসহ ৭১ জন আরোহী নিয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে নেপালের স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ২০ মিনিটে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে পৌঁছায়। অবতরণের সময় এটি পাশের মাঠে পড়ে বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে যায়। এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৯ জন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিক ২৬ জন।