X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

চালু হয়নি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, ফেরত গেছে ২২০ কোটি টাকা

এস এম আববাস
০২ এপ্রিল ২০১৯, ১৩:৪৯আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:১৩




মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম (ছবি- সংগৃহীত) প্রকল্প অনুমোদনের দুই বছরেও চালু হয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়নাধীন আইসিটি প্রকল্পের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। এ কারণে ফেরত গেছে প্রকল্পে বরাদ্দের ২২০ কোটি টাকা। প্রকল্প কর্মকর্তাসহ মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা, ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) নির্দেশনা না মানা, পিপিআর (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস) এর বিধি উপেক্ষা করা এবং বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন প্রস্তাবনা তৈরিই এর অন্যতম কারণ বলে অভিযোগ উঠেছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৩১ হাজার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় মোট ৪৮ হাজার মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন এবং প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে আইসিটি প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়। জুলাই ২০১৬ থেকে জুন ২০২০ মেয়াদে আইসিটির মাধ্যমে ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়)’ বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেওয়া হয়।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের যন্ত্রপাতি সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি (ডিপিএম) এবং উন্মুক্ত দর পদ্ধতির (ওটিএম) ব্যবহার নিয়ে শুরুতেই বিতর্ক দেখা দেয়।

প্রথম পর্যায়ে প্রকল্পে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে টেশিস (টেলিফোন শিল্প সংস্থা) থেকে ল্যাপটপ সংগ্রহ করা হয় এবং প্রজেক্টরসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি কেনা হয় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে।

প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়েও একইভাবে সরাসরি পদ্ধতিতে ল্যাপটপ কেনার সিদ্ধান্ত হলেও পত্রপত্রিকায় নেতিবাচক প্রচারণার কারণে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের হস্তক্ষেপে সরাসরি পদ্ধতি থেকে সরে আসা হয়। উন্মুক্ত পদ্ধতি ও ইজিপি (ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ই-জিপিতে দরপত্র আহ্বানের পর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রজেক্টরের স্পেসিফিকেশন নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়।

প্রকল্পের আওতায় ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা মূল্যের প্রজেক্টরের স্পেসিফিকেশন তৈরি করা হয়। যাতে প্রয়োজনীয় এক্সেসরিজ এবং ইনস্টলেশন (স্থাপন) ব্যয়সহ সরকারের নির্ধারিত ভ্যাট-ট্যাক্স যোগ করে প্রতিটি ৮০ হাজার টাকা দরে মোটামুটি উন্নতমানের প্রজেক্টর কেনা সম্ভব।

তবে সংশ্লিষ্ট ছয়টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা মূল্যমানের প্রজেক্টরের স্পেসিফিকেশনের প্রস্তাব করে। এক্সেসরিজসহ ইনস্টলেশনের শর্ত বাদ দেওয়ারও অনুরোধ করে প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের এই প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য প্রকল্প পরিচালককে অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে।

প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীদের নিম্নমানের এ স্পেসিফিকেশন মেনে নেয়নি। এর ফলে ছয়টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশগ্রহণে বিরত থাকে। আর দরপত্র উন্মুক্ত করার ১৬ দিন পর প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে দরপত্রে প্রতিযোগিতা সীমিতকরণ এবং ৬০ হাজার টাকার প্রজেক্টর ৭৫ হাজার টাকা মূল্যে ক্রয় করে ১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার মিথ্যা অভিযোগ দাখিল করেন ঠিকাদাররা।

অভিযোগের পর প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই ২০১৮ সালের জুন মাসে প্রকল্প পরিচালককে ওএসডি করা হয় এবং দরপত্র বাতিল করা হয়। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধার মুখে পড়ে। যদিও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ পরে তদন্তের মাধ্যমে মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

প্রকল্পের নতুন পরিচালক হিসেবে যোগ দেন ড. অধ্যাপক আব্দুস সবুর খান। এরপর ২০১৮ সালের আগস্টে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে স্পেসিফিকেশন তৈরির জন্য নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এ সময় ডিপিপি’র নির্দেশনা ও ২০১৮ সালের পিপিআরের বিধিবিধান উপেক্ষা করে টেশিস থেকে ডিপিএম পদ্ধতিতে মাল্টিমিডিয়া সামগ্রী কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ অবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংসদীয় কমিটির কাছে এ উদ্যোগকে বেআইনি আখ্যা দিয়ে তা বন্ধ করার আবেদন করেন ব্যবসায়ীরা।

এরই মধ্যে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ডিপিএম পদ্ধতিতে টেশিস থেকে উল্লিখিত ক্রয় কার্যক্রম সম্পাদনের অনুমোদন দেয়। তবে বিপত্তি দেখা দেয় প্রজেক্টরের স্পেসিফিকেশন নিয়ে। কারণ, আইসিটি বিভাগ থেকে যে স্পেসিফিকেশন দেওয়া হয়েছে, সে স্পেসিফিকেশনের প্রজেক্টর একমাত্র জাপানের কেসিও কোম্পানি তৈরি ও বাজারজাত করে। বাংলাদেশের বাজারে এ ধরনের প্রজেক্টরের খুচরা মূল্য ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টাকা। নির্ধারিত এই মূল্যের সঙ্গে ভ্যাট-ট্যাক্স যোগ করলে প্রজেক্টরের দাম পড়ে কমপক্ষে ৯৫ হাজার টাকা। এতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ৯৫ হাজার টাকা দরের প্রজেক্টর কীভাবে ডিপিপি নির্ধারিত ৮০ হাজার টাকায় কেনা সম্ভব!

এ অবস্থায় স্পেসিফিকেশন সংশোধন করে আবারও ক্রয় কার্যক্রম শুরুর বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, প্রকল্প সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতা এবং দীর্ঘসূত্রতার কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় এ বছরের বরাদ্দ থেকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের অর্থ বাদ দিয়ে ৩৫০ কোটি টাকার আরএডিপি’র (সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) জায়গায় ১৪০ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়েছে। ফলে আরও এক বছরের জন্য মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের কর্মসূচি পিছিয়ে যাচ্ছে।

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের কোনও খবর না থাকলেও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ঠিকই শুরু হয়ে গেছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষকদের বিটিটি (বেসিক টিচার ট্রেনিং) কোর্স এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। তবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন না করায় ১২ দিনের এ কোর্সও ব্যর্থ হতে চলেছে। কারণ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন না হওয়ায় প্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষকদের পক্ষে স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে ক্লাস নেওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে যেন শিক্ষকরা মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনা করতে পারেন সেটিই ছিল প্রকল্পের লক্ষ্য।

মাউশি সূত্র বলছে, ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভ এবং অসাধু চক্রের যোগসাজশে প্রথম প্রকল্প পরিচালকের অপসারণের মাধ্যমে আতুরঘরেই প্রকল্পটিকে ধ্বংস করা হয়। এর বাস্তবায়নও বিলম্বিত হয়। এদিকে ঘোড়ার আগে গাড়ি কেনার মতো মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের আগেই প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হয়। এতে সরকারি অর্থের কেবল অপব্যবহারই হচ্ছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ড. অধ্যাপক আব্দুস সবুর খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্পেসিফিকেশন করেছে মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি।’ তবে প্রজেক্টর কেনার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি এই কর্মকর্তা।

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন ও বাস্তবায়ন এক বছরের মধ্যে সম্ভব কিনা জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘এক বছরের মধ্যে করা যাবে আমরা বলছি না। পিপিআর অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

/টিটি/এপিএইচ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী