সিটি করপোরেশনের নির্বাচনি প্রচারণায় সংসদ সদস্যদের (এমপি) অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির এই সিদ্ধান্তকে ভালো চোখে দেখছেন না নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি এ সিদ্ধান্তকে ইসির জন্য আত্মঘাতী আখ্যায়িত করে তারা বলছেন, এমনিতেই স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো ইসির নিয়ন্ত্রণে নেই। এর মধ্যে এমপিরা এসব নির্বাচনে প্রচারণার সুযোগ পেলে ইসির হাতে যেটুকু নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, সেটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে। এ বছরের শেষে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমান কমিশন গত দেড় বছরে সবার কাছে কিছুটা হলেও আস্থা অর্জন করেছে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত সেই আস্থার জায়গাটি নষ্ট করলো। রাজনৈতিক দলকে সুবিধা দিতে গিয়ে কমিশন নিজেরই ক্ষতি করলো।
ইসি বৃহস্পতিবার (২৪ মে) তাদের কমিশন সভায় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচারণার সুযোগ দিতে নির্বাচনি আচরণবিধি সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিইসি কে এম নুরুল হুদার সভাপতিত্বে বৈঠকে পাঁচজন কমিশনারই উপস্থিত ছিলেন। জানা গেছে, কমিশনার মাহবুব তালুকদার এমপিদের প্রচারণার সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ জানান।
এ বিষয়টি অবগত করে বৈঠকের পর কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচন কমিশন অনুসন্ধান করে দেখেছে সংসদ সদস্যরা কোনও লাভজনক পদে নেই। তাদের কার্যালয় নেই, সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন না, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীও নেই। যেহেতু তারা লাভজনক পদে নেই, সেহেতু অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে তাদের চিহ্নিত করা হয়নি। সেহেতু সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হতে সংসদ সদস্য শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। সংসদ সদস্যরা নির্বাচনি প্রচারে অংশ গ্রহণ করতে পারবেন।
আওয়ামী লীগের প্রস্তাব বিবেচনা করে এটা করা হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের স্টেকহোল্ডার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। অনেকভাবে তারা প্রস্তাবনা নিয়ে আসে। ইসির কাছে যেটা মনে হয় যুক্তিযুক্ত, তখন ইসি আলোচনার মাধ্যমে বিবেচনা করে থাকেন।’
কিছু দিন আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল কমিশনে গিয়ে এমপিদের সিটি নির্বাচনে প্রচারণার সুযোগ দেওয়ার দাবি করে।
প্রসঙ্গত, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচনে আগে সংসদ সদস্যদের প্রচারণার সুযোগ ছিল। তবে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিদায়ী কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ কমিশন এমপিদের প্রচারণার বাইরে রাখার বিধান যুক্ত করে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে এই বিধান যুক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গের পাশাপাশি এমপিদের ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ (ভিআইপি) ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করে পৌরসভা নির্বাচনের প্রচারণার বাইরে রেখে বিধিমালা জারি করে কমিশন। পরবর্তীতে সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের বিধিমালায়ও একটি যুক্ত করা হয়।
বিগত রকিব কমিশনের সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বারবার কমিশনে গিয়ে এই বিধান বাতিলের দাবি জানালেও তারা আমলে নেয়নি। কিন্তু খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল কমিশনে গিয়ে নতুন করে এই দাবিটি তোলায় নতুন করে উদ্যোগ শুরু করে কমিশন। পরে কয়েক দফা বৈঠক করে এমপিদের প্রচারণার সুযোগের পক্ষে মত দিয়ে ইসি বৃহস্পতিবার বিষয়টি অনুমোদন দেন।
এমপিদের প্রচারণার সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তটি মোটেও ভালো হয়নি বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাখাওয়াত হোসেন। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘অনেক আলোচনা করে বাস্তবতা বিবেচনা করে এমপিদের প্রচারণার বাইরে রাখা হয়েছিল। কমিশন তাদের প্রচারণার সুযোগ দিয়ে কোনও ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করি না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা এখন বড় সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছে। নির্বাচনটা এমনিতেই ঝামেলার মধ্যে রয়েছে। এই বিষয়টি সেটাকে আরও ঘনীভূত করবে। খুলনায় আমরা দেখেছি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে নেই। এমপিরা প্রচারণায় গেছেন, কমিশনের হাতে যেটুকু নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, সেটাও হাতছাড়া হবে।’
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আগে তো এমপিরা প্রচারণায় অংশ নিতে পারতেন, কিন্তু সেখানে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার কারণেই তো তাদের প্রচারণার সুযোগের বাইরে রাখা হয়। কিন্তু এমন কী ঘটনা ঘটলো যে তাদের আবার সুযোগ দিতে হবে?’
সামনে সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সময়ের এটা বড় গুরুত্ব রয়েছে। বুঝতে হবে সেখানে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচন ইসির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই সময় এসে নির্বাচন কমিশন এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করছে।’
তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান ব্যবস্থায় বেশ কিছু সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন মাঝপথে এসে এটা করা কোনোক্রমেই ঠিক হচ্ছে না। এটা হলে নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন হবে বা ভোট প্রভাবিত হবে, সেটা বলবো না। তবে এক দলের দাবি ও অন্য দলের বিরোধিতার মুখে কমিশন এটা করে নিজেদের ফেইথ লস করলো। আল্টিমেটলি এটা তাদের জন্যই ভালো হয়নি।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘কমিশনের গত কিছুদিনের কার্যক্রমে আমরা ধারণা করেই ছিলাম যে এটা হবেই। তবে এটা একটা দুঃখজনক সিদ্ধান্ত।’
এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বলেন, “কমিশন ‘সমতল ক্ষেত্র’ তৈরির কথা বলে যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে সেটাই ‘সমতল ক্ষেত্র’কে আরও নষ্ট করবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের সংসদ সদস্যরা খুবই প্রতিপত্তি শালী, স্থানীয় পর্যায়ে সবকিছুই তারা নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা নির্বাচনে প্রচারণার সুযোগ পেলে নির্বাচনে ‘সমতল ক্ষেত্র’ বলতে আমরা কিছুটা হলেও যা দেখতে পাচ্ছি, সেটাও অবশিষ্ট থাকবে না। এটা নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে। সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।’
সিদ্ধান্তটি কমিশনের জন্য আত্মঘাতী দাবি করে তিনি বলেন, ‘বিগত কমিশনের তুলনায় বর্তমান কমিশন কিছুটা হলেও মানুষের কাছে আস্থা অর্জন করেছিলো। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা সেটিকে নষ্ট করলো।