X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

নামের বানান পরিবর্তনে ক্ষুব্ধ ৫ জেলার বাসিন্দা

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
০৬ এপ্রিল ২০১৮, ২৩:২৫আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০১৮, ০০:০৪

৫ জেলার নতুন ইংরেজি বানান

সরকারের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভায় দেশের পাঁচ জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে কেউ কেউ সাধুবাদ জানালেও অধিকাংশ মানুষই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সাধুবাদদাতাদের ভাষ্য, এটি সরকারের সাহসী সিদ্ধান্ত। ভুল সংশোধন করাটাই তো যৌক্তিক। তবে বিরোধীদের দাবি, সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য কাগজপত্রে জেলার নাম পরিবর্তন করা লাগবে। এতে মানুষের ভোগান্তির শিকার হওয়ার পাশাপাশি সরকারের অর্থের অপচয় হবে। এদিকে, জেলাগুলোর সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, এ সিদ্ধান্তে খুব একটা সমস্যা হবে না।

বাংলা ট্রিবিউনের যশোর প্রতিনিধি তৌহিদ উজ জামান জানান, এ জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তনের ঘোষণায় রীতিমতো বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় বানান পরিবর্তনের বিপক্ষে জনমত তৈরি করতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন ইভেন্ট পেজ খোলা হয়েছে। শহরে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করা হয়েছে।

এ জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগসহ ক্ষমতাসীন জোটের নেতারা। তবে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারাও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

যশোরের একটি অনলাইন নিউজপোর্টালের সম্পাদক আল মামুন শাওন তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘অনেকেই বলছে, জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তনে লাভটা কোথায়? আরে ভাই, বুঝলেন না, এ সিদ্ধান্তের কারণে চার শিক্ষাবোর্ডের সব জেলা এবং দুই বিভাগের সব জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন দফতরের নথিপত্রসহ নানা কিছু পরিবর্তন করতে হবে। আর এ জন্য টেন্ডার হবে, সরকারের শত শত বা হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এতে অনেক মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন হবে। অনেকে নাস্তা-পানির জন্য লাখ লাখ টাকা পাবেন। আরও কত হিসাব ...’

যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হুসাইন শওকত বলেন, ‘জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তন সংক্রান্ত গেজেট চলে এলে আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো। সরকারি সিদ্ধান্ত, বাস্তবায়ন করা হবেই। এ নিয়ে কোনও জটিলতারও কিছু নাই।’

যশোর শিক্ষাবোর্ডের সচিব ড. মোল্লা আমির হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকার ইনিশিয়েটিভ নিলে আমরা সব ঠিক করে দেবো। বানানের পরিবর্তন বড় কোনও সমস্যা নয়। আগের সার্টিফিকেটের বানান কেউ পরিবর্তন করতে চাইলে সেটিও করে দেবো। মূলকথা হচ্ছে, পরিপত্র জারি করা হলে আমরা তা পালন করবো। এক্ষেত্রে অন্য শিক্ষাবোর্ড কী প্রক্রিয়া চালু করে, সেটি দেখে পরবর্তী সময়ে আমরা সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেবো।’

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রিবি) ভিসি প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যশোরের নতুন ইংরেজি বানানটা আমরা গ্রহণ করেছি। নতুন বানানে আমাদের কোনও সমস্যা নেই। ভুল তো ভুলই। এখন শুদ্ধ হলে সেটিই আমরা ব্যবহার করবো। নতুন বানানে হয়তো সাময়িক অসুবিধা হবে, তবে তা খুব বড় কিছু নয়।’

যশোরবাসী সমন্বয় কমিটির নির্বাহী পরিচালক ফারুক জাহাঙ্গীর আলী টিপু বলেন, ‘আমরা মনে করি, শুধু বানান পরিবর্তনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ব্যাপক সময় এবং অর্থের অপচয় হবে। এই শুদ্ধকরণ কাজে রাষ্ট্রের কোনও অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়া উন্নতি দেখছি না। এর ফলে সাধারণ ব্যবসায়ীদের প্রিন্টেড সব কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বিল প্যাড ইন-ভয়েস, রাবার স্ট্যাম্প, বাড়ির ঠিকানা, দোকানের সাইনবোর্ড, গাড়ির নম্বরপ্লেট, ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, ইনকাম ট্যাক্স সার্টিফিকেট, জন্মসনদ, নাগরিক সনদ, পরীক্ষার সার্টিফিকেট, অর্থাৎ জীবনের সাথে সম্পৃক্ত সমস্ত কাগজপত্র পরিবর্তন করতে হবে।’

যশোরের আইনজীবী মোস্তফা হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘ইংরেজি বানানে আমাদের তো কোনও সমস্যা হচ্ছে না। যশোরের এই বানান আমাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে রয়েছে। কোনও অবস্থাতেই এটি পরিবর্তন করা ঠিক হবে না।’

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তরিকুল ইসলাম তারু বলেন, ‘আগের বানানে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল –এমন তো নয়। এই নামের বানান পরিবর্তনে কোটি কোটি টাকার শ্রাদ্ধ হবে। আর বানান পরিবর্তন হলে মানুষের অর্থনৈতিক, মানসিক ও কায়িক শ্রমের ক্ষতি ছাড়া কোনও লাভ দেখি না। সুতরাং যেমন আছে, তেমনই থাক।’

লেখক গবেষক বেনজীন খানের মতে, ‘যাদের কোনও কাজকাম নেই, তারাই এসব ফালতু বিষয় নিয়ে উচ্চকিত। ইতিহাসে নাম লেখানোর অপচেষ্টা। এটি স্রেফ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি।’

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘এই নামের বানান পরিবর্তনে আমাদের কী উপকার হবে! গত ৪৭ বছরে এই বানানে তো কোনও সমস্যা হয়নি। হঠাৎ কেন এই পরিবর্তন, বুঝে আসে না।’

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সভাপতি ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, ‘হঠাৎ কেন এই পরিবর্তনের ইস্যু তৈরি করা হলো তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়।’

অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, ‘দেশে অনেক সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর সমাধান না করে অহেতুক নামের বানান পরিবর্তনের চেষ্টা কেন! যে বানান রয়েছে, তাতে কার কী সমস্যা হচ্ছে, বুঝি না। অহেতুক টাকা-পয়সা খরচ, আর জনভোগান্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’

বাংলা ট্রিবিউনের বগুড়া প্রতিনিধি নাজমুল হুদা নাসিম জানান, এ জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ বলছেন, এতদিন আমরা ভুলের মধ্যে ছিলাম; এখন সঠিক হলাম। আবার কেউ বলছেন, বানান পরিবর্তন করার প্রয়োজন কী? এতে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, জন্ম নিবন্ধনসহ সবকিছু থেকে বানান সংশোধন করতে হবে। এতে শুধু ভোগান্তি নয়; সরকারের বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হবে। তবে নির্বাচন অফিসসহ সরকারি বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, আপাতত কিছু পরিবর্তন হচ্ছে না; পরবর্তী সময়ে সরকার নিজ ব্যয়ে সবকিছুতে বানান সংশোধন করে নেবে।

বগুড়ার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, দিল্লির সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের দ্বিতীয় ছেলে সুলতান নাসির উদ্দিন বগ্রা খান যখন বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন, তখন তার নামানুসারে এ জেলার নামকরণ করা হয়। এ জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তনে ইতিহাস বিকৃতি হবে।

এ প্রসঙ্গে বগুড়া জেলা যুব মহিলালীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক পৌর কাউন্সিলর ডালিয়া নাসরিন রিক্তা বলেন, ‘সরকার আমাদের জেলার ইংরেজি বানান ভুল থেকে সঠিক করেছে। এতে জনগণের বিভ্রান্ত হওয়ার কোনও কারণ নেই।’

জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য আবদুস সালাম বাবু জানান, ‘সরকারের বগুড়ার ইংরেজি বানান পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে কোনও সমস্যা দেখছি না। আগে আমরা ভুলের মধ্যে ছিলাম, এখন সেটা থেকে মুক্ত হলাম।’

বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার জিয়ানগর গ্রামের ব্যবসায়ী আসাদুর রহমান জানান, জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তন করায় জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, শিক্ষাসনদ, জন্ম নিবন্ধনসহ সব কাগজপত্রে পরিবর্তন করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, পারস্পরিক যোগাযোগসহ বৈদেশিক কাজে বিভিন্ন ডেটাবেইসে নাম পরিবর্তন করতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ হবে। পাশাপাশি কাগজপত্র পরিবর্তন করতে জনগণকে হয়রানির শিকার হতে হবে।

ধুনট উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক একেএম তৌহিদুল আলম মামুন জানান, বাংলার শাসক বগ্রা খার নামানুসারে বগুড়া জেলার নামকরণ হয়েছিল। সরকার ইংরেজি বানান পরিবর্তন করায় ইতিহাস বিকৃতি হলো। এ ছাড়া, অফিস-আদালতসহ সর্বত্রই বানান পরিবর্তন করতে হবে। এতে অনেক টাকা ব্যয় হবে।

বগুড়া সরকারি শাহ্ সুলতান কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর এজাজুল হক জানান, বাংলার শাসক নাসির উদ্দিন বগ্রার নাম অনুসারে এ জেলার নামকরণ হয়েছিল। জেলার ইংরেজি বানান পরিবর্তন করার প্রয়োজন ছিল না। এতে একদিকে ইতিহাস বিকৃতি; অন্যদিকে পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, শিক্ষাসনদ, জন্মনিবন্ধনসহ সবকিছুতেই বানান সংশোধ করতে হবে। আর এতে জনগণকে অনেক দূর্ভোগ পোহাতে হবে।

বগুড়া জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা দেওয়ান মো. সারোয়ার জাহান জানান, জেলার ইংরেজি বানান পরিবর্তন করায় আপাতত কোনও সমস্য হবে না। পরবর্তী সময়ে সরকার সফটওয়্যার পরিবর্তন করলে জাতীয় পরিচয়পত্রসহ সর্বক্ষেত্রে বানান পরিবর্তন হবে। এটা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত; তাই জনগণকে কোনও দায় নিতে হবে না।’

বাংলা ট্রিবিউনের বরিশাল প্রতিনিধি আনিুর রহমান স্বপন জানিয়েছেন, এ জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকে, আবার কেউ বলেছেন, দরকার ছিল না। আবার অনেকের মত, এ বানানে অভ্যস্ত, বানানটিকে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে সময় লাগবে।’

গবেষক সাইফুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘বানান পরিবর্তনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের আঞ্চলিক পরিচয় তুলে ধরা সহজ হবে। এক্ষেত্রে লেখক ও মিডিয়াকে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ও বরিশালের ভাষার অভিধান রচয়িতা ড. মুহাম্মদ মুহসিন বলেছেন, উচ্চারণানুগ প্রতিবর্ণীকরণ খারাপ কিছু নয়। তবে বহুদিন ধরে প্রচলিত এ বানান বদলাতে এবং সর্বত্র চালু করতে প্রচুর সময়, অর্থ, শ্রম লাগবে।

বরিশাল নাগরিক পরিষদের সদস্য সচিব মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘এটি খুব জরুরি কোন বিষয় ছিল না। তবে এতে মাতৃভাষার ধ্বনির প্রতি আমাদের ভালবাসার টান ফুটে উঠেছে।’

মহানগর জাতীয় পার্টির (এরশাদ) আহ্বায়ক বিসিসি কাউন্সিলর মর্তুজা আবেদীন বলেন, ‘এ পরিবর্তনের কারণে আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনে যাতে সমস্যা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’

বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোশিয়েশনের বরিশাল আঞ্চলিক রেঞ্জার কাউন্সিলর সভাপতি তানিমা রহমান খান বলেন, ‘এ বানান চালু হলে বিদেশে আমাদের নাম-পরিচয় তুলে ধরতে সুবিধা হবে।’

বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির সহ-সভাপতি বিধান সরকার মনে করেন, ‘এ উদ্যোগ ভালো।’ স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মী অরূপ তালুকদার বলেন, ‘এটা যে খুব বড়ো বা বেশি প্রয়োজনীয় কোনও পরিবর্তন তা নয়। তবে এতে আমাদের ভাষার ধ্বনির উচ্চারণানুগ প্রতিবর্ণীকরণে পরির্তনের হাওয়া লাগবে।’

বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম বলেছেন, ‘এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনও চিঠি পাইনি। পেলে সে অনুযায়ী আন্তঃবোর্ড কমিটির সভা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত রাতারাতি কার্যকর করা যায় না, সময় লাগে। প্রযুক্তিগত সেটআপ বদলাতে হয়। তবে প্রাথমিকভাবে কিছু ঝামেলা হলেও আস্তে আস্তে তা কেটে যাবে।’

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য  প্রফেসর স ম ইমামুল হক বলেন, ‘এখনও আনুষ্ঠানিক কোনও চিঠি না এলেও এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সমন্বয়ের চিন্তাভাবনা চলছে।’

বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ঔপনিবেশিক শাসনের চিহ্ন মুছে দিতে বিদেশি ভাষায় নামের বানান পরিবর্তনের মতো সিদ্ধান্ত সাহসী ও ধন্যবাদযোগ্য।’

বাংলা ট্রিবিউনের কুমিল্লা প্রতিনিধি মাসুদ আলম জানান, এ জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তনে মানুষের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। কেউ কেউ এ সিদ্ধান্তের প্রশংসা করলেও অনেকে সমালোচনা করছেন। সমালোচকদের অভিমত, পরিবর্তন করায় কুমিল্লার উচ্চারণ এখন ‘চিমুল্লা’ হয়ে যাবে।

কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কুমিল্লার ইংরেজি বানান পরিবর্তনে এই এলাকার কোনও অর্থনৈতিক উন্নতি হবে না। এতে বরং মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। আমরা কুমিল্লার নামের বানান পরিবর্তনকে অযৌক্তিক মনে করি।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক, কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, ‘এ পরিবর্তনের কারণ আগে মানুষকে জানাতে হবে। জনগণের মতামত নিয়ে কুমিল্লার ইংরেজি বানান পরিবর্তন করলে কোনও বিতর্ক হতো না।’

কুমিল্লা সিসিএন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ড. আলী হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘এ পরিবর্তনে কুমিল্লার কোনও লাভ হবে না। তবে দেশ-সমাজ পরিবর্তনশীল, পরিবর্তনে কোনও দোষ নেই। প্রয়োজনে পরিবর্তন করা যেতে পারে।’

কুমিল্লার সাংবাদিক মহিউদ্দিন মোল্লা তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘কাজের কাজ করুন, মানুষকে ক্ষেপাবেন না।’

চৌদ্দগ্রাম উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান রাশেদা আক্তার তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘আমরা বিভাগ ও নামের আদ্যাক্ষর লইয়া বড়ই অসহায় অবস্থায় পতিত হইলাম। নিজেদের নামও বদলাইয়া যাইবে কি..?’

কুমিল্লা সিটি কাউন্সিলর কাউসারা বেগম সুমি তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘আমাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেটসহ সব কিছুতেই কুমিল্লাবাসীকে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে।’

জাকির হোসেন তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘নাম পরিবর্তনে কত টাকা ব্যয় বা ক্ষতি হবে? হিসাব কে রাখে।’

নজরুল ইসালাম বাবুল তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘আর কত কিছুর নাম পরিবর্তন আমাদের দেখতে হবে, জানিনা! ভয় হচ্ছে, কখন আবার দেশের নাম পরিবর্তনের কথা কেউ ভেবে বসেন কিনা!’

কামরুল হাসান লিখেছেন, ‘নাম সংশোধন এত জরুরি নয়। কুমিল্লার রাস্তাঘাট মেরামত অতি জরুরি।’ এমন আরও অনেকেই নাম পরিবর্তন নিয়ে নানান কথা লিখেছেন।

এ ব্যাপারে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. রুহুল আমীন ভূঁইয়া বলেন, ‘জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তনে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবকদের হয়রানির সম্মুখীন হতে হবে না।’

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর বলেন, ‘এ জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তনের বিষয়টি শুনেছি। তবে কি ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, গেজেট না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না।’

এদিকে, বাংলা ট্রিবিউনের চট্টগাম প্রতিনিধি হুমায়ুন মাসুদ জানান, এ জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে অনেক মানুষই সাধুবাদ জানিয়েছেন। তবে এর সমালোচনা করছেন অনেকে।

চট্টগ্রাম পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এটি অতো জরুরি হয়ে পড়েনি যে, চিটাগংকে এখনই চট্টগ্রাম-এ পরিবর্তন করতে হবে। কারণ আমরা চিটাগংয়ের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘তবে ধীরে ধীরে বিদেশিরা চট্টগ্রাম নামে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এর জন্য একটু সময় লাগবে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘নাম পরিবর্তনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এ কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ এখানে যেসব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ওইসব প্রতিষ্ঠানে সার্টিফিকেট নিয়ে একটা জটিলতা তৈরি হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হয়ে যাওয়া সবার সার্টিফিকেট পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এতে অনেক টাকা খরচ হবে। নাম পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট এই জটিলতা নিরসনে সরকারের একটি আলাদা নীতিমালা ঘোষণা করা উচিত।’

নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘চিটাগংকে চট্টগ্রাম নামে পরিবর্তন করা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত কোনও সিদ্ধান্ত মনে হয়নি। কারণ, চট্টগ্রাম নাম দেওয়ায় এই অঞ্চলে আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য যোগ হবে না। উল্টো নাম পরিবর্তনের কারণে বিপুল অর্থের অপচয় হবে। অনেক জটিলতা তৈরি হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মহলে চিটাগংয়ের একটা স্বীকৃতি আছে। চট্টগ্রাম শব্দটি ওই স্বীকৃতি অর্জন করতে পারবে কিনা আমি নিশ্চিত নই। এই শব্দে বিদেশিদের অভ্যস্ত করাটাও একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।’

নাম পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি নামের পরিবর্তন মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এটির সঙ্গে আবেগ জড়িয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে ‘গ্রাম’ যুক্ত হোক, আমরা এটি কোনোভাবে মেনে নিতে পারবো না।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোছলেম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘চিটাগং নাম পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম করায় আমরা খুব খুশি হয়েছি। একটা জায়গার দু’টি নাম থাকা উচিত নয়। আর চট্টগ্রামের সঙ্গে আমাদের একটা আবেগ জড়িয়ে আছে। তাই সরকার চিটাগংকে পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম নামকরণ করায় আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।’ তিনি মনে করেন, ‘নাম পরিবর্তনের কারণে খুব বেশি জটিলতার সৃষ্টি হবে না।’

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘নাম পরিবর্তনের বিষয়ে এখনও কোনও অফিসিয়াল আদেশ আমরা পাইনি। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। আদেশ পাওয়ার পর সবকিছু পরিবর্তন করতে হবে। বিশেষ করে সব আইডি কার্ড সংশোধন করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারনাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এর ফলে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনেও অবশ্যই সরকারের ঊর্ধ্বতনরা ব্যবস্থা নেবেন। তাই নাম পরিবর্তন নিয়ে যে জটিলতার আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেটি খুব বেশিদিন থাকবে না।’

চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘আমারা এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত অফিসিয়াল কোনও আদেশ পাইনি। তবে নাম পরিবর্তন হলে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে বন্দর কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। ওইসব আইনগুলো সংশোধন করতে হবে।’ এ ছাড়া, অন্য যেসব কাজ আছে সেগুলো তাড়াতাড়ি সংশোধন করা যাবে।’

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকুল আলম বলেন, ‘যেহেতু সরকার চিটাগংকে চট্টগ্রামে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। সুতরাং আমাদের  অবশ্যই এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা সিন্ডিকেট বৈঠক করে কিভাবে কখন থেকে নাম পরিবর্তন করবো, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো। পরে ওই সিদ্ধান্তের আলোকে এটি বাস্তবায়ন করা হবে।’

 

/এসআই/এমএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী