X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘আভিভি বেইমানহি হ্যায়’

উদিসা ইসলাম
২৫ মার্চ ২০১৯, ১৪:২২আপডেট : ২৬ মার্চ ২০১৯, ১০:১০

১৯৭১ সালে তৎকলীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চালানো গণহত্যার প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রগতিশীল যে লেখক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মীরা রাস্তায় নেমেছিলেন তাদের ওপর চলেছিল জেলজুলুম। সামাজিকভাবে তাদের একঘরে করা থেকে শুরু করে ষড়যন্ত্রকারী, গাদ্দার, দেশদ্রোহী তকমা লাগিয়ে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা। এখন তারাই পাকিস্তানের টেলিভিশনে এসে সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থান ভুল ছিল স্বীকার করলেও সেই আন্দোলনকারীদের অবস্থান সঠিক ছিল তা উচ্চারণ করেন না। সেই ক্ষোভ থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পাকিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসিম আখতার মালিক তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আভিভি বেইমানহি হ্যায়।’ তার দাবি, গণহত্যার কথা পাকিস্তানকে স্বীকার করে নিতে হবে এবং ক্ষমা চাইতে হবে।



গণহত্যার বিচার দাবি করেছেন যেসব পাকিস্তানি অ্যাক্টিভিস্টরা

সম্প্রতি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের ডকুমেন্টারিতে তিনি বলেন, ‘এখন বিভিন্ন চ্যানেলে এসে সব পার্টির মানুষ বলছে, সে সময় ভুল হয়েছিল। অবাক লাগে, তাদের এটা বুঝতে ৩০-৩৫ বছর (সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়কালীন) পার হয়ে গেছে। আমরা যারা আগেই সেটা বলেছিলাম তারা ঠিক ছিলাম, এটা এখনও তারা বলছে না। আভিভি বেইমানহি হ্যায়।’
Voice of conscience নামের ডকুমেন্টারিতে পাকিস্তানের খ্যাতিমান লেখক, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টরা দাবি করেছেন, পাকিস্তানের উচিত ক্ষমা চাওয়া। তারা বলেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছিল।


ডকুমেন্টারির কাভার নাসিম আখতার মালিক বলছেন, যেদিন বিজয় এলো পুরো পাকিস্তান চুপচাপ, যেন কারও মা মারা গেছে। আমি তো খুব খুশি। আমি লাড্ডু কিনে কারাগারে গেলাম। আমার সঙ্গে কিছু নারীনেত্রী ও শ্রমিক নেতা আমাতুন ছিল। আটকদের দেখে জয় বাংলা বলতেই ওরা উত্তর করলো জয় বঙ্গবন্ধু।

২৫ মার্চ এই নেত্রী বাংলাদেশে ছিলেন। গণহত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলছেন, ফেরার পথে রাস্তায় ভয়াবহ চিত্র- গুলি করে, গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। ফিরে গিয়ে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি তার স্বামীকে বলেন, কেউ আমাকে বোমা এনে দাও, আমি মিলিটারি সদর দফতরে মেরে আসি। তিনি বলছেন, ততক্ষণে আমি পুরোপুরি বিপর্যস্ত। আমি এই নির্মমতা মেনে নিতে পারছিলাম না।
সাংবাদিক আহমেদ সেলিমের দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শুরুতে তাহিরা মাজহার আলী খানের নেতৃত্বে লাহোরে র‌্যালির আয়োজন হয়। সেখান থেকে কয়েকজনকে আটকও করা হয়। সেখানে অন্যদের মধ্যে নাসিম আখতার মালিক, কবি হাবিব জালেদ উপস্থিত ছিলেন।

১৯৭১ সালের এপ্রিলে গণহত্যার প্রতিবাদে লাহোরে র‌্যালি থেকে আটককৃতদের কয়েকজন


তাহিরা মাজহার আলী খানের বক্তব্যও আছে ডকুমেন্টারিতে। প্রগতিশীল ঘরানার এই অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, ভুলে যাওয়ার উপায় নেই ১৯৭১-এ গণহত্যা ঘটেছিল। ভারতের দালাল, ষড়যন্ত্রকারী এসব বলা হতো। লাহোরের ন্যাপ-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাফর মালিকতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলছেন, ‘সবাই আমাদের দালাল ভাবলো। সামাজিকভাবে আমাদের বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছিল। আমি এবং আমার পরিবার সে সময় এসবের মধ্য দিয়ে গিয়েছি।’

তাহিরা মাজহার আলী খান


পাকিস্তানের সাবেক বিমানবাহিনী চিফ এয়ার মার্শাল (অব) আসগর খান বলেন, সে সময় যা ঘটেছিল তা ক্রিমিনাল অ্যাকশন ছিল। তাদের শাস্তি হওয়া উচিত বলে আমি বলেছিলাম। শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে এবং তার ক্ষমতা গ্রহণের অধিকার ছিল। সে সময় আমাদের দালাল বলা হয়েছিল। সেসব দিন এখন অতীত, খুব কষ্টকর ছিল আমার জন্য।

পাকিস্তান এয়ারফোর্সে কর্মরত ছিলেন আনোয়ার পিজাদো। তার ছেলের কথা ডকুমেন্টারিতে উঠে এসেছে। তার ছেলে বলছেন, ‘বাবা পাকিস্তান এয়ারফোর্সে ছিলেন। সে সময় বাংলাদেশে গণহত্যা ঘটছে। তিনি সেটিকে অন্যায় হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে এক বন্ধুকে চিঠি লেখেন। বন্ধু স্টেশনে না থাকায় চিঠিটি অন্যের হাতে চলে যায় এবং সেই চিঠি কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয় অভিযোগ করে। এর ভিত্তিতে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হন তিনি এবং সাত বছর জেল হয়।’

আনান জাকারিয়ার সঙ্গে সুন্দরী বালা


২০১৭ সালের জুলাই মাসে হারুন খালিদ ও আনান জাকারিয়া নামে দুই পাকিস্তানি লেখক বাংলাদেশে আসেন জেনোসাইড বিষয়ে আরও তথ্য জানতে। তারা মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের নির্যাতনের শিকার ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিনীর কথা শোনেন, খুলনার সুন্দরী বালার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সুন্দরীকে লাশের স্তূপ থেকে কুড়িয়ে বড় করেছেন এক দম্পতি। যিনি কুড়ে পেয়েছিলেন তিনি বলছেন, ‘সেইদিন আক্রমণে শহীদ হন অনেক মানুষ। হঠাৎ দেখি নিহত মায়ের বুকে পড়ে আছে একটি শিশু, দুধ খাচ্ছে মনে হলো। তিনি শিশুটিকে কোল থেকে নেওয়ার সময় মৃত মা’র কপালে সিঁদুর দেখে বোঝেন শিশুটি হিন্দু সম্প্রদায়ের।
আনান জাকারিয়া সুন্দরীকে প্রশ্ন করেছিলেন, যার জন্য আপনার এই অবস্থা, তাদের একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, আপনার কেমন লাগছে। সুন্দরীর জবাব ছিল, আমি তো কোনোভাবে মা-বাবা ফেরত পাবো না। এতদিন পর পাকিস্তানি কেউ সাক্ষাৎ করতে এসেছে এতে আমি খুশি। আনান বলেন, সুন্দরীর কথায় এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, আমি পাকিস্তানি বা সে বাংলাদেশি না, আমরা দুজনই মানুষ।

এ বিষয়ে ডকুমেন্টারির নির্মাতা ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের এখন অন্যতম জরুরি কাজ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়। আমরা সেই লক্ষ্যে অনেক আগে থেকে কাজ করছি। পাকিস্তানের খ্যাতনামা লেখক, সংস্কৃতিকর্মী ও বৃদ্ধিজীবীরা যখন গণহত্যার বিচারের দাবি জানাচ্ছেন তখন সেটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের দাবিকে আরেকটু সামনে এগিয়ে নিতে পারবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যারা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন এবং বর্তমান প্রজন্মের যারা মনে করেন ১৯৭১-এ বাংলাদেশে গণহত্যা ঘটেছিল এবং পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত, তারা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন এখানে।’

 

/ওআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!