X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগে পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে গেলে লাভ কার?

সাদ্দিফ অভি
১৭ আগস্ট ২০১৮, ১২:১১আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০১৮, ২১:৪৭

প্রবাসী শ্রমিক মালয়েশিয়া সরকার জনশক্তি আমদানির ক্ষেত্রে পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জিটুটি প্লাস পদ্ধতি থেকে জিটুজি পদ্ধতিতে ফিরে যেতে চায় দেশটি। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ আশ্বাস দিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে যেসব অনুমোদিত এজেন্ট বিদেশে কর্মী পাঠায়, শিগগিরই তাদের সবাইকে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের আবেদনপত্র প্রক্রিয়াকরণের অনুমোদন দেওয়া হবে। এর আগে মাত্র ১০টি এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর অনুমোদন ছিল। মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী মনে করছেন, সবাইকে এই সুযোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ‌এজেন্সিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থা সৃষ্টি হবে, যা কর্মীদের জন্য ইতিবাচক হবে।

সম্প্রতি মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট ভবনে বিদেশি কর্মীদের ব্যবস্থাপনা শীর্ষক এক বৈঠকে মাহাথির মোহাম্মদ জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। মালয়েশিয়াকে জানানো হয়েছে, মাত্র ১০টি এজেন্সি একচেটিয়া কর্মী পাঠানোর সুযোগ পায় বলে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু বাংলাদেশি কর্মীদের জনপ্রতি ২০ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত পর্যন্ত দিতে হয় এজেন্সিগুলোকে। এ কারণেই মালয়েশিয়ার সরকার সব এজেন্ট পর্যন্ত এই সুযোগ বিস্তৃত করতে চায় যেন সেখানে প্রতিযোগিতা থাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানবসম্পদ রফতানির ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার জিটুজি প্লাস পদ্ধতির কারণে নেপাল নড়েচড়ে বসেছে। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি বন্ধ রেখেছে দেশটি। নেপাল সরকার বর্তমান ব্যবস্থায় মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি প্রক্রিয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে। নেপালের লেবার অ্যাটাশে সূত্রে জানা গেছে, সেদেশের সরকার মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানিতে অনেক অনিয়ম খুঁজে পায়। নেপাল সরকারের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু রেখে একচেটিয়া ব্যবসা ধরে রাখতে চাচ্ছে মালয়েশিয়া। যার ফলে নেপাল সরকার মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি বন্ধ ঘোষণা করার পর বেকায়দায় পড়ে যায় মালয়েশিয়া সরকার।

নেপাল থেকে মূলত নিরাপত্তারক্ষীর কাজে প্রচুর লোক নিয়োগ করতো মালয়েশিয়া। জনশিক্ত নেওয়া বন্ধ ঘোষণার পর দুই দফা নেপাল সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেও কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি দুই দেশ। এরপর ৩ আগস্ট মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নেপালের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কেবিনেট মিটিংয়ে আলোচনা করে। যার প্রেক্ষিতে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন সব দেশ থেকে একই পদ্ধতিতে লোক নিয়োগ করা হবে। এই পদ্ধতিতে উন্মুক্ত থাকবে বাজার। শ্রম রফতানিকারক দেশের সরকারিভাবে নিবন্ধিত সব রিক্রুটিং এজেন্সি লোক পাঠানোর সুযোগ পাবে।

এর আগে অভিযোগ উঠে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে পরিচালিত একটি মানবপাচারচক্র মালয়েশিয়ায় শ্রমিকদের কাজ দিয়ে দুই বছরে অন্তত ২০০ কোটি মালয়েশীয় রিঙ্গিত হাতিয়ে নিয়েছে। স্টার অনলাইনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ হাজার ২০০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওই বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগও রয়েছে। প্রতিবেদনের পর জিটুজি প্লাসে দশ সিন্ডিকেট চক্রের কর্মী নিয়োগের চলমান প্রক্রিয়া স্থগিত ঘোষণা করে মালয়েশিয়া সরকার। ওই চক্রের বিষয়ে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই স্থগিতাদেশ বহাল রাখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধের ব্যাপারে মালয়েশিয়া সরকার কিছুই জানায়নি। আর লোক পাঠানোও বন্ধ নেই।

জানা গেছে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিদেশি কর্মীদের বিভিন্ন বিষয় দেখভালের জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করতে চান মাহাথির মোহাম্মদ। যে দেশ থেকেই কর্মী নিয়োগ দেওয়া হোক না কেন, সবাইকে ওই স্বাধীন কমিশনের একক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে চান তিনি। মাহাথির জানান, একজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ওই কমিশনের নেতৃত্বে থাকবেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কর্মীদের নীতি ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখাশোনা করা হবে। শ্রমবাজার সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য ও বিশ্লেষণের প্রতিও নজর রাখা হবে।

মাহাথিরের এই সিদ্ধান্তে ফিলিপাইনসহ কয়েকটি দেশ নড়েচড়ে বসেছে। তাদের প্রশ্ন, যারা কোনও তৃতীয় পক্ষের সহযোগিতা ছাড়া সরাসরি জনশক্তি রফতানি করে তাদের কীভাবে স্বাধীন কমিশনের আওতায় আনা হবে এবং একক ব্যবস্থাপনায় তারা কীভাবে কাজ করবে?

তবে মালয়েশিয়া সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) এবং অভিবাসন খাতের বিশেষজ্ঞরা। তবে তাদের আশঙ্কা রয়েছে নিরাপদ অভিবাসনের নিশ্চয়তা নিয়ে। মালয়েশিয়ায় অভিবাসী কর্মীরা যেন শোষণের শিকার না হয় সেদিকে দেশটির সরকারকে নজরদারি করার আহ্বান জানিয়েছে তারা।

বায়রা’র সাবেক যুগ্ম মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মালয়েশিয়া সরকারের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে চাচ্ছিলাম সবাই মিলে কাজ করার। তারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অত্যন্ত সময় উপযোগী। এটা বাস্তবায়নে আর কোনও বাধা আছে বলে আমি মনে করি না। যেটা করা দরকার তা হলো এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে গেলে কয়েক মাস সময় লাগবে, তবে যত দ্রুত সম্ভব হয়ে যাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। সরকারের সঙ্গে ইতোমধ্যে আমাদের কথা হয়েছে। তারা আশ্বাস দিয়েছে যত দ্রুত করা যায় করা হবে।’

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ১০ এজন্সির সিন্ডিকেট থেকে বেরিয়ে আসা গেলে অভিবাসন খরচ যেমন কমবে তেমনি প্রতিযোগিতামূলক একটি বাজার তৈরি হবে। তবে তারা এও বলছেন, বেশি পরিমাণে শ্রমিক পাঠানোর চেয়ে নিরাপদ অভিবাসনকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং অভিবাসীকর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথমত আমরা মালয়েশিয়া সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কারণ, এতদিন ধরে আমাদের এই চিন্তাটাই কাজ করছিল যে ১০টি এজেন্সিকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেখানে একটি মনোপলি বিজনেস হয়েছে। আমরা সবাই জানি মালয়েশিয়ায় অভিবাসন খরচ কমানোর জন্য সরকার বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েছিল। জিটুজি’র মাধ্যমে অভিবাসন খরচ ৩০ হাজার টাকায় নিয়ে আসার একটা পরিকল্পনা ছিল সরকারের। সেখানে কোনও এক ষড়যন্ত্র হয়েছিল যার কারণে জিটুজি আর থাকে নাই, জিটুজি প্লাস হয়ে গেছে। এখানে রিক্রুটিং এজেন্সির একটা বড় ভূমিকা ছিল। যার ফলে এক ধরনের শোষণের শিকার হতে হয়েছিল বাংলাদেশি শ্রমিকদের। তাদের মালয়েশিয়া যেতে ৫ লাখ টাকা খরচ করতে হতো।’

শাকিরুল আরও বলেন, ‘আমরা এই ব্যাপারে বোধগম্য আছি যে এখানে এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের যেটা করতে হবে তা হলো মালয়েশিয়ায় নিয়োগের ক্ষেত্রে এখনি একটা বড় ধরনের বিপ্লব নিয়ে আসতে হবে। এখানে যেন অভিবাসীকর্মীরা আরও যেন শোষণের শিকার না হয়, অভিবাসন খরচ অতিরিক্ত না দিতে হয়, সেজন্য বাংলাদেশ সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে মালয়েশিয়ান সরকারের যে সৎ উদ্দেশ্য সেটা বাস্তবায়ন হবে না। বাজার উন্মুক্ত হয়ে গেলে উল্লেখযোগ্য হারে কর্মী পাঠানোর চেয়ে নিরাপদ অভিবাসনের দিকে গুরুত্ব দেওয়া বেশি জরুরি বলে আমি মনে করি।’

উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা ১ হাজার ১৮১। ২০১২ সালে দুই দেশ শুধু সরকারি মাধ্যমে জিটুজি পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাতে চুক্তি সই করে। ২০১৬ সালের তা পরিমার্জন করে ১০টি বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিকে জিটুজি প্লাসের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৬ সালের শেষের দিক থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়া গেছেন। এরমধ্যে ২০১৮ সালে জুলাই মাস পর্যন্ত ১ লাখ ৯ হাজার ৫৬২ জন শ্রমিক পাঠায় বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন- 

শ্রমিক নিয়োগে ফের জিটুজি পদ্ধতিতে ফিরতে চায় মালয়েশিয়া

বাংলাদেশের সব রিক্রুটিং এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর সুযোগ দেবে মালয়েশিয়া

/এফএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘খেলাধুলার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিরা দ্রুত নেতৃত্ব দিতে সক্ষম’
‘খেলাধুলার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিরা দ্রুত নেতৃত্ব দিতে সক্ষম’
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ