সংসদ সদস্যদের (এমপি) প্রচারণার সুযোগ রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সিটি নির্বাচনের আচরণবিধিতে সংশোধনী আনার প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ভেটিং এলে সংশোধিত আকারে এর প্রজ্ঞাপন জারি হবে। গত বৃহস্পতিবার (২৪ মে) নির্বাচন কমিশনের সভায় এমপিদের প্রচারণায় অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে নোট অব ডিসেন্ট দেন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। কমিশন সভায় তিনি নোট অব ডিসেন্ট পাঠ করেও শোনান।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের দাবির বিষয়টি তুলে ধরে মাহবুব তালুকদার নোট অব ডিসেন্টে বলেন, বিগত ১২ এপ্রিল আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এক বৈঠকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচারকার্যের বিধি-নিষেধ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবে বলা হয়, সিটি নির্বাচনে নিজ দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে সংসদ সদস্যদের অংশগ্রহণ অবারিত করা আবশ্যক। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচারের সুযোগ দিতে সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালার ২(১৩) সংশোধন করা প্রয়োজন। গত ১৩ মে আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটির সুপারিশে ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তির তালিকা থেকে সংসদ সদস্যদের বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। আমি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের অংশগ্রহণে ভিন্নমত পোষণ করি।
মাহবুব তালুকদার নোট অব ডিসেন্টে আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, সংসদের সদস্যদের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রচারে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হবে। এতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির উদ্যোগ নস্যাৎ হবে। এর আগে কাজী রকিব উদ্দীন কমিশন এমপিদের সিটি নির্বাচনে প্রচারের সুযোগ দিয়ে আচরণবিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে তারা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। বর্তমান সরকারের আমলে ২০১০ সালে সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন আচরণবিধি সংশোধন করেছিল। তার আওতায় সংসদ সদস্যসহ সব সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এই নির্বাচনে প্রচারণার সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্যদের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সংজ্ঞা থেকে বাদ দেওয়া ঠিক হবে না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংসদ সদস্যরা স্থানীয় পর্যায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এমপিদের নামে সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। বিশেষত, নির্বাচনের পূর্বে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম তাদের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। প্রশাসন ও অনেক স্থানীয় প্রতিষ্ঠানই তাদের আদেশ–নির্দেশে চলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের করায়ত্বে বলা যায়। এ দেশে বাস্তবতা হচ্ছে, এমপিরা নিজেদের এলাকায় সর্বেসর্বা। এমতাবস্থায় এমপিদের স্থানীয় নির্বাচনের প্রচারে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলে স্থানীয় প্রশাসনের অফিসার ও পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের নির্দেশ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবেন। সংসদ সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। আমার জানামতে, জাতীয় সংসদ সদস্যদের কোনও দেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হওয়ার জন্য ম্যান্ডেট দেওয়া হয় না।’
এমপিরা সুবিধাভোগী কিনা তার ব্যাখ্যা দিয়ে তালুকদার বলেন, ‘এমপিরা সরকারি সুবিধাভোগী নন বলে যে বক্তব্য রাখা হয়েছে তা নিতান্তই পরিহাসমূলক। তারা সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন না, এ কথা সত্য। কিন্তু তারা এমপি হিসেবে কোটি টাকার গাড়ি ক্রয়ে ট্যাক্স রেয়াত পেয়ে থাকেন। এটা কি সরকারি সুবিধাভোগ নয়? এ ছাড়া, তারা রাজউক, চউক ইত্যাদি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যক্তিগতভাবে যে প্লট বা জমি পেয়ে থাকেন তা কি সরকারি সুবিধাভোগ নয়? এ বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তড়িঘড়ি করে আইন ও বিধিমালা পরিবর্তন করে যেভাবে মাননীয় সংসদ সদস্যদের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা অভিনব। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আমরা সর্বমহলে নিন্দিত হয়ে পড়বো। আজ পর্যন্ত এই সংশোধনের পক্ষে কেউ অভিমত প্রকাশ করেছেন বলে আমার জানা নেই।’
মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আমি মনে করি না যে, সংসদ সদস্যরা নির্বাচনকালে তাদের নিজস্ব এলাকায় না গেলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়বে। বরং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তাদের উপস্থিতিতে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে না। উল্লেখিত অভিমতের আলোকে সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালার ২(১৩) সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের নির্বাচনি প্রচারে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে আমি নোট অব ডিসেন্ট প্রদান করছি।’
