X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

দিবস নয়, দরকার গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

উদিসা ইসলাম
২৫ মার্চ ২০১৯, ০৭:৪৮আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২৩:১২

২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাওয়ার বাস্তবতা নেই বলেই মনে করছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকেরা। তারা বলছেন, ২৫ মার্চের পরিবর্তে বরং ১৯৭১ সালের ৯ মাসজুড়ে চলা হত্যাযজ্ঞের ঘটনাগুলোর ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি চাওয়াটাই এখন বাংলাদেশের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। গবেষকদের মতে, ইতোমধ্যে ৯ ডিসেম্বরকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। এই অবস্থায় গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতির জন্য দেন-দরবারের আর কোনও সুযোগ বাংলাদেশের নেই। তবে বাংলাদেশ দিবসটিকে জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করতেই পারে।

বেসরকারি উদ্যোগে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের দাবি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রথমবার তোলা হয় ২০০১ সালে। তবে সরকারি উদ্যোগের অভাবে সেসময় কাজ একেবারেই এগোয়নি। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিলে সে সুযোগ হাতছাড়া হয় বাংলাদেশের।

বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রথম গণহত্যা শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে, যা অব্যাহত থাকে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর যোগসাজশে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল), রাজারবাগের পুলিশ লাইন ও পিলখানার ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদর দফতরে। তাদের হামলায় নিহত হন হাজার হাজার বাঙালি। বছরব্যাপী চলা গণহত্যার শেষ অভিযানটি পরিচালিত হয় ১৪ ডিসেম্বর। এসময় কেবল ঢাকাতেই দুই শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়।

বাংলাদেশের এই গণহত্যার কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লেও কাগজে-কলমে এটিকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এমনকি বাংলাদেশেও জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালন শুরু হয় মাত্র দুই বছর আগে,  ২০১৭ সাল থেকে।

কেন এতদিনেও আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় সম্ভব হয়নি–এই প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সময়মতো আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে নক করিনি। আবার আমাদের দেশে একটা লম্বা সময় ভিন্নধারার রাজনীতি সক্রিয় ছিল। ফলে আমরা পিছিয়ে গেছি।’

তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পরপর আমরা দেশটার স্বীকৃতি নিয়ে অনেক কাজ করেছি, সময় দিয়েছি। সেসময় গণহত্যা নিয়ে কাজ কেবল শুরু হয়েছিল। কিন্তু তারপর দৃশ্যপট বদলে যাওয়ায় উল্টো যেন স্বীকৃতি না দেওয়া হয়, সেই চেষ্টা অব্যাহত ছিল। তা না হলে আরও আগেই এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হতো।’

এ ব্যাপারে সরকার যথেষ্ট উদ্যোগ নিচ্ছে বলে মনে করেন কিনা, এই প্রশ্নের জবাবে তুরিন আফরোজ বলেন, ‘সীমিত আকারে শুরু হয়েছে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। বেসরকারিভাবে অনেক গবেষণা, অনেক ধরনের উদ্যোগ-প্রচেষ্টা আছে, সেগুলো নজরে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে হবে।’

তবে আন্তর্জাতিকভাবে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পাওয়ার আর কোনও সুযোগ নেই উল্লেখ করে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই বিষয়টা সমাধান হয়ে গেছে ধরে নিয়ে সামনে এগুতে হবে। ২৫ মার্চের গণহত্যা আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে দাবি করার কোনও সুযোগ অবশিষ্ট নেই। কেননা, স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টিতে বাংলাদেশ অনেক দেরি করে ফেলেছে। ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে আর্মেনিয়ার প্রস্তাবের ভিত্তিতে ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে বাংলাদেশসহ ১৯৩টি সদস্য দেশ। ফলে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের সুযোগ নেই এবং বাংলাদেশে ৯ মাস ধরে যে গণহত্যার ঘটনাগুলো ঘটেছে, আমরা যেন সেইটাকে গণহত্যা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতে পারি, সেই কাজ করা জরুরি।’

এখন করণীয় কী হতে পারে–এই প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে যে গণহত্যা ঘটেছিল, সেই স্বীকৃতি অর্জনের পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে ২০১৭ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে কয়েকটি প্রস্তাব দেওয়া হলেও এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে একটি রেজ্যুলেশন নেওয়া হয়েছিল; যেখানে উল্লেখ আছে, আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি অর্জনে উদ্যোগ নেবে। এটি পুরোপুরি ভুল। এখন এই রেজ্যুলেশনে একটু পরিবর্তন এনে গণহত্যার স্বীকৃতি নিতে কাজ করবে উল্লেখ করে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু করা জরুরি।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ সম্পর্কে জানাতে গত ২৩ মার্চ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে লেখেন, ‘গণহত্যা দিবস নিয়ে আমাদের কূটনৈতিক কার্যক্রমের কিছু তথ্য নিচের লিংকে দিলাম। আজকে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আপনারা নিচের তথ্যগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারেন।’ প্রতিমন্ত্রীর এই স্ট্যাটাস এবং এর সঙ্গে দেওয়া দলিলপত্রের শিরোনামেও গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কথাটিই উল্লেখ আছে।

রবিবার (২৪ মার্চ) শাহরিয়ার আলম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বলেন, ‘জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমরা ন্যূনতম যেটি চাই, পৃথিবীর যত সম্ভব বেশি রাষ্ট্র আমাদের এই বিষয়টির স্বীকৃতি দেবে, এর প্রতি সহমর্মিতা জানাবে, নিন্দা জানাবে। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে–  বাংলাদেশের গণহত্যার জাতিসংঘের স্বীকৃতি।’

গণহত্যার স্বীকৃতি কেন দরকার সেটিও আমাদের জানা জরুরি উল্লেখ করে সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিসের পরিচালক মফিদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে, সেটি মুক্তিযুদ্ধ সংঘটনের পুরো সময়জুড়েই হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর মামলায় আসামিপক্ষও এই গণহত্যা অস্বীকার করেনি। পাকিস্তানের সেসময় থেকে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, গণহত্যা হয়েছে। এই গণহত্যার যদি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না মেলে, তাহলে অফিসিয়ালি পাকিস্তানের যে অস্বীকার করার প্রবণতা সেটি আরও পাকাপোক্ত হবে।’

আরও খবর: গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ 

/ইউআই/এমএ/এএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু: ‘অপরাধ আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে’
প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু: ‘অপরাধ আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে’
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৮ বিজিপি সদস্যকে
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৮ বিজিপি সদস্যকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা