X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাইনে যাদের নির্দেশে সংঘটিত হয়েছিল জাতিগত নিধনযজ্ঞ

তারেক মাহমুদ
০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৮:১৬আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৮:২১

রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী ১৩ জন মিয়ানমার সেনা ও বিজিপি কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। গত ২৭ জুন ‘মিয়ানমার: উই উইল ডেস্ট্রয় এভরিথিং’ শীর্ষক ১৮৬ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে তারা।  প্রতিবেদনে নিধনযজ্ঞের জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হয়। ১৩ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল।

১ সেপ্টেম্বর রাখাইনের ইন দিন গ্রামে দশ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়

গত বছরের আগস্টে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রাখাইনে পূর্ব পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। ওই অভিযানে জাতিগত নিধনযজ্ঞের আলামত পেয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। সম্প্রতি জাতিসংঘ মিয়ানমারের মানবাধিকার নিয়ে এক তদন্ত প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছে।

২৭ জুন অ্যামনেস্টি জানায়, তারা বিশ্বাসযোগ্য অনেক আলামত পেয়েছেন, যার মাধ্যম প্রমাণিত হয় যে, সেনা কমর্কর্তারা সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিলেন।  সংস্থাটি জানায়, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত তারা ৪০০ জনেরও বেশি ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করে।

মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাং ও ভাইস সিনিয়র জেনারেল সোয়ে উইন

সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাং

অ্যামনেস্টি জানায়,  মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাংয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে বিচারের মুখোমুখি হওয়া উচিত। রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। সংস্থাটি জানায়, ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে ৩৩ ও ৯৯ ব্যাটালিয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তিনি জড়িত ছিলেন।

অ্যামনেস্টির দাবি, মিন অং জানতেন তার সেনারা কী করতে যাচ্ছে। তারপরও তিনি সেটা রোধের কোনও ভূমিকা নেননি। জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাও নেননি।

ভাইস সিনিয়র জেনারেল সো উইন

অ্যামনেস্টির রিপোর্টে বলা হয়, ভাইস সিনিয়র জেনারেল সো উইন দেশটির উপ- সেনাপ্রধান। তার ক্ষমতা ছিল লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের অভিযান থামানোর। সিনিয়র জেনারেল কিছু না করলেও তার এখতিয়ার ছিল ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু তিনিও কোনও ব্যবস্থা নেননি।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল অং কিয়াউ জাউ

ব্যুরো অব স্পেশাল অপারেশন্স (বিএসও) নাম্বার-৩ এর কমান্ডার হিসেবে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল অং কিয়াউ জাউ। এই বাহিনীই মিয়ানমারের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম ও পশ্চিম কমান্ডের সব সামরিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে।  এদের অধীনেই রয়েছে রাখাইন।

মেজর জেনারেল মাউং মাউং সোয়ে

মেজর জেনারেল মাউং মাউং সোয়ের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড ইউনিট ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট মাউং নুতে হত্যাযজ্ঞ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে অংশ নিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

মংডু, বুথিডাউং ও রাথেডাউং শরহতলীজুড়ে এই ইউনিট অমানবিক কৌশল অবলম্বন করেছে। যেমন, প্রথম দিকের সহিংসতার পরও রোহিঙ্গাদের অভুক্ত রেখে সেখান থেকে তাদের পালাতে বাধ্য করা।

সোয়ের নেতৃত্বাধীন অন্তত এক ডজন ব্যাটালিয়ন বর্ণবাদীর মতো ব্যবস্থা কায়েম করেছে, যেখানে ২০১৭ সালের আগে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাস করতো। ২০১৭ সালের নভেম্বরে এই মেজর জেনারেলকে কমান্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং তাকে রিজার্ভ বা অক্সিলারি ফোর্সে পাঠানো হয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খিন মাউং সোয়ে

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খিন মাউং সোয়ের নেতৃত্বাধীন মিলিটারি অপারেশন কমান্ড (এমওসি) ১৫ এর ৫৬৪তম ইউনিট মাউং নু হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৭ সালের শেষ দিকে এবং ২০১৮ সালের শুরুতে বুথিডাউং শহরতলীতে রোহিঙ্গাদের তাদের গ্রাম ও দেশ থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এই এম-১৫ ইউনিট।

মেজর থান্ত জাউ উইন

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, মাউং নু হত্যাযজ্ঞের সময় ৫৬৪তম এলআইবি’র মেজর থান্ত জাউ উন যেখানে বেশিরভাগ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল, সেখানকার উঠানে কথা বলছিলেন ফোনে এবং তাকে হামলা চালানোর নির্দেশ দিতে শোনা গেছে। এরপর তার অধীন সেনারা বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা পুরুষ ও ছেলেকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করে।

স্টাফ সার্জেন্ট বা কিয়াউ

৫৬৪তম এলআইবি’র স্টাফ সার্জেন্ট বা কিয়াউ মাউং নু হত্যাযজ্ঞের প্রধান কুশীলবদের একজন বলে অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ওই এলাকায় বসবাসরত রোহিঙ্গাদের কাছে এই কর্মকর্তা  পরিচিত ছিলেন। তিনি রোহিঙ্গাদের ভাষায় কথা বলতে পারতেন এবং স্থানীয় নেতা ও চিন থা মার গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতেন। হত্যাযজ্ঞ চালাতে তার এই দক্ষতা বড় ভূমিকা পালন করেছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অং অং

২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট রাথেডাউং ও দক্ষিণ মংডুর শহরতলীতে ৩৩তম এলআইডি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অং অং এর নেতৃত্বাধীন ইউনিট হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতা চালায় এবং বেশ কয়েকটি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়।

অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই ইউনিটটি ২০১৬ সালে এবং ২০১৭ সালের শুরুতে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় শান প্রদেশেও একই ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে।

রাখাইনের তমব্রুতে পুড়িয়ে দেওয়া হয় রোহিঙ্গা গ্রাম

মেজর অং মিয়ো থু

অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে অরও বলা হয়েছে, ৩৩তম এলআইডি’র ফিল্ড ইউনিট কমান্ডার মেজর অং মিয়ো থুর অধীন সেনারা বিজিপি ও স্থানীয়দের নিয়ে দুই শতাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ ও কয়েকটি গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থান উ

প্রতিবেদন অনুসারে, ৯৯তম এলআইডি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থান উ এর একটি ইউনিট ৩০ আগস্ট মিন গাইয়ি ও উত্তর মংডুর শহরতলীতে হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতা চালিয়েছে।

ধারণা করা হয়, এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে অধীনস্থদের থামাতে যথাযথ কর্তৃত্ব প্রয়োগ ও যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে এই কর্মকর্তার ব্যর্থতার জন্য।

২০১৮ সালের মে মাসে থানকে অক্সিলারি ফোর্সে বদলি করা হয়।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরা সান লুইন

বিজিপি’র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরা সান লুইন ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের ৩ অক্টোবর বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনিই কাইয়ি কান পাইন এলাকায় ক্লিয়ারেন্স অভিযানের নামে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

বিশ্লেষক ও বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়েছে, ২৫ আগস্ট আরসা’র হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

বিজিপি কর্মকর্তা তুন নায়েং

সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন— বিজিপি’র টাউং বাজার ঘাঁটির কমান্ডিং অফিসার টুন নায়েং গত বছরের ২৫ আগস্ট উত্তর বুথিডাউং শহরতলীর বিভিন্ন গ্রামে মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে নায়েং জানান, রোহিঙ্গাদের গ্রেফতার, জিজ্ঞাসাবাদ ও আটক করার ক্ষেত্রে সরাসরি জড়িত ছিলেন। কিন্তু আটক কাউকে শারীরিক নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেছেন।

বিজিপি কর্পোরাল কিয়াউ চায়

নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়া ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীরা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে জানান, বিজিপি’র কর্পোরাল কিয়াউ চায় গত বছর চুট পাইন ও আশেপাশের গ্রামগুলোতে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিলেন। তারা আরও অভিযোগ করেন, জায় দি পাইনে বিজিপি ফাঁড়িতে আটক ব্যক্তিদের নির্যাতন করেছেন এই কর্পোরাল।

তবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে আলাপকালে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কিয়াউ চায়। বিজিপি’র ফাঁড়ির প্রধান পুলিশ লেফটেন্যান্ট মিয়ো জাউ অয়ো বলেছেন, কর্পোরাল মিথ্যা বলছেন।

সৌজন্যে: ঢাকা ট্রিবিউন

 

 

/এমএইচ/এএ/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যুবককে কুপিয়ে হত্যা
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
সর্বশেষ খবর
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা