হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দুই নম্বর টার্মিনাল দিয়ে রবিবার (২৭ মে) রাত সাড়ে ৮টার কিছু পরে একসঙ্গে বেরিয়ে আসেন ২০-২৫ জন নারী শ্রমিক। শূন্য হাতে শুধু প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে কিছু কাপড় সঙ্গে নিয়ে দেশে ফিরেছেন তারা। শুধু এই ২০-২৫ জন নয়; একই ফ্লাইটে দেশে ফিরেছেন মোট ৪০ জন নারী শ্রমিক। দেশে ফিরে তারা জানান, তাদের অনেকে সৌদি আরবের রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে, আবার কেউ কেউ সৌদি সরকারের ডিপোর্ট সেন্টারে ছিলেন। সেখান থেকে জীবন হাতে নিয়ে দেশে ফিরেছেন। কেউ কেউ পুরো পারিশ্রমিক পেলেও অনেকেই নিঃস্ব হয়ে ফিরেছেন, ন্যায্য পাওনাটুকুও পাননি। দেশে ফিরে তাদের প্রশ্ন, নারী গৃহকর্মীদের সঙ্গে এমন বর্বরতা কেন?
নীলফামারীর আয়েশা (ছদ্মনাম) বলেন, ‘একবছর তিন মাস আগে সৌদি আরবের রিয়াদে কাজ নিয়া গেসি। পাঁচ মাসের বেতন পাই নাই। উল্টা আমারে মারসে। মাথায় গরম পানি ঢাইলা দিতো। নির্যাতনের মাত্রা ছাড়ায় একদিন আমারে এয়ারপোর্টের কাছে এক লোকের কাছে বেইচ্চা দেয়। আমি পুলিশের হাতে-পায়ে ধইরা রক্ষা পাইসি। পুলিশ আমারে নিয়া সফর জেলে (ডিপোর্ট সেন্টার) দেয়। সেখান থেকে আমারে দেশে পাঠায় দিসে।’
বর্বরতার এমন বর্ণনা দেন শরীয়তপুরের হাজেরা বেগমও। রবিবার রাতে তিনিও ফিরেছেন বাকি ৩৯ জনের সঙ্গে। এয়ারপোর্টে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কাঁদতে কাঁদতে একসময় বলেন, ‘আমারে লাঠি দিয়া মারছে। পায়ের মধ্যে, পিঠে, মারার ক্ষেত্রে শরীরের কোনও জায়গা বাদ রাখে নাই। গরম পানি গায়ে ঢাইলা দিতো। সেখান থেকে দালালরে ফোন দিয়া জানাইসি, কিন্তু সে বলে, তাদের কিচ্ছু করার নাই। পাসপোর্ট কফিলের (মালিক) কাছে। মালিকের বাড়ির থেইক্কা পালায় দূতাবাসের সেফ হোমে গেসি। আউট পাস দিয়া দুতাবাস থেকে দেশে পাঠায় দিসে। কোনও টাকা-পয়সা নাই সঙ্গে। বাড়ি জামু ক্যামনে, জানি না। দূতাবাসে এখনও অনেক মেয়ে আছে। তারা কবে আসবে, কেউ জানে না। তাদের অনেকেই অনেক অত্যাচারের শিকার। কারও কারও হাতে-পায়ে জখম আছে। দূতাবাস থেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, খাওয়ায়। এতো বর্বরতা কেন মেয়েদের সঙ্গে, জানি না।’
আশায় বসতি মানুষের। সুদিনের আশায় পল্টনের হলিটেক ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন ফেনীর দাগনভূঞার বিবি রোজিনা। ১০ বছরের মেয়েকে রেখে তিন মাস আগেই গিয়েছিলেন রিয়াদে, গৃহকর্মীর কাজ করতে। দেশে ফিরে এসে তার প্রশ্ন, ‘আরবরা এতো বর্বর কেন?’ রোজিনা জানান, তার মালিক দিনে এক বাসায় কাজ করায়, আর রাতে আরেক বাসায়। অথচ চুক্তিতে এক বাসায় কাজ করার কথা ছিল। দুই বাসায় কাজ করতে না চাইলে মালিক বলতো, ‘টাকা দিয়ে কিনে আনসি।’
রোজিনা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুই বাসায় কাজে আপত্তি করলে আমারে ধইরে এজেন্সির অফিসে জমা দেয়। কফিল আমারে দুই ঘণ্টা ঘুমাইতে দিতো। বাকি সময় তাদের কাজই করা লাগতো। কথা না শুনলে বলতো, কিনে আনসি, কাজ করতেই হবে।’
প্রবাস কল্যাণ ডেস্ক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ মে ৩৫ জন, ১২ মে ২৭ জন, ১৯ মে ৬৬ জন, ২৩ মে ২১ জন এবং সর্বশেষ ২৭ মে ৪০ জন নারী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের আবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন সময়ে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ৮০ জন নারী শ্রমিককে।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য কর্মকর্তা আল আমিন নয়ন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা নারী শ্রমিকদের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেয়ে প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে আবেদন করি। তাদের অনেককেই বিভিন্ন সময়ে দেশে পাঠানো হয়েছে। সৌদিতে সেফ হোমে আরও অনেকে অপেক্ষায় আছে দেশে ফেরার। ফিরে আসা নির্যাতিত নারী শ্রমিকদের সব রকম সহায়তা আমরা করে থাকি। পরে তাদের কাছ থেকে ডিটেইল শুনে অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রনালয়ে আবেদন করবো।’
উল্লেখ্য, দারিদ্র্য বিমোচন এবং কর্মক্ষেত্র স্বল্পতার কারণে নারীরা বেছে নেন অভিবাসন ব্যবস্থা। নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান সুদূর সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবাননসহ বিশ্বের ১৮টি দেশে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালে অভিবাসী নারীর সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ১৯ হাজার ৯২৫ জন, যা মোট অভিবাসীর সংখ্যার ১৩ শতাংশ। এ সংখ্যা এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
১৯৯১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত একা অভিবাসন প্রত্যাশী নারী শ্রমিককে অভিবাসনে বাধা দেওয়া হলেও ২০০৩ এবং ২০০৬ সালে এ প্রবণতা কিছুটা শিথিল করা হয়। ২০০৪ সালের পর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নারী শ্রমিকের অভিবাসন হার ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় মোট অভিবাসনের ১৯ শতাংশে। কিন্তু এই হার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।