X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘গুজবকে রুখতে পারে ব্যক্তি সচেতনতা’

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
০৯ আগস্ট ২০১৮, ২১:৫৭আপডেট : ১০ আগস্ট ২০১৮, ০৮:৩৭

বাংলা ট্রিবিউন বৈঠকি ‘গুজব মাঝে মাঝে সমাজকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। কখনও কখনও গুজবের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। গুজব কখনও কখনও গণমাধ্যমের ওপরও ভর করে উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করে। এতে সমাজের অনেক ক্ষতি হয়। তাই এই গুজবকে রুখতে হলে ব্যক্তি সচেতনতাই সবচেয়ে বেশি দরকার’
দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের আয়োজনে ‘গুজব’ শীর্ষক বৈঠকিতে এমন মন্তব্য করেছেন বক্তারা। বৃহস্পতিবার (৯ আগস্ট) বিকাল সাড়ে ৪টায় শুরু হয় বাংলা ট্রিবিউন বৈঠকি। রাজধানীর শুক্রাবাদে বাংলা ট্রিবিউন স্টুডিও থেকে এ আয়োজন সরাসরি সম্প্রচার করে এটিএন নিউজ। পাশাপাশি বাংলা ট্রিবিউনের ফেসবুক ও হোমপেজে লাইভ দেখা যায় বাংলা ট্রিবিউন বৈঠকি। মুন্নী সাহার সঞ্চালনায় বৈঠকিতে অংশ নিয়েছেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসি’র সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু, কবি ও সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি, আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং টিমের এডিসি নাজমুল ইসলাম ও বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদক জুলফিকার রাসেল।
জায়েদুল আহসান পিন্টু চ্যানেল ডিবিসি’র সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ‘গুজব এবং ফ্যাক্ট কিন্তু এক জিনিস নয়। আমরা যারা গণমাধ্যমে কাজ করি তারা এর পার্থক্যটা খুব ভালো করে বুঝি। ফ্যাক্ট একটি বস্তুনিষ্ঠ খবর তৈরি করে, কিন্তু গুজব তো কোনও খবর নয়। গুজবের বেশ কিছু টার্গেট থাকে কোনও একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে আগ্রহী করে তোলে, আকৃষ্ট করে।’ তিনি বলেন, এ বছরই ঝাড়খণ্ডে একটি জলজ্যান্ত গুজবের উদারহণ রয়েছে। গুজবটি এমনভাবে ছড়িয়েছে যে, গুজবটি স্থির হতে হতে অনেকেই মারা গেছেন। সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে এ গুজবে মারা গেছেন ১৩ জনের মতো। বাংলাদেশে এমন গুজব ছড়ানোর প্রবণতা বেশি। তিনি আরও বলেন, কিছু আন্তর্জাতিক মিডিয়াও গত কয়েকদিনের আন্দোলনের সময় আগের অন্দোলনের দু’জন মারা যাওয়ার খবর ছাপিয়েছে। এসব ফেক নিউজ যাচাই-বাছাই করা গণমাধ্যমের জন্য খুবই জরুরি। তবে একটি বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য, তা হলো গুজব ছড়ানোর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তো আছেই, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যও আছে।
জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ‘আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এই গুজব আরও বেশি করে ছড়াবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। কারণ আগেই বলেছি- এর পেছনে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। কিছুদিন আগে কয়েকজন গুণী ব্যক্তি বললেন, মূলধারার গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হয় না বলেই গুজব ছড়ায়। বিশ্বাস করলাম, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণমাধ্যম তো স্বাধীন। সেখানে নির্বাচনের সময় ফেক নিউজ কীভাবে প্রকাশিত হলো?’
মাসুদা ভাট্টি কবি ও সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি বলেন,‘একের পর এক নানা রকম গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে কেউ না কেউ। কেউ কেউ আবার এটা শুনে-দেখে মজা পাচ্ছে, বিশ্বাস করছে। আবার এই গুজবের কারণে মূলধারার গণমাধ্যমকেও সমস্যায় পড়তে হয়। ফলে গুজব ও খবরের মধ্যে পার্থক্য বের করা কঠিন হয়ে পড়ে অনেক সময়।’ তিনি বলেন, ‘যেকোনো বিষয় নিয়েই আমরা বেশ উৎসাহী। নায়ক-নায়িকাদের গোপন কথার প্রতিও অনেক আগ্রহ আমাদের সবার। প্রত্যেক মানুষ জীবনে নিরানন্দের সঙ্গে একটু আনন্দ পেতে এগুলো নিয়ে মেতে থাকতে পছন্দ করেন। কিন্তু এটা অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে।
হেফাজতের আন্দোলনের সময় থেকে গুজব তীব্র আকার ধারণ করা শুরু করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর কারণে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডে দেখেছি, এমনকি রোহিঙ্গা ইস্যুতেও। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেকেছে মার্ক জাকারবার্গকে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ডেকেছে, কংগ্রেস ডেকেছে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, মানুষের ক্ষতি হয়েছে, ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট হয়েছে, মানুষ মারা গেছে, রাজনৈতিক ক্ষতি যা হয়েছে তাতে নির্বাচনের আগে মার্ক জাকারবার্গকে হয়তো বাংলাদেশেও ডাকার সুযোগ তৈরি হয়েছে।’
আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, ‘আমরা ইদানীং দেখছি সত্যের চেয়ে গুজবের প্রভাবটা বেশি পড়ছে। সোশ্যাল প্লাটফর্মে আমরা মানুষের ভেতরে একটি জায়গা দখল করি। এই গুজবের উদ্দেশ্য মানুষের মনকে ম্যানুপুলেট (নিজ উদ্দেশ্য হাসিলে পরিচালিত) করা। একটি নির্দিষ্ট টার্গেট থাকে এই গুজবের। গুজব যারা ছড়ায় তারা এর সত্যতা দাবি করে, সমাজের কাছে সাপোর্ট চায়। এই গুজবে কান দিয়ে অনেকেই সেগুলো আরও ছড়িয়ে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রাজধানীর আন্দোলনে চারজন ছাত্রীকে যৌন হয়রানি ও চারজনকে মেরে ফেলা হয়েছে এমন একটি গুজব ছড়িয়ে পড়লো। বিএনপির একজন নেতা প্রেস ব্রিফিংয়েও সেটা দাবি করে বসলেন। একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে প্রেস ব্রিফিংয়ে বললেন ওই রাজনৈতিক দলের নেতা। যখন কোনও একজন পাবলিক ফিগার গুজব ছড়ায় তখন কিন্তু তার বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়ে যায়। গুজব ছড়ানো শুধু অপরাধই নয়, এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ।’
বিপ্লব বড়ুয়া আরও বলেন, ‘শহিদুল আলমের মতো একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার আল জাজিরায় কথা বললেন, তখন তিনি ফটোগ্রাফার হিসেবে পরিচয় দেননি। তিনি পরিচয় দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে। এটা তো তার ঠিক হয়নি। তিনি কি রাজনৈতিক বিশ্লেষক? তাছাড়া তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ের আশেপাশে থেকে রাত পর্যন্ত অন্তত ১০ থেকে ১২ বার ফেসবুক লাইভে এসে কমেন্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, এই কার্যালয়েই আজ নানা নাটকীয় ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ।’
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং টিমের এডিসি নাজমুল ইসলাম পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং টিমের এডিসি নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘সমাজ বিজ্ঞানে সামাজিক সংযুক্তির কথা বলা আছে। আমি সেই জায়গাটি বিশ্বাস করি। সমাজের মধ্যে অনেকগুলো ইন্ডিকেটর থাকে সেগুলোর মিথস্ক্রিয়া হলেই সমাজব্যবস্থা এগিয়ে যায়। সমাজব্যবস্থা সবার ঊর্ধ্বে। আর সেই সমাজে পুলিশ একটি পার্ট হিসেবে কাজ করে। পুলিশ একাই তো সব কিছু করতে পারবে না। ফলে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ ও সঠিকভাবে পরিচালিত করতে সমাজের সকলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা খুবই জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘গুজব যে কেবল এখন হয়েছে তা কিন্তু নয়। নাসিরনগরে সহিংসতাসহ সাম্প্রতিক আন্দোলনেও বেশ কিছু গুজব ছড়িয়েছে। আমরা কিছু সিস্টেম ডেভেলপ করেছি, যার মাধ্যমে ফেসবুকে কোনও স্থান থেকে কে কোন বার্তা পাঠাচ্ছে তা আমরা শনাক্ত করতে পারি। কেউ যদি পোস্ট ডিলিট করেও দেয় তবুও পারি। কারণ সার্ভারে তার কপি থেকে যায়।’
বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদক জুলফিকার রাসেল বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদক জুলফিকার রাসেল বলেছেন, ‘সংবাদপত্রে গুজবকে বিশ্বাস করার কোনও সুযোগ নেই। সংবাদপত্রের কাজ হলো, তথ্য সত্যিকার অর্থে সঠিক কিনা তা যাচাই করে তারপর পরিবেশন করা। কিন্তু কিছু কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড মিডিয়া এই গুজবকে সহজেই লুফে নেয়। কারণ তারা হিট চায়। হিট বাড়লে বেশি বেশি আয় বাড়ে। কিন্তু অনেক সময় আমরা সংবাদকর্মীরা গুজব এবং সঠিক তথ্যের পার্থক্য করতে পারি না। কারণ দুটো জিনিসই অনেক সময় এক রকমই মনে হয়।’
তিনি বলেন, ‘ফেক নিউজ দিয়েও প্যানিক সৃষ্টি করা যায়, আবার গুজব দিয়েও সেটা সম্ভব। কিন্তু ফেক নিউজ যাচাই করা অনেকটাই সহজ কিন্তু গুজব খুব অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই করা কঠিন। দায়িত্বশীল গণমাধ্যম কোনও একটি তথ্য জানার পর সেটার সত্যতা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। নিশ্চিত হলে সেটা তো তখন আর গুজব থাকে না।’
জুলফিকার রাসেল বলেন, ‘সাধারণত শুধু বিরোধী দলই যে গুজব বা ফেক নিউজ ছড়ায় তা কিন্তু নয়, ক্ষমতাসীনরাও করতে পারে। কখনও কখনও ক্ষমতাসীনরা কাউকে গ্রেফতার করে বা কারও বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে বলে- তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ আছে। কিন্তু তথ্য-প্রমাণটা কী সেটা কিন্তু তারা প্রকাশ করে না। তখনই মূলধারার গণমাধ্যমের জন্য বিপদ হয়ে যায়। ফলে আমি মনে করি, গুজব বা ফেক নিউজ সব দিক থেকেই ছড়ায়।’
বৈঠকি’র সঞ্চালক মুন্নী সাহা বৈঠকির শেষপর্যায়ে সঞ্চালক মুন্নী সাহা বলেন, ‘বৈঠকির প্যানেলিস্টদের সবার বক্তব্যের মূল বিষয় হলো ‘গুজব ছড়ানো থেকে রেহাই পেতে ব্যক্তিসচেতনতা সবচেয়ে বেশি দরকার। আপনি, আমি, আমরা সকলেই যদি একটু সচেতন থাকি তাহলে গুজবের মতো সামাজিক বিপর্যয় মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। গুজব অনেক সময় গণমাধ্যমের খবরের ওপর ভর করছে। ব্যক্তিসচেতনতার মাধ্যমে সে জায়গা থেকে বাংলাদেশ অন্তত রেহাই পাবে।’

/আরএআর/ওআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা