X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাণিজ্য মেলার নামে দুর্ভোগ শেষ হবে কবে?

শফিকুল ইসলাম ও উদিসা ইসলাম
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৩০আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৯:১৭





ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ২০১৯ (ছবি: ফোকাসবাংলা) অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, নৈরাজ্য এবং রাজপথে সীমাহীন দুর্ভোগ সৃষ্টির অভিযোগের মধ্যদিয়ে এবছরের মতো শেষ হতে চলেছে মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। গত ৯ জানুয়ারি মাসব্যাপী মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন রাষ্ট্রপতি  মো. আবদুল হামিদ। হিসাব অনুযায়ী ৮ ফেব্রুয়ারি   শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের অনুরোধে একদিন সময় বাড়িয়ে আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) মেলা শেষ হবে। আর  এর মধ্য দিয়ে আপাতত শেষ হচ্ছে  মীরপুর, পল্লবী, কাফরুলসহ রাজধানীর উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী লাখ- লাখ মানুষের দুর্ভোগ। তবে ১১ মাস পর   আগামী বছরের ১ জানুয়ারি আবারও ওই এলাকার মানুষের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে আসবে বাণিজ্য মেলা। তাই ওই  এলাকার  মানুষের প্রশ্ন,  বাণিজ্য মেলার নামে এ দুর্ভোগ শেষ হবে কবে? 


বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন মিরপুরের বাসিন্দা রিফাত হাসান। অফিস মতিঝিলে। প্রতিদিন ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাতে তাকে অন্তত তিন ঘণ্টা আগে বের হতে হয় বাসা থেকে। তিনি বলেন,  ‘আগে মিরপুর ১০ নম্বর পার হতে সময় লাগতো আধাঘণ্টা। সেটা পার হলেই বিজয়সরণির সিগন্যালে আরও আধাঘণ্টা কাটিয়ে মোটামোটি দেড় ঘণ্টায় মতিঝিলে পৌঁছাতে পারতাম। মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে দেড় ঘণ্টা তিনঘণ্টায় পরিণত হয়েছে। পুরো রাস্তায় দুই সারির বেশি গাড়ি চলতে না পারা এবং বাসগুলো এলোমেলোভাবে চলার কারণে এই দেরি হয়।’ অফিসে যেতে আর বাসায় ফিরতে যদি দিনের ছয় ঘণ্টা পার হয়ে যায়, তাহলে বাকি কতটুকু সময় হাতে থাকে বলে প্রশ্ন রাখেন ভুক্তভোগী রিফাত হাসান।

শ্যাওড়া পাড়া নিবাসী রাশিদা খানমের অফিস রাজধানীর কাওরানবাজারে। মেট্রোরেলের পাশাপাশি বাণিজ্য মেলার ভিড়ের কারণে সকালে দেড়ঘণ্টায় অফিস এলেও ফেরার পথে ঠিক কত ঘণ্টায় বাসায় পৌঁছাবেন, তা সঠিক জানা নেই তার। রাশিদা বলেন,  ‘এই রাস্তায় মেট্রোরেলের কাজ  চলায় এমনিতেই মিরপুরবাসীর হয়রানির সীমা নেই। এর মধ্যে বাণিজ্য মেলার কারণে সেই হয়রানি দ্বিগুণ হয়েছে। সন্ধ্যায় অফিস শেষ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে হয় চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে আগারগাঁও পার হতে। আমার মনে হয়, নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে এই বিষয়গুলোও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এই হয়রানির মধ্যে বাসগুলো চলে এলোমেলোভাবে, রাস্তায় যাত্রী নামিয়ে ভাড়া আদায়ের মতো ঘটনাও ঘটে। ফলে সবমিলিয়ে  জীবনের বেশিরভাগ সময় আমরা রাস্তায় কাটাতে বাধ্য হচ্ছি।’ 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাণিজ্য মেলায় ক্রেতা-দর্শনার্থী ও বেচা-বিক্রির পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হকার। হকারদের অবাধ চলাফেরার কারণে মেলায় আগতদের হাঁটাচলা ও স্টল মালিকদের বেচাবিক্রিতেও ব্যাঘাত ঘটছে। এনিয়ে ভুক্তভোগীরা রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) অস্থায়ী কার্যালয়ে নালিশ জানিয়েছেন। তবে সুরাহা হয়নি। মূলত মেলার প্রবেশ গেটের কর্মীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে কিছু আর্থিক সুবিধা দিয়ে হকাররা মেলায় প্রবেশ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই হকাররা গৃহস্থালি, খাবার ও খেলনাসামগ্রী বিক্রি করছেন। 

মেলার কারণে দুর্ভোগের শিকার একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান,  আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা তার গুরুত্ব হারিয়েছে। কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি এই মেলায় স্টল বরাদ্দ নিলেই সেটিকে আন্তর্জাতিক মেলা বলা ঠিক নয়। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা এখন আর আন্তর্জাতিক মান ধরে রাখতে পারছে না। এমন কোনও পণ্য নেই, যা এই মেলায় পাওয়া যায় না। যেকোনও পণ্য বিক্রির মেলা এটি নয়। আসলে এখানে দেশের খ্যাতনামা  ব্র্যান্ডগুলোকে পণ্য বিক্রির জন্য স্টল বরাদ্দ দেওয়া উচিত ছিল,  যাতে করে দেশি পণ্যের পরিচিতি বাড়ে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্থ সংস্থা রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)  তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না।’

অভিযোগ রয়েছে, মানুষের আগ্রহের সুযোগ নিয়ে বেশিরভাগ কোম্পানি নানা ধরনের ছাড়ের ঘোষণা দিয়ে সারা বছরই নিজস্ব স্থায়ী দোকানে বা কারখানায় বা শো রুমে বিক্রি না হওয়া পণ্য এই মেলায় চালিয়ে দেয়। পরবর্তীতে কোনও ক্রেতা মেলা থেকে কেনা পণ্যের বিষয়ে অভিযোগ করতে গেলে তার দায়িত্ব নেয় না ওইসব  প্রতিষ্ঠান।  ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা (ছবি: ফোকাসবাংলা)
বরিশাল থেকে ঢাকায় দুই কন্যাকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন একটি বেসরকারি হাই স্কুলের শিক্ষক এরফান আলী। তিনি উঠেছেন মোহাম্মদপুরে এক আত্মীয়ের বাসায়। মেয়েদের আবদার পূরণ করতে  বাণিজ্য মেলায় দেশীয় একটি কোম্পানি থেকে এলইডি টিভি কিনেছেন। আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে সবকিছু ঠিক আছে কিনা, তা দেখতে টিভির প্যাকেটটি খোলেন এরফান আলীর দুই মেয়ে। তারা দেখতে পান টিভির সঙ্গে রিমোট নেই। এরফান আলী  বলেন,  ‘অভিযোগ নিয়ে ফের মেলায় গিয়ে নির্ধারিত স্টলে  একটি রিমোট চাইলাম। স্টলে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলেন, ‘কোনও সমস্যা নাই। মেলায় তো বাড়তি রিমোট নাই। আপনি আমাদের যেকোনও শো-রুমে গিয়ে মেমো দেখিয়ে রিমোট চাইলেই দিয়ে দেবে।’ যথারীতি বায়তুল মোকাররমে অবস্থিত কোম্পানির শো-রুমে গিয়ে মেমো দেখিয়ে রিমোর্ট চাইলে বলা হয়, ‘আমরা কেন দেবো। যেখান থেকে আপনি টিভি কিনেছেন সেখানে যান। তারা আপনাকে টিভির রিমোট দিয়ে দেবে।’         
অভিযোগ রয়েছে ইপিবির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও। তারা অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে প্রকৃত স্টলের সাইজ থেকে কয়েক ইঞ্চি করে কমিয়ে কমিয়ে স্টল তৈরি করেন এবং তা বরাদ্দ দেন। আর এভাবেই মূল ডিজাইনের বাইরে বের করেন নতুন কয়েকটি স্টল, যা প্রকৃত ডিজাইনে থাকে না। পরবর্তীতে এ বিষয়ে কেউ আর কোনও খোঁজ রাখে না। কেউ আর মনিটরিংও করে না। আর এভাবেই বাণিজ্য মেলার অভ্যন্তরে চলে গতানুগতিক পণ্যের বেচাকেনা।    
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অভিযোগ পেলে অবশ্যই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে। এর সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ বাণিজ্য মেলা শিগগির পূর্বাচলে স্থানান্তরের কোনও পরিকল্পনা আছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘পূর্বাচলে নয়, আগারগাঁওয়েই হবে বাণিজ্য মেলা। পূর্বাচলে মেলা হবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘শহরের বাইরে তো ওটা। যে কারণে ওখানে যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা রেডি হয়নি, অতো জায়গাও নাই। নতুন যে জায়গাটা হবে সেখানে সারা বছর ধরে রফতানিমুখী পণ্য প্রদর্শনের মেলা হবে। তবে বাণিজ্য মেলা আপাতত আগারগাঁওয়েই অনুষ্ঠিত হবে।’ 
উল্লেখ্য, বাণিজ্য মেলা শুরু থেকেই রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের আগারগাঁওয়ে হয়ে আসছে। এতে ওই এলাকায় পুরো মাস ধরে যানজট লেগে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালে ঢাকার পূর্বাচলে ২০ একর জমির ওপর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার স্থায়ী প্রাঙ্গণ তৈরির একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। ৭৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পের আওতায় এক্সিবিশন সেন্টারে ১৫০০ গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা, প্রতিটি ৯ বর্গমিটারের ৮০৬টি বুথ, দুটি বড় হলরুম, সম্মেলন কেন্দ্র, অভ্যর্থনা কেন্দ্র, বাণিজ্য তথ্য কেন্দ্র, সভাকক্ষ, প্রেস সেন্টার, সার্ভিস রুম এবং সাব-স্টেশন করার কথা বলা হয়।  পরে ২০১৭ সালের বাণিজ্য মেলা শেষ হওয়ার পর তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সংসদে বলেন, ‘পূর্বাচলে বাণিজ্য মেলার অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। ২০১৯ সাল থেকেই সেখানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা হবে।’ কিন্তু তা হয়নি। আগামী বছর ২০২০ সালেও হবে কিনা, তা জানেন না কেউই।
সরেজমিন দেখা গেছে, মেলায় আগতদের জন্য শৌচাগারের অপ্রতুলতা রয়েছে। যেগুলো আছে সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। নোংরা পরিবেশ, মেলায় হকারদের দৌরাত্ম্য, ভিক্ষুকদের উৎপাত, ধুলা-বালুসহ বিভিন্ন কারণে অতিষ্ঠ বাণিজ্য মেলার দর্শনার্থীরা। রাস্তার ওপরে করা হয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। যে পথ দিয়ে মানুষ চলাচল করার কথা সেখানেও গাড়ি পার্কিং করা হচ্ছে। 
অব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে মেলার সদস্য সচিব আবদুর রউফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অভিযোগগুলো সম্পর্কে আমরা সচেতন। যেকোনও অভিযোগই আমরা গুরুত্ব দেই। মেলায় যথেষ্ট পরিমাণ টয়লেট বা শৌচাগার রয়েছে। সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কারের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক স্টাফ রয়েছে। তবে তারা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা, সে বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হবে।’

 

/এফএস/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মিয়ানমার-থাই সীমান্তে আবারও বিদ্রোহীদের হামলা, থ্যাইল্যান্ডে পালাচ্ছে মানুষ
মিয়ানমার-থাই সীমান্তে আবারও বিদ্রোহীদের হামলা, থ্যাইল্যান্ডে পালাচ্ছে মানুষ
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
ভুয়া অবিবাহিত সনদের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন এক ব্যক্তি
ভুয়া অবিবাহিত সনদের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন এক ব্যক্তি
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ