X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

সচিবালয়ের দেয়ালে যত পোস্টার

শফিকুল ইসলাম
১৯ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:০৮আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:৪২

সচিবালয়ের দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন পোস্টার সুন্দরবনের নতুন বা পুরনো মধু পেতে চাইলে আপনাকে আসতে হবে সরকারের প্রধান প্রশাসনিক দফতর বাংলাদেশ সচিবালয়ে। সচিবালয়ের মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাছে পাওয়া যাবে এই মধু। একইসঙ্গে সৌদি আরবের আসল খুরমা খেজুরও আছে তার কাছে। প্রয়োজন হলে ফোন দিয়ে এসে আপনি তা নিতে পারবেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য সচিবালয়ের একাধিক ভবনের ঢোকার পথে ও লিফটের গোড়ায় শোভা পাচ্ছে এমন নানা ধরনের পণ্য বা সেবা দেওয়ার বিজ্ঞাপন। এসব বিজ্ঞাপন বা পোস্টার পুরনো হলে বা ছিঁড়ে গেলে আবার লাগানো হচ্ছে।

শুধু মধু বা খেজুর নয়, আপনি রাজধানীর যে কোনও এলাকায় নিষ্কণ্টক জমি কিনতে চাইলেও তার সন্ধান পাবেন সচিবালয়ের বিভিন্ন দেয়ালে। যোগাযোগের জন্য অনেকের নামের সঙ্গে মোবাইল নম্বরও দেওয়া থাকে। আশেকে রাসুল (সা.) সম্মেলনের পোস্টারও লাগানো হচ্ছে সচিবালয়ের ভেতরের বিভিন্ন দেওয়ালে। সচিবালয় বৃহত্তর ময়মনসিংহ কর্মচারী কল্যাণ সমিতির বিভিন্ন সাংগঠনিক নোটিস, ইসলামি জামেয়া গাউছিয়া মোহম্মদিয়া কামেল (এমএ) মাদ্রাসাই সালানা জলসার পোস্টারও সাঁটানো রয়েছে বিভিন্ন দেওয়ালে। একইসঙ্গে অখ্যাত সংবাদপত্র ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের পোস্টারও রয়েছে সচিবালয়ের বিভিন্ন ভবনের লিফট বা সিঁড়ির গোড়ায়।

জানা গেছে, যারা এসব পোস্টার লাগান তাদের বেশির ভাগই সচিবালয়ের কর্মচারী।

সচিবালয়ের দেয়ালে পোস্টার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সচিবালয়ের মসজিদের মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করে মো. আবদুল কাদির। তিনি মূলত গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে অফিস সহকারী পদের কর্মচারী। তবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে মুযাজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

জানতে চাইলে আবদুল কাদির বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, কোনও বেতন-ভাতা বা সুবিধা ছাড়াই মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। খেদমত করছেন আল্লাহর বান্দাদের। স্যারেরা সবই জানেন বলে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন আবদুল কাদির। অনেকে আসল মধু চায়, খুরমা চায়। তাই এগুলো এনে বিক্রি করেন তিনি।

আবদুল কাদির বলেন, ‘বাইরের কেউ ফোন দিলে তাকে সচিবালয়ের গেটে আসতে বলি। সেখানে গিয়ে মধু বা খুনমা সরবরাহ করি। আর সচিবালয়ের ভেতরের কোনও ক্রেতা হলে সরাসরি মসজিদে এসে নিয়ে যান।’

সচিবালয় ঘুরে দেখা গেছে, সচিবালয়ের দেওয়ালে সরকারি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পোস্টারও শোভা পাচ্ছে। যেমন কৃষি মন্ত্রণালয়ের উন্নয়নমূলক পোস্টার বেশি সাঁটানো হয়েছে সচিবালয়ের চার নম্বর ভবনের তিনটি লিফটের গোড়ায়। কারণ, এ ভবনেই কৃষি মন্ত্রণালয়ের দফতর। একইভাবে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উন্নয়নমূলক পোস্টার সাঁটানো হয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয় যে ভবনে অবস্থিত সেই ভবনের প্রবেশ মুখে। একইভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রবেশ পথে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের পোস্টার সাঁটানো রয়েছে।

সচিবালয়ের দেয়ালে পোস্টার প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় বাংলাদেশ সচিবালয়ের দেওয়ালে ছিল ক্ষমতাসীন দলের নিচের সারির বিভিন্ন নেতার পোস্টারও। এসব নেতা মূল দলের কেউ না হলেও দলে নাকি তাদের বেশ প্রভাব। আঞ্চলিক ও সহ-সংগঠনের পাতি গোছের এসব নেতার পোস্টারে ব্যবহার করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারসহ অন্যান্য মন্ত্রীর ছবি।

কখনও কোনও অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার বা বাণিজ্যমন্ত্রীর হাতে ফুল দিয়েছিলেন বা হাত মিলিয়েছেন, সেই মুহূর্তের ছবি বড় করে লেমিনেটিং করে লাগানো হয়েছিল সচিবালয়ের দেওয়ালে।

ভবনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত বিভাগের সংশ্লিষ্টরা এগুলো সরানোরও সাহস পাচ্ছিলেন না। তবে এ বছরের মাঝামাঝি থেকে সচিবালয়ের ভবনগুলোর দেওয়াল সংস্কার ও নতুন করে রং করায় এসব সরিয়ে ফেলা হয়েছে। 

সচিবালয়ের গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সচিবালয়ের দেয়ালে পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার, ফেস্টুন লাগানোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এসব নেতার পোস্টার শোভা পাচ্ছে প্রায় সব ভবনগুলোর মূল ফটকে এবং লিফটের গোড়ায়। সরকারের প্রভাবশালীদের কাছাকাছি থাকার কারণেই এমনটা হচ্ছে।

সাচবালয়ের দেয়ালে পোস্টার ‘দেওয়াললিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২’ আনুযায়ী, বাসস্থান, অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাকেন্দ্র, শিল্প-কারখানা, দোকান বা অন্য কোনও স্থাপনার (কাঁচা বা পাকা যা-ই হোক) বাইরে ও ভেতরের দেওয়াল বা সীমানা নির্ধারণকারী দেওয়াল বা বেড়ায় এবং গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, খাম্বা, সড়কদ্বীপ, সড়ক বিভাজক, ব্রিজ, কালভার্ট, সড়কের উপরিভাগ ও বাড়ির ছাদেও পোস্টার লাগানো যাবে না।

আইনে বলা হয়, কেউ পোস্টার লাগালে সংশ্লিষ্টদের তুলে ফেলতে হবে। পোস্টার মুছতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেবে। এক্ষেত্রে ব্যয়ের অর্থ সুবিধাভোগীর কাছ থেকে নগদ আদায় করার বিধান রয়েছে। নগদ দিতে না পারলে ‘পাবলিক ডিম্যান্ডস রিকভারি অ্যাক্ট, ১৯১৩’ অনুযায়ী সরকারি দাবি হিসাবে আদায় করা যাবে।

কোনও ব্যক্তি আইন লঙ্ঘন করলে অন্যূন পাঁচ হাজার টাকা এবং অনুর্ধ্ব ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড হবে। অনাদায়ে ১৫ দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ওই ব্যক্তিকে নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেওয়াললিখন বা পোস্টার মুছে ফেলার আদেশ দেওয়া যাবে বলে আইনে বলা আছে।

আর কোনও সুবিধাভোগীর অধীনে পোস্টার লাগালে সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে অন্যূন ১০ হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা যাবে। অনাদায়ে ৩০ দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ওই ব্যক্তিকে নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেয়াল লিখন বা পোস্টার মুছে ফেলার আদেশ দেওয়া যাবে। এর বিচার হবে মোবাইল কোর্ট আইনে। দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানোর জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ প্রশাসনিক আদেশে স্থান নির্ধারণ করে দেবে বলেও আইনে বলা আছে।

সচিবালয়ে পোস্টার লাগানোর জন্য নির্ধারিত কয়েকটি জায়গা থাকলেও সেখানে পোস্টার খুব কমই চোখে পড়ে। পুলিশ ও সচিবালয়ের ইডেন গণপূর্ত বিভাগ পোস্টার সাঁটানোর নির্দেশনা দিয়ে আসছে। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয় না। সচিবালয় ইডেন গণপূর্ত বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কেপিআই স্থাপনায় পোস্টার সাঁটানো অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ।’

সরকারি পোস্টারের বিষয়ে মন্তব্য না করলেও ব্যক্তিগত পোস্টারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পোস্টার তুলে ফেলা হলেও আবার সাঁটানো হয়। এ বিষয়ে সবার সচেতনতা প্রয়োজন।’ ছুটির দিন প্রতি শুক্র ও শনিবার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানো হয় বলে দাবি করেন ওই কর্মকর্তা।

সচিবালয়ের দেয়ালে পোস্টার একটি সূত্র জানায়, মন্ত্রীরা যে সব ভবনে অফিস করেন বা যে লিফট ব্যবহার করেন সেসব ভবনের প্রধান ফটক ও লিফটের গোড়ায় বেশি বেশি পোস্টার সাঁটানো হয়। সচিবালয়ের গণপূর্ত বিভাগের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই লাগানো হচ্ছে এসব পোস্টার।

পোস্টার তুলতে গেলে বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের একাধিক কর্মচারী। চাকরির ভয়ে নাম প্রকাশেও আপত্তি জানান তারা।

গণপূর্ত বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সচিবালয়ে তো বটেই, বিধি মোতাবেক সরকারি যে কোনও স্থাপনায় পোস্টার লাগানোয় নিষেধাজ্ঞা আছে। বিভিন্ন স্থাপনা পরিচ্ছন্ন রাখাও তাদের দায়িত্ব। তারা সতর্কতামূলক নোটিশও লাগিয়েছেন।  কিন্তু কোনোটাই কাজে আসছে না। যে যার মতো করে লাগাচ্ছে।

জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘বিষয়টি খুবই বিব্রতকর। সচিবালয়ের দেয়ালে পোস্টার লাগানোর স্থান নয়।’

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহম্মদ শফিউল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, সরকারি স্থাপনায় বিশেষ করে সচিবালয়ের দেয়ালে যে কোনও ধরনের পোস্টার লাগানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। 

/এইচআই/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘হোম অব ক্রিকেটে’ বাংলাদেশের স্পিন কোচ মুশতাক
‘হোম অব ক্রিকেটে’ বাংলাদেশের স্পিন কোচ মুশতাক
গরমে রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
গরমে রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
মাটি কাটার সময় বেরিয়ে এলো রাইফেল, গ্রেনেড ও মর্টারশেল
মাটি কাটার সময় বেরিয়ে এলো রাইফেল, গ্রেনেড ও মর্টারশেল
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
সর্বাধিক পঠিত
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ