X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাস আছে চালক নেই!

শাহেদ শফিক
১২ আগস্ট ২০১৮, ১০:০৮আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০১৮, ০৯:২৭





চালক না থাকায় দাাঁড়িয়ে বাস শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর পরিবহন ব্যবস্থায় শুরু হয়েছে ‘শুদ্ধি’ অভিযান। বিশেষ করে গণপরিবহনে এই অভিযানের প্রভাব বেশি। যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস ও রুট পারমিট সনদ ছাড়া কোনও পরিবহন রাস্তায় নামতে দেওয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি সঠিক লাইসেন্স ছাড়াও কোনও চালককে গাড়ি চালাতে দেওয়া হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের পাশাপাশি পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোও কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তারা টার্মিনালগুলোর টার্নিং পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে কাগজপত্র দেখছেন। এ অবস্থায় সঠিক কাগজপত্রধারী পরিবহন থাকলেও চালক পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে বেকায়দায় রয়েছেন অনেকেই। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন অথরিটির (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে রেজিস্ট্রেশনধারী পরিবহন রয়েছে ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৪৬০টি। এই পরিবহনের মধ্যে শুধু সাড়ে ২২ লাখই হচ্ছে মোটরসাইকেল। এরমধ্যে রাজধানী ঢাকায় রয়েছে ১১ লাখ ৬০ হাজার ৮৩টি যানবাহন। এসব যানবাহনের মধ্যে তিনটি ক্যাটাগরিতে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহনের জন্য রাজধানীতে গণপরিবহন রয়েছে ৬৬ হাজার ২৩৫টি। শুধু রাজধানীতেই রয়েছে ৪৪ হাজার ৭১৪টি। এরমধ্যে বাস ৪৫ হাজার ৩৪৭টি, মিনিবাস ২৮ হাজার ৬৩টি ও হিউম্যান হলার ১৮ হাজার ২৫টি। কিন্তু এ পরিমাণ লাইসেন্সধারী চালক নেই।

আইন অনুযায়ী এ ধরনের গণপরিবহন চালাতে হলে চালকের অবশ্যই পাবলিক সার্ভিস ভেহিক্যাল (পিএসভি) সনদ লাগবে। তবে এর বিপরীতে বিআরটিএ অনুমোদিত পিএসভি লাইসেন্সধারী পরিবহন চালক রয়েছেন মাত্র ১০ হাজার ২৫৬ জন। এ হিসাবে একজন চালক একটি করে বাস চালালেও বাকি ৫৫ হাজার ৯৭৯টি গাড়ি চালানোর উপযোগী চালক নেই। এর বাইরেও একই নম্বরধারী একাধিক পরিবহনসহ অনেক রেজিস্ট্রেশনবিহীন পরিবহন রয়েছে।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতদিন ভারী যানবাহন (বাস/ট্রাক ইত্যাদি) চালানোর সনদ থাকলে একজন চালক গণপরিবহন (বাস) চালাতে পারতেন। এতে তেমন কোনও বাধাও ছিল না। এতদিন পিএসভি সনদের জন্য কাউকে আটক করা হতো না। অনেক চালক বিষয়টি সম্পর্কে ঠিকমতো জানতেনও না। যদিও বিআরটিএ’র বিধিমালায় বিষয়টি ছিল, কিন্তু এর প্রয়োগ তেমন একটা কার্যকর ছিল না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর চালু করা বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহে পিএসভি সনদের বিষয়টি সামনে আসায় মারাত্মক বিপত্তির মধ্যে পড়েছেন বাসচালকরা। ট্রাফিক সার্জেন্ট ও পরিবহন মালিকরা বিষয়টি এখন কড়াকড়িভাবে দেখার কারণে এই সনদের অভাবে বাসের স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখতে পারছেন না অনেক চালক।


গাড়ির কাগজপত্র দেখছে পুলিশ অপরদিকে বেসরকারি হিসাবে সারাদেশে যানবাহন চালকের সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি হলেও চালক রয়েছে কমপক্ষে ৭০ লাখ। এসব চালকের মধ্যে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বিআরটিএ অনুমোদিত সনদ রয়েছে ১৮ লাখ ৬৯ হাজার ৮১৬ জনের। এরমধ্যে পেশাদার চালক ৮ লাখ ৩০ হাজার ৯০ জন। অপেশাদার ১০ লাখ ৩৯ হাজার ৭২৬ জন। কিন্তু সব মিলিয়ে অবশিষ্ট সাড়ে ৫১ লাখ অবৈধ ও অদক্ষ চালকই সড়কে নৈরাজ্যের মূল কারণ।
তবে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গণপরিবহন চালকদের অধিকাংশের সঠিক লাইসেন্স (সনদ) নেই। অনেক চালকের লাইসেন্স ভুয়া। তারা কোনও পরীক্ষা ছাড়াই বিআরটিএ কর্মকর্তা ও দালালদের মাধ্যমে এসব লাইসেন্স তৈরি করেছে। এই ভুয়া লাইসেন্সগুলো কেন্দ্রীয় ডাটাবেজে নেই। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আর আমাদের দাবির মুখে পুলিশ এখন একটু কঠোর হয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার নগরীর বিভিন্ন স্থানে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ট্রাফিক সার্জেন্টরা পিএসভি সনদের জন্য চালকদের আটকে দিয়েছেন। কেউ কেউ মামলাও দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ মামলা না দিলেও চালকদের সতর্ক করেছেন। তাছাড়া বর্তমানে গণপরিবহন চালানো চালকদের অনেকেরই লাইন্স ভুয়া। তবে চালকরা বলছেন, তারা পরীক্ষা না দিয়ে বিআরটিএতে বিভিন্ন দালালদের মাধ্যমে লাইসেন্স সংগ্রহ করছেন। কিন্তু এসব লাইসেন্স বিআরটিএ নির্ধারিত ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত নেই। যে কারণে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা তাদের আটকে দিচ্ছেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের যে পরিমাণ পরিবহন আছে সে পরিমাণ চালক নেই। চালকের অনেক সংকট রয়েছে। আমরা সরকারকে বলেছি আমাদের চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটা ইনস্টিটিউট করে দেওয়ার জন্য। আমরা এও বলেছি, ঢাকায় না হলেও অন্তত ঢাকার আশপাশে যদি আমাদের কিছু জমি দেওয়া হয় তাহলে আমরা নিজ উদ্যোগে হলেও একটা ইনস্টিটিউট স্থাপন করে দক্ষ চালক তৈরি করতে চাই। কিন্তু সেটা হচ্ছে না।’
একই কথা বলেন সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘বৈধ লাইসেন্সধারী চালকের অভাব। গাড়ি বসে আছে। রাস্তায় নামানো যাচ্ছে না।’
ড্রইভারের কাগজপত্র ঠিক আছে কি-না দেখা হচ্ছে জানতে চাইলে বিআরটিএ’র উপ-পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার-১) শেখ মো. মাহবুব-ই রাব্বানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাণিজ্যিকভাবে যদি কোনও পরিবহন যাত্রীবহন করে তবে তাকে অবশ্যই পিএসভি সনদ নিতে হবে। এই সনদ ছাড়া পরিবহন চালানো বেআইনি।’
বৃহস্পতিবার দুপুরে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে অনেক বাসই বসে আছে। অনেক বাসের সঠিক কাগজপত্র থাকলেও চালকের সঠিক লাইসেন্স না থাকায় রাস্তায় বের হতে পারছে না। নাজিম উদ্দিন নামে একজন চালক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৮ হাজার টাকা খরচ করে একটি ভারি গাড়ি চালানোর লাইসেন্স সংগ্রহ করেছি। এজন্য কোনও পরীক্ষা দেই নাই। এখন শুনি এটা নাকি জাল। কাল ট্রাফিক পুলিশ ধরেছে। বলেছে, এই লাইসেন্স ভুয়া। সঠিক লাইসেন্স ছাড়া রাস্তায় না নামতে বলেছে।’
ওই চালক বলেন, শুধু আমি নই, এমন অনেক চালক আছে যারা কোনও পরীক্ষা ছাড়াই লাইসেন্স সংগ্রহ করেছে। এখন দেখি যারা পরীক্ষা না দিয়ে লাইসেন্স নিয়েছে তাদেরগুলো ভুয়া। তাদের লাইসেন্সের ডাটা বিআরটিএতে নেই। সে কারণে পুলিশ ধরে। আমরা রাস্তায় বাস নিয়ে যেতে পারছি না। এখন নতুন করে লাইসেন্স করতে গেলেও শুরু থেকে প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। অনেক দিন সময় লাগবে।
গত ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বাসচাপায় শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম ওরফে রাজীব ও একই কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম ওরফে মিম নিহতের ঘটনায় দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের মুখে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় সরকার। পাশাপাশি পুলিশ, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা সড়কে কড়াকড়ি শুরু করে।
সঠিক লাইসেন্স ছাড়া কোনও পরিবহন রাস্তায় না চলাচল করতে বৃহস্পতিবার (৯ আগস্ট) থেকে টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার পথে অভিযান শুরু করেছে ঢাকাভিত্তিক পরিবহন মালিকদের সংগঠন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন। এ সময় ৫টি পরিবহনের সাংগঠনিক রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়। বিষয়টি মনিটরিং করার জন্য চারটি ভিজেলেন্স কমিটিও গঠন করে মালিক সমিতি। পাশাপাশি সড়কেও ট্রাফিক পুলিশও কঠোরভাবে কাগজপত্র চেক করছে। এ অবস্থায় অনেক পরিবহনের বৈধ কাগজপত্র থাকলেও চালক পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা।

/টিএন/চেক/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা