X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাটার টেনে বাঁচতে চেয়েছিলেন তারা

নুরুজ্জামান লাবু ও শেখ জাহাঙ্গীর আলম
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:৪২আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৩:১০





শাটার টেনে বাঁচতে চেয়েছিলেন তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র কাওসার আহমেদ। পড়াশোনার পাশাপাশি মদিনা মেডিক্যাল সেন্টার ও ডেন্টাল কেয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন তিনি। তার সহযোগী হিসেবে ফার্মেসি ও ক্লিনিকে পার্টটাইম কাজ করতেন বড়কাটরা মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা ওমর ফারুক। বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজের শেষ বর্ষের দুই ছাত্র ইমতিয়াজ ইমরুল রাসু ও আশরাফুল হক ডেন্টাল কলেজে প্র্যাকটিস করতেন। ওই ডেন্টাল ক্লিনিকে দাঁত দেখাতে গিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ অধ্যয়নরত কাজী এনামুল হক। ছিলেন আরেক নারী ও তার শিশুসন্তান। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর সড়কে আগুন ছড়িয়ে পড়লে তড়িঘড়ি তারা ডেন্টাল ক্লিনিকের শাটার টেনে দেন। ভেবেছিলেন, হয়তো আগুনের কবল থেকে বাঁচা যাবে। কিন্তু সুরক্ষার সেই প্রচেষ্টাই কাল হলো তাদের! ভয়াবহন আগুনের তাপ ও ধোঁয়ায় প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই মারা যান তারা।
কাওসার আহমেদের স্ত্রী নুসরাত জাহান মুক্তা, দুই সন্তান ও স্বজনেরা বৃহস্পতিবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিন রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টার শাহী মসজিদের মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, ঘটনাস্থল পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। সড়কে পুড়ে কয়লা হয়ে পড়ে আছে বিভিন্ন যানবাহন। ঠেলাগাড়ি থেকে শুরু করে সাইকেল, রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা, মটরবাইক, পিকাপ, প্রাইভেটকার কিছুই আর আলাদা করে চেনা দায়। সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্লাস্টিকের দানা। মূল যে ভবনে আগুন লেগেছিল সেই হাজী ওয়াহিদ ম্যানশন যেন মৃত্যুপুরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ভবনের পশ্চিম দিকেই দেড়তলা পাপ্পুর বাড়ি। এর নিচতলায় ছিল মদিনা মেডিক্যাল সেন্টার অ্যান্ড ডেন্টাল কেয়ার। সেখানেই সর্বনাশা আগুনে নিভে এতগুলো মেধাবী প্রাণ।
কাজী এনামুল হকের ভাই আমীর হোসেন কাজী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গের সামনে ফুটফুটে দুই জমজ শিশু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নুসরাত জাহান মুক্তা। কাওসার আহমেদের স্ত্রী। তার দুচোখ অশ্রুভেজা, ফোলা ফোলা। দেখেই বোঝা যায়, দীর্ঘ সময় ধরে কেঁদেছেন তিনি। কোলে থাকা ১১ মাস বয়সী দুই শিশু মেহজাবিন সারা ও জামিল আহমেদ কাফি যেনবা হতচকিত। বোঝার বয়স হয়নি তাদের, কী হারিয়েছে তারা। মুক্তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন স্বজনেরা।
মুক্তার ভাই আজিজুল ইসলাম জানালেন, বছর দুয়েক আগে বিয়ে হয়েছে কাওসার ও মুক্তার। কাওসারের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার হোমনায়। বাবার নাম ডা. খলিলুর রহমান। কাওসার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে থাকতেন চুড়িহাট্টার পাশেই।
আশরাফুল হক আজিজুল ইসলাম জানান, পড়াশোনার পাশাপাশি মদিনা মেডিক্যাল সেন্টার ও ডেন্টাল কেয়ার নামে প্রতিষ্ঠানটি চালাতেন তিনি। আগুনে সব শেষ। অবুঝ দুই সন্তান নিয়ে মুক্তা পড়লেন অথৈ সাগরে।
কাওসারের আরেক বন্ধু লালবাগের জামিয়া কোরানিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুল ফারাহ জানান, কাওসার তার বন্ধু ছিলেন। জেনারেল লাইনে পড়াশোনার আগে কাওসার ও তিনি একসঙ্গে হাফেজি পাস করেন।
এনামুল হক বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজের চতুর্থ বর্ষের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী মর্গের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের একজন কাঁদছেন। অন্যরা বিমর্ষ, শোকে বিহ্বল। বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজের শিক্ষক ডা. জাফরিনা ইসলাম সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাদের। দুই ছাত্র ইমতিয়াজ ইমরুল রাসু ও আশরাফুল হকের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরে মর্গে ছুটে এসেছেন তিনি। কান্নারত ছেলেটি ইমতিয়াজের ছোট ভাই ইশতিয়াক ইমরুল রাজু। সেখানেই উপস্থিত থাকা আরেক শিক্ষক ডা. জারিফ জানালেন, নিহত দুজন চতুর্থ বর্ষের সরাসরি ছাত্র ছিল তার। অত্যন্ত মেধাবী ছিল তারা। কিন্তু সর্বনাশা আগুন তাদের কেড়ে নিলো জীবন থেকে।
ইমতিয়াজ ইমরুল রাসু ইমতিয়াজ ও আশরাফুলের বন্ধুরা জানান, ডেন্টাল অনুষদের পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন তারা। চুড়িহাট্টার মদিনা মেডিক্যাল সেন্টার অ্যান্ড ডেন্টাল কেয়ারে সন্ধ্যায় বসতেন দুজন। সেখানেই মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তাদের। ইমতিয়াজ থাকতেন ধানমন্ডির শংকরে ডেন্টাল ছাত্রাবাসে। তার বাবার নাম নজরুল ইসলাম। গ্রামের বাড়ি পাবনার বেড়ায়। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ইমতিয়াজ ছিলেন বড়। আশরাফুল হকের বাবার নাম জামসেদ মিয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্চারামপুরে। বাবা-মায়ের সঙ্গে তিনি থাকতেন মগবাজারে।
কাওসার আহমেদ এই দুই ডেন্টাল শিক্ষার্থীর বন্ধু জিহাদুল হক রিমন বলেন, ‘ওদের শরীর খুব বেশি পুড়ে যায়নি। আশরাফের হাতে গ্লাভসটিও অক্ষত ছিল। কিন্তু মুখের কিছু অংশ ঝলছে গেছে। আটকে থাকা অবস্থায় শ্বাসনালী পুড়ে গিয়ে মারা যান তারা।’
পাজামা-পাঞ্জাবি পরা প্রায় জনাপঞ্চাশেক তরুণকে দেখা গেলো মর্গের ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে। তাদের একজন রাকিবুল ইসলাম জানালেন, তারা সবাই বড়কাটরা মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। তাদের ওস্তাদ মাওলানা ওমর ফারুক মারা গেছেন। ওমর ফারুক কাজ করতেন সেই মদিনা মেডিক্যাল সেন্টার ও ডেন্টাল কেয়ারে, কাওসার আহমেদের সঙ্গে। শিক্ষার্থী ও স্বজনরা জানালেন, শরিয়তপুরের নড়িয়ার করিম মাতবরের ছেলে ওমর ফারুক থাকতেন বড় কাটরা মাদ্রাসাতেই। খণ্ডকালীন কাজ করতেন মদিনা মেডিক্যালে। স্ত্রীর সঙ্গে সম্প্রতি ডিভোর্স হয়েছে তার। তার এক শিশুসন্তান রয়েছে, থাকে গ্রামের বাড়িতে।
ওমর ফারুক ঢাকা মেডিক্যালের মর্গ পেরিয়ে অ্যাম্বুলেন্স রাখার ফাঁকা যে জায়গা আছে, সেখানকার দেয়াল ঘেঁষে একটি চেয়ারে বসে আছেন আমীর হোসেন কাজী। পাশে স্বজনদের কেউ দাঁড়িয়ে বা বসে। হাতে একটি ছবি। আমীর হোসেন কাজী জানালেন, তার ছোট ভাই কাজী এনামুল হক মারা গেছেন আগুনে পুড়ে। এনামুল থাকতেন হাজী বালুরঘাট এলাকার একটি মেসে। ঢাকা সিটি কলেজ থেকে বিবিএ সম্পন্ন করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করছিলেন তিনি। পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরিও করতেন। তাদের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীতে, বাবার নাম কাজী মোতালেব।
কাওসারের ভিজিটিং কার্ড এনামুলের রুমমেট আবুজার হোসেন সাগর জানান, রাত আটটার দিকে বায়োডাটা প্রিন্ট করার জন্য মেস থেকে বের হন এনামুল। আজিমপুর গিয়ে বায়োডাটা প্রিন্ট করে দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল তার। দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই আটকে পড়ে পুড়ে মারা যান তিনি। সাগর জানান, এনামুল মেধাবী ছিলেন। চাকরি খুঁজছিলেন। কিন্তু তার আগেই জীবনের ওপারে চলে গেলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, মদিনা মেডিক্যাল সেন্টার ও ডেন্টাল কেয়ার থেকে একজন নারী ও একটি শিশুর লাশও উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তাদের স্বজনদের কাউকে পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, তারাও ওই ডেন্টাল কেয়ারে দাঁতের ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন। সেখানেই আটকে পড়ে করুণ মৃত্যু হয় তাদেরও।

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!