X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

অনুপ্রবেশ প্রশ্নে সেদিন যেভাবে জ্যোতি বসুকে সামলেছিলেন শেখ হাসিনা

রঞ্জন বসু, দিল্লি প্রতিনিধি
২৫ মে ২০১৮, ০২:৫০আপডেট : ২৫ মে ২০১৮, ০৩:০৪





জ্যোতি বসু ও শেখ হাসিনা (ছবি- সংগৃহীত) প্রায় দুই দশক আগেকার স্মৃতি ফিরিয়ে এনে শুক্রবার (২৫ মে) আরও একবার রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য শান্তিনিকেতনের পথে রওনা দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বছর ২০ আগে এই শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ই তাকে তাদের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল, আর এবার সেই ক্যাম্পাসেই তিনি উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে নির্মিত বাংলাদেশ ভবনের।


স্বভাবতই ২০ বছর আগের শান্তিনিকেতন সফরের কথা আজ তার অবধারিতভাবে মনে পড়বে। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে সেবারের পশ্চিমবঙ্গ সফরে তিনি বৈঠকে বসেছিলেন রাজ্যের বর্ষীয়ান মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে। এবং কলকাতায় দুজনের মধ্যে সেই বৈঠকে ভারতে কথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা কথা-কাটাকাটি পর্যন্ত হয়েছিল, যে কথা অনেকেরই জানা নেই! কিন্তু সেই কূটনৈতিক বিতর্ক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা যেভাবে সামলেছিলেন, সেটাও ইতিহাস হয়ে আছে।
‘দেখুন, শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতিক জ্যোতি বসুকে যে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন, তাতে কোনও ভুল নেই। ওই ঘটনার বছর দুয়েক আগে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক গঙ্গা চুক্তি সই হওয়ার পেছনে জ্যোতি বসুর ভূমিকার কথাও সবাই জানেন। কিন্তু তার পরেও অনুপ্রবেশের মতো স্পর্শকাতর বিষয়টা কিন্তু তাদের সেই আলোচনাতেও উঠেছিল’, বাংলা ট্রিবিউনকে বৃহস্পতিবার (২৪ মে) বলছিলেন সাবেক কূটনীতিক দেব মুখার্জি, যিনি তখন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার।
আসলে এখন যেমন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় অসীমাংসিত বিষয়ের নাম তিস্তা চুক্তি, তখন তেমনি দুদেশের মধ্যে বিরোধের সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল এই কথিত অনুপ্রবেশ।
দিল্লিতে তখন ক্ষমতায় অটলবিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে বিজেপি জোট সরকার, আর কথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে দিল্লি-মুম্বাইয়ের মতো শহরগুলোতে তারা সরব ছিল বহু বছর ধরেই। কিন্তু অনুপ্রবেশের বিষয়টা ভারতে ধীরে ধীরে এমন রাজনৈতিক মাত্রা নিচ্ছিল যে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী সরকারের পক্ষেও তা উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
সে সময়কার ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন, এমন একজন সাবেক আমলা এই প্রতিবেদককে জানাচ্ছেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে জ্যোতি বসু তাকে সরাসরি বলেন, ‘দেখুন, যেভাবে বাংলাদেশ থেকে রোজ বৈধ কাগজপত্র ছাড়া দলে দলে লোক ভারতে ঢুকছেন, সেটা আমাদের অর্থনীতির জন্য বিরাট বোঝা হয়ে উঠছে। এই অনুপ্রবেশের ধাক্কাটা পশ্চিমবঙ্গকেই বেশি সইতে হচ্ছে, কারণ কেউ কেউ দিল্লি-বোম্বে পাড়ি দিলেও বেশির ভাগই কিন্তু এই রাজ্যেই থেকে যাচ্ছেন।’
এই অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে যে হিন্দু ও মুসলিম— দুই ধর্মের লোকজনই আছেন, সেটাও জ্যোতিবাবু জানাতে ভোলেননি।
সেই সঙ্গেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে বলেন, “মালদহ-মুর্শিদাবাদের মতো সীমান্তবর্তী জেলায় বাংলাদেশ থেকে অনেক লোক রোজ কাজ করতে আসেন, আবার দিনের শেষে কিছু টাকা রোজগার করে ফিরে যান। তাদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ কখনও আপত্তি করেনি, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যারা থেকে যাচ্ছেন তাদের নিয়েই। এই ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ যে ঢাকাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, শেখ হাসিনার কাছে সরাসরি সে দাবিও জানান বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতা।”
সব শুনে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা প্রথমে দু-চার সেকেন্ড চুপ করে ছিলেন। যাকে তিনি এত শ্রদ্ধা করেন ও ভালবাসেন, তার কাছ থেকে সরাসরি এই কূটনৈতিক অক্রমণ বোধহয় তার প্রত্যাশার বাইরে ছিল।
কিন্তু তার পরেই তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘জ্যোতিবাবু, আমি কিন্তু বিশ্বাস করি না একজন বাংলাদেশি নাগরিকও অবৈধভাবে ভারতে বাস করছেন। আর যদি করেনও, সেই অবৈধ লোকজনের তালিকাটা কোথায়? আপনারা মুখে অভিযোগ করলেই তো শুধু হবে না, ভারত সরকার তাহলে আমাকে অবৈধ বাংলাদেশিদের তালিকাটা দিক!’
‘আর তা ছাড়া বাংলাদেশে অবস্থা মোটেই এরকম নয় যে আমাদের লোকজন পাততাড়ি গুটিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আপনাদের দেশে বাস করতে যাবে। আর কেনই বা যাবে?’, কেটে কেটে যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সেই বক্তব্যই কিন্তু আজও অনুপ্রবেশের প্রশ্নে বাংলাদেশের জবাবের ‘টেমপ্লেট’ হয়ে আছে। এমনকী, শেখ হাসিনার প্রথম দফার প্রধানমন্ত্রিত্বের পর বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারও এই একই অবস্থান অনুসরণ করেছে।
আরও যেটা উল্লেখ করা দরকার, সেই ঘটনার প্রায় ২০ বছর কেটে গেলেও আজ পর্যন্ত ভারত কিন্তু সে দেশে বসবাসকারী অবৈধ বাংলাদেশিদের কোনও তালিকা ঢাকার হাতে তুলে দিতে পারেনি।
জ্যোতিবাবুর সঙ্গে ১৯৯৯ সালের ২৮ জানুয়ারি বিকেলের ঘটনাবহুল বৈঠকের পরদিনই শেখ হাসিনা শান্তিনিকেতনে যান ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি গ্রহণ করতে। তখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য ছিলেন বিখ্যাত গণিতজ্ঞ দিলীপকুমার সিনহা। আড়ম্বরপূর্ণ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বিন্দুমাত্র বুঝতে দেননি, ঠিক তার আগের দিনই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তার ছোটখাটো তর্কাতর্কি হয়ে গেছে!
তৎকালীন রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জি সেই সফরের সময় ঢাকা থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। তিনি এদিন এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘আসলে শেখ হাসিনা ও জ্যোতি বসু দুজনের মধ্যেই ছিল স্টেটসম্যানশিপ ছিল, ছিল রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিচক্ষণতাও। ফলে দ্বিপাক্ষিক একটা সমস্যা নিয়ে তারা কথা বলতেও পিছপা হননি, আবার সেটাকে দুজনেই খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অ্যাড্রেসও করেছিলেন।’
কাকতালীয়ভাবে ২০ বছর পরে শেখ হাসিনার এবারকার পশ্চিমবঙ্গ সফরেও রাজ্য সরকারের সঙ্গে তার সংঘাতের একটা ক্ষেত্র আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে আছে, সেটা হলো তিস্তা চুক্তি। শুক্র ও শনিবারের সফরে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকের বা কোনও একান্ত আলোচনার অবকাশ হবে কিনা, সেটা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়।
কিন্তু যদি হয়, তাহলে ২০ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা যেভাবে জ্যোতি বসুর দেওয়া ‘বাউন্সার’ হুক করেছিলেন, এবারেও নির্ঘাত মমতার যেকোনও ‘গুগলি’ তিনি স্ট্রেট ব্যাটে খেলতে কোনও দ্বিধা করবেন না।

 

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
হলমার্কের দুর্নীতির এক মামলার রায় আজ
হলমার্কের দুর্নীতির এক মামলার রায় আজ
সর্বাধিক পঠিত
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
পদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
একীভূত হলো দুই ব্যাংকপদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই