X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের পাওয়া গেলো না জেনেভা ক্যাম্পে

আমানুর রহমান রনি ও রাফসান জানি
২৬ মে ২০১৮, ২১:৫১আপডেট : ২৬ মে ২০১৮, ২৩:৪৫







অভিযানে আটকদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জেনেভা ক্যাম্পে শীর্ষ ও তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের পাওয়া যায়নি। যারা আটক হয়েছে তাদের মধ্যে খুচরা বিক্রেতা, মাদকসেবী এবং কয়েকজন মাঝারি সারির মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। ক্যাম্পে যারা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের কেউ ক্যাম্পে থাকে না বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা। তারা অভিযানের আগেই পালিয়েছে। তবে র‌্যাবের দাবি করেছে, আটক করা ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। ক্যাম্পের বাইরেও যদি কেউ থাকে, সেও রক্ষা পাবে না। 

র‌্যাব জানিয়েছে, অভিযানে আটক ১৫৩ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ৭৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ৭৬ জনের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়েছে। অভিযানে ১৩ হাজার পিস ইয়াবা ও ৩০ কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে।
শনিবার (২৬ মে) সকাল থেকে রাজধানীতে থাকা র‌্যাবের ৫টি ব্যাটালিয়নের সদস্যদের নিয়ে শুরু হয় মাদকবিরোধী অভিযান। এ অভিযানের নেতৃত্বে থাকা র‌্যাবের ব্যাটালিয়ন ২-এর অধিনায়ক আনোয়ার উজ জামান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, অভিযানে আটক ১৫৩ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ৭৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ৭৬ জনের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়েছে। আর উদ্ধার করা হয়েছে ১৩ হাজার পিস ইয়াবা ও ৩০ কেজি গাঁজা।
মোহাম্মদপুরের গণবসতি জেনেভা ক্যাম্পে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে এ অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে র‌্যাবের বোম্ব ডিস্পোজাল ও ডগ স্কয়ার অংশ নেয়। প্রথমে র্যা ব ক্যাম্পটি ঘিরে ফেলে। এরপর ক্যাম্পের ওপরে র্যা ব ড্রোন উড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। ভেতরের অবস্থা বোঝার পর র্যা ব সদস্যদের ৩৬ টিম আলাদা আলাদা ভাগ হয়ে ক্যাম্পে ঢোকার মূল ছয়টি পথ দিয়ে ভেতরে যায়। সন্দেহভাজন সবাইকে আটক করা হয়। ক্যাম্পের বাইরে হুমায়ুন ও বাবর রোড থেকেও আটক করা হয় অনেককে।
পরে আটক করা ব্যক্তিদের সবাইকে আগারগাঁওয়ের র‌্যাব-২-এর সদর দফতরে নিয়ে আসে। সেখানে তাদের বিষয়ে তথ্য যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। এই সদর দফতরের সামনে দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ স্বজনদের খোঁজ করতে ভিড় করেন। অভিযান শেষে র্যা ব সদসস্যরাও সবাই সেখানে আসেন।
র‌্যাব-২-এর সদর দফতরে আটক ব্যক্তিদের স্বজনদের অনেকের সঙ্গে কথা হয় এই দুই প্রতিবেদকের।
সজীব (১৫) নামে এক স্যালুন কর্মী (নাপিত) আটক করা হয়েছে। তার মা শাহনাজ বেগম র‌্যাব-২-এর সদর দফতরের প্রধান ফটকে সন্তানের জন্য অপেক্ষায় আছেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীরা ও ক্যাম্পের নেতারা অনেক আগেই পালিয়েছে। তারা কেউ ক্যাম্পে থাকে না। যাদের ধরে নিয়ে আসছে তাদের বেশিরভাগই নিরাপরাধ মানুষ, কাজ করে খায়। তাদের সবাইকে নিয়ে আসলে কিছুই হবে না। ইয়াবা যারা বেচে তারা কেউ ক্যাম্পে থাকে না।’
মিনা নামে এক কলেজছাত্রীকেও সেখানে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তার মা জাহানারা বেগম ওরফে বেবীকে (৪৫) শনিবার সকাল ৮ টার দিকে র‌্যাব ঘর থেকে আটক করেছে। তার মা গৃহিনী। আটকের সময় মায়ের সঙ্গে মিনাও ঘরে ছিল। মিনাকেও র‌্যাব হ্যান্ডকাফ পড়ানোর চেষ্টা করে, তবে সে অনুরোধ করে ছাড়া পান। কিন্তু মাকে আর ছাড়েনি। তাই বাবা মো. সেলিমকে নিয়ে মাকে ছাড়ানোর আশায় র‌্যাব-২-এর ফটকে ফটকে তারা ঘুরছেন। তবে ফটকে ভিড় করলে র্যা ব সদস্যরা তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে।
মিনা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বাবার জেনেভা ক্যাম্পে দোকান আছে। আমরা ভাইবোনরা সবাই লেখাপড়া করি। যারা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা করে তারা আগেই পালিয়েছে। তারা দুই নম্বর মানুষ। তারা কেউ ক্যাম্পে থাকে না।’
অভিযান শেষে জেনেভা ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে একটা চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। অভিযানের আগে ও পরে অনেকটা পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। নারীরা আটক হওয়া স্বজনদের ভোটার আইডি কার্ড, জন্ম নিবন্ধন, ছবি— এসব নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। কোথায় গেলে ছেলে বা স্বামীকে খুঁজে পাবেন সেই সন্ধান করছেন তারা।
ক্যাম্পের ভেতরের সরু পথে দিয়ে ভেতরে গেলেই দেখা যায়, প্রতিটি খুপড়ি ঘরের সামনে নারী ও শিশুরা বসে আছে। তাদের কেউ কেউ কাঁদছে। সফুরা বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘আমার ছেলে বাবুল (১৫) ক্যাম্পের ভেতরের একটি চায়ের দোকানে কাজ করে। রাতভর দোকানে কাজ শেষে ভোরে বাসায় এসে ঘুমায়। আমি সকালে কাজে বের হয়েছিলাম। পরে খবর পেয়ে এসে শুনি আমার ছেলেকে র‌্যাব ধরে নিছে। আমাদের বাড়ি জামালপুরে। ক্যাম্পে ভাড়া থাকি। আমাদের ছেলে নেশার কাজ করে না। ওরে খালি খালি ধরে নিয়ে গেছে।’
ক্যাম্পের বাজারের কিছু দোকান খোলা থাকলেও অধিকাংশ দোকান বন্ধ। যেগুলো খোলা রয়েছে, সেসব দোকানের মালিকরাও আছেন আতঙ্কে। এসব দোকানের অনেক কর্মচারীও র‌্যাবের হাতে আটক হয়েছে।
লিয়াকত আলী নামের এক দোকান কর্মচারীকে র‌্যাব ধরে নিয়ে গেছে বলে জানান দোকানের মালিক সলিম। তিনি বলেন, ‘আমি দোকানে ছিলাম না। দুজন কর্মচারী ছিল। তাদের একজনকে র্যা ব ধরে নিয়ে গেছে।’
র‌্যাবের এই সাড়াশি অভিযানের পর মাদকের সঙ্গে যারা যুক্ত নন, তারাও আটক আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, ‘আমার স্বামী বাইরে কাজ করে। খবর পেয়ে সে এখন আর ভয়ে ক্যাম্পে আসছে না।’

আরও পড়ুন: 

‘জেনেভা ক্যাম্প থেকে আটক ৩৫০ জন মুক্ত, সাজা হতে পারে ১৫০ জনের’

জেনেভা ক্যাম্পে র‍্যাবের মাদকবিরোধী অভিযান, আটক শতাধিক

তবে র‌্যাব বা পুলিশের অভিযানে মূল মাদক ব্যবসায়ীরা আটক হোক, এটা ক্যাম্পের অনেকেই চান। কিন্তু র‌্যাব ঢালাওভাবে আটকাভিযান চালিয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন। ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. হায়দার বলেন, ‘যারা মাদক ব্যবসা করে তাদের ধরে নিয়ে যাক। নিরীহ মানুষকে কেন ধরছে? তাদের কী দোষ? আমার ভাই মাদকের সঙ্গে যুক্ত না, তাকেও ধরে নিয়ে গেছে। এখন কী হয় আল্লাই জানেন!’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও থানা পুলিশের টানা অভিযানের পর রাজধানীর অন্যতম মাদকস্পট মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্পে অভিযান চালিয়েছে  র‌্যাব। অভিযানে নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন বয়সের অন্তত দুই শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। তবে তালিকাভুক্ত ও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী নেই বলে দাবি করেন বাসিন্দারা। তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের আগেই ক্যাম্প ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছে।
বিহারী ক্যাম্পের বাসিন্দারা মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকেরই নাম বলতে ভয় পান। তাদের ধারণা, মাদক ব্যবসায়ীদের নাম বললে ক্যাম্পে সংঘর্ষ হবে। ক্যাম্পে কেউ থাকতে পারবে না। তাই তারা নিজেদের পরিচয় দিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের বিষয়ে তথ্য দিতে চান না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নারী-পুরুষ ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের নাম বলেছেন। যারা সবাই পলাতক। তাদের মধ্যে রয়েছে ইশতিয়াক, পচিশ ওরফে নাদিম, সাজু, ইমরান, সোহেল, আরমান।
তবে অভিযানে মাছুয়া সাইদ নামে একজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী আটক হয়েছে বলে বিহারী ক্যাম্পের অনেকেই দাবি করেছেন। তবে র‌্যাব থেকে বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সাইদ ক্যাম্পের ইয়াবা ব্যবসার গডফাদারদের মধ্যে অন্যতম। তার রাজধানীতে ফ্ল্যাট আছে, আছে বাড়িও। অভিযানের মধ্যেও কয়েকবার সে গ্রেফতার হলেও অজানা কারণে সে আইনশৃঙ্খরা বাহিনীর কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন ক্যাম্পের বাসিন্দারা।
ক্যাম্প থেকে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার না হলেও যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের অনেকে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছে র‌্যাব-২-এর অধিনায়ক আনোয়ার উজ জামান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা গ্রেফতার হয়েছে এবং মোবাইল কোর্টে শাস্তি হয়েছে, তারা সবাই অপরাধী। বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার আছে। মাদক ব্যবসায়ীদের কাউকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, ‘গডফাদাররা যেখানেই থাকুক, সেখান থেকেই তাদের গ্রেফতার করা হবে। তবে এখনও যারা ক্যাম্পের ভেতরে মাদক ব্যবসা করছিল, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ছিল না, তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’

 

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সোনার দাম ভ‌রিতে কমলো ৩ হাজার টাকা
সোনার দাম ভ‌রিতে কমলো ৩ হাজার টাকা
অস্ত্র লুটের ঘটনায় বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতাসহ আরও ৭ জন কারাগারে
অস্ত্র লুটের ঘটনায় বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতাসহ আরও ৭ জন কারাগারে
তিন গোলে জেতার আশা করেননি পুলিশের রোমানিয়ান কোচ
তিন গোলে জেতার আশা করেননি পুলিশের রোমানিয়ান কোচ
বেনজীরের সম্পদ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানের অগ্রগতি প্রতিবেদন চাইলেন হাইকোর্ট
বেনজীরের সম্পদ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানের অগ্রগতি প্রতিবেদন চাইলেন হাইকোর্ট
সর্বাধিক পঠিত
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ