X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধহীন পৃথিবীর গল্প

হিটলার এ. হালিম
০৯ এপ্রিল ২০১৯, ২৩:৩৯আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০১৯, ০০:৪৪

মুখ নাকি মুখোশ: কী বলবেন, যুদ্ধ না শান্তি কী আছে এর আড়ালে? কার্টুনিস্ট: মোর্শেদ মিশু

স্বপ্ন আর জীবনের মধ্যে যোজন যোজন ফারাক, মিল কদাচিৎ। মনের মধ্যে পুষে রাখা সুখের সিম্ফনি ঘর থেকে বেরিয়ে পথে নামলেই ঝড়ে পরিণত হয়, শুরু হয় সংগ্রাম। কখনও বিকট বিস্ফোরণে থমকে যায় জীবন। তবুও ফুলের বনে হাঁটার সুযোগ আসে কখনও, মোহনীয় হয়ে ওঠে কিছু প্রভাত বা গোধূলি হয়তো, জীবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যায় জীবন প্রতিনিয়ত। কিন্তু, সবার ভাগ্যে এই সামান্যটুকুও জোটে না! যারা কিছু স্বস্তিময় সময় পান, তারা কী ভাগ্যবান? নাকি বাকিরা দুর্ভাগ্যে নিমজ্জিত? আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে থাকা এইসব অমীমাংসিত ভাবনার ভেতরে যে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হই আমরা, তারপরও আশার রেশ জিইয়ে রেখে আমাদের যে বেঁচে থাকা, তারই চিত্রায়ণে এই খণ্ড খণ্ড দৃশ্যগল্প।   

সম্প্রতি জীবনের এমনই দুই রূপ ‘যুদ্ধ-মৃত্যু-হতাশা’ এবং ‘শান্তি-প্রাণ-সজীবতা’কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে আলোচনা সৃষ্টি করেছেন একজন তরুণ কার্টুনিস্ট। যুদ্ধের ভেতরে ও যুদ্ধের বাইরে একই জীবনের যে ভিন্ন দ্যোতনা হতে পারে, সেটাই বিভিন্নভাবে তুলে এনে প্রভাবশালী বিজনেস সাময়িকী ফোর্বসের ‘থার্টি আন্ডার থার্টি এশিয়া ২০১৯’ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশের আবদুল্লাহ আল মোর্শেদ। যিনি কার্টুনিস্ট মোর্শেদ মিশু নামে পরিচিত। একটি রম্য ম্যাগাজিনের সহসম্পাদক। মিডিয়া, মার্কেটিং অ্যান্ড অ্যাডভার্টাইজিং বিভাগে ফোর্বসের তালিকায় মিশু জায়গা করে নেওয়ায় তার আঁকা কিছু কার্টুন নিয়ে ভিনদেশেও এখন চর্চা চলছে বেশ। কী হচ্ছে, আর কী হওয়া উচিত; অথবা সমান্তরালে পৃথিবীর দুই রূপ দেখতে আসুন ঘুরে দেখি মিশুর আঁকা কয়েকটি কার্টুন-  

ছবি-১

ছবি ১: যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের মসুল শহরে একজন বাবা তার কন্যা সন্তানকে কোলে নিয়ে পালাচ্ছেন। বাবা-মেয়ে দুই জনই চিৎকার করে কাঁদছেন। এই দৃশ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছবির পাশেই আঁকা হয়েছে সবুজ একটা মাঠের মধ্যে বাবা তার কন্যাকে কোলে নিয়ে হাসছেন। তাদের মুখে পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্য- হাসি।

ছবি-২

ছবি ২: যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি বাড়িতে দেখা যাচ্ছে, বাবা ও সন্তানের মৃতদেহ পড়ে আছে। বাবার মাথার কাছে সন্তানের প্রাণহীন দেহ। ছবিটির নিচেই আঁকা হয়েছে বাবার বুকের ওপর নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে একটি শিশু। পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে খেলনা, গল্পের বই।

ছবি-৩

ছবি ৩: সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে একটি চেয়ারে বসে আছে যুদ্ধাহত একটি শিশু। পাশেই রয়েছে ফার্স্ট এইড বক্স। এই ছবিটি দেখে আঁকা হয়েছে, একটি শিশু চেয়ারে বসে চোখ বড় বড় করে গল্পের বই পড়ছে। পাশেই তার স্কুল ব্যাগ।

এরকম ১১টি ছবি এঁকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন কার্টুনিস্ট মিশু। প্রসঙ্গত, ১০টি ভিন্ন ক্যাটাগরিতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৩০ বছরের কম বয়সী ৩০ তরুণকে নিয়ে তালিকা তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিজনেস সাময়িকী ফোর্বস। অনলাইনে মনোনীত প্রায় তিন হাজারের বেশি তরুণের কাজ বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফোর্বস ‘থার্টি আন্ডার থার্টি এশিয়ার’ তালিকা চূড়ান্ত করে। প্রাথমিকভাবে ৫০০ জনকে বাছাই করা হয়। এরপর বিচারক ও সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে যাচাই-বাছাই করে ৩০০ জনের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করে।

ডানের ছবিতে বোনের কোলে নির্ভার শিশু, বামের ইনসেটে শিশুকে বাঁচাতে নাকে অক্সিজেন মাস্ক

মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) দুপুরে মোর্শেদ মিশুর এই অর্জন সম্পর্কে জানতে রাজধানীর ইব্রাহিমপুরে তাদের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বসার ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে সাজানো মিশুর বিভিন্ন চিত্রকর্ম, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার সনদ, প্রশংসাপত্র। টেবিলে ও ওয়াল শো-কেসে সাজিয়ে রাখা ক্রেস্ট, মেডেল ইত্যাদি। দেখে শেষ করার আগেই মোর্শেদ মিশু বললেন, ‘চলুন শুরু করা যাক।’ 

বোঝাই গেলো, ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তিনি। বারবার মোবাইলে ফোনে কল আসছে, কোথাও বেরুবেন যেন। অ্যাপয়েনমেন্ট আছে। ফোনের ওপাশ থেকে তার অবস্থান জানতে চাওয়া হচ্ছে। এরমধ্যেই মিশুর সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের...

আপনার এই যে অর্জন, এই অর্জনটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

এটাকে আমার কাজের ফলাফল বলে মনে হয়। আর আমার ভালো লাগছে এই ভেবে যে, আমার নামের পাশে দেশের নামটা শোভা পাচ্ছে। একটা ইতিবাচক অর্থে দেশের নামটা আসছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটা ছড়িয়ে পড়ছে। আমি দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারছি,এটা অনন্য একটা দিক। এজন্য আরও ভালো লাগছে। এছাড়া আমাদের সমাজে কার্টুনিস্টদের মেইনস্ট্রিম পেশা হিসেবে ধরা হয় না। এই অর্জনের ফলে আমি মনে করি, এটা একটা সামাজিক স্বীকৃতি। যারা এই পেশায় আসতে চায়, এটা তাদের জন্য ইন্সপিরেশন হবে বলে মনে করি।

এই অর্জনের ক্ষেত্রে আপনার কাজের কোন দিকটা ফোর্বস মূল্যায়ন করেছে বলে মনে করেন?

আমি ‘দ্য গ্লোবাল হ্যাপিনেস চ্যালেঞ্জ’ নামে যে সিরিজটা করেছি, সেটাই মনে হয় ওদের ভালো লেগেছে। আমি মনে করি ওই সিরিজটার কারণেই তালিকায় আসতে পেরেছি।

যদি বিস্তারিত বলতেন...

যুদ্ধের বিপরীতের চিত্রটাকে আমি তুলে ধরতে চেয়েছি ছবিতে। যুদ্ধ না থাকলে কী হতো..মানে, দুনিয়াটা কেমন হতো, সমাজটা কেমন হতো, মানুষ কীভাবে থাকতে পারতো, এই বিষয়গুলো আমি তুলে ধরতে চেয়েছি। পৃথিবীতে যুদ্ধ না থাকলে কেমন হতো, মানুষ কতো ভালো থাকতো, সুখি থাকতো সেটাই তুলে ধরেছি। ধ্বংসের বিপরীতে যে শান্তি সেটাই মূল উপজীব্য ছবিগুলোতে। এটাই হয়তো বিচারকদের কাছে ভালো লেগেছে।

মোর্শেদ মিশু

সিরিজে ছবির সংখ্যা তো এখন পর্যন্ত ১১টি। আরও কি আঁকবেন?

আরও ১৯টি ছবি আঁকার ইচ্ছে আছে। ৩০টা ছবি হলে একটা একক প্রদর্শনীর আয়োজন করতে চাই। ২০১৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ছবিগুলো আঁকতে শুরু করেছি। এভাবেই চলতে থাকবে।

ছবি আঁকার এই ধারণাটা কীভাবে পেলেন যে, এভাবেও ছবি আঁকা যায়?

বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুদ্ধের ভয়বহতার ছবি দেখেছি, যুদ্ধ করে মানুষ কীভাবে টিকে আছে তা দেখেছি। এছাড়া আগেও যুদ্ধের ছবির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। এই বিষয়গুলোই আমাকে ছবি আঁকতে উদ্বুদ্ধ করেছে যে, আমি আসলে কী চাই; কী দেখতে চাই;উত্তরও আমি পেয়েছি। আমি আসলে শান্তি দেখতে চাই, দেখতে চাই হাসি মুখ। ছবি এঁকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করলে তা ভাইরাল হয়ে যায়। ৩০টা দেশের প্রায় ৯০টির মতো গণমাধ্যম এই ছবি প্রকাশ করেছে।

আপনার পরবর্তী কাজ সম্পর্কে জানতে চাই..

আমি আরেকটি সিরিজের কাজ শুরু করেছি। বিষয় হলো ‘গড ফরবেড (আল্লাহ না করুক)’। একটা ছবির কাজ শুরু করেছি। হয় না এমন যে, আমরা বলি আল্লায় না করুক…যদি কিছু ঘটে যায়। এরকম একট বিষয় নিয়ে কাজ করছি।

আমরা জানি ফোর্বস নির্বাচিত তরুণদের নিয়ে একটি বিশেষ আয়োজন করবে। আপনি অংশ নেবেন সেই আয়োজনে?

আগামী জুলাই মাসে (১১-১৩) হংকংয়ে একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করছে ফোর্বস। ১০ ক্যাটাগরি থেকে নির্বাচিত ৩০০ তরুণ সেখানে অংশ নেবেন। এটা মূলত নেটওয়ার্কিংয়ের জন্য। আমি চেষ্টা করবো সেখানে আমার কাজগুলোর প্রদর্শন করতে। তাহলে মেসেজটা আরও ছড়িয়ে যাবে। মেসেজটা হলো- যুদ্ধ ব্যয়বহুল, শান্তি সহজলভ্য। যুদ্ধ কখনও শান্তি আনতে পারে না। আমরা শান্তির পথেই থাকি, শান্তির পথেই যেতে চাই।

মিশুর আলোচিত চার কার্টুন

তবে এই অর্জনের রাস্তা সহজ ছিল না মিশুর জন্য। চেয়েছিলেন অন্যকিছু। পেয়েছেন পুরোপুরি ভিন্ন কিছু। জীবনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার, চাওয়া-পাওয়ার অসম সমীকরণের ব্যাপারে মিশু আরও জানান, ছোটবেলায় তিনি চাইতেন জিডি পাইলট হতে। সেটা হতে পারেননি। সেনা বাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। দুই বার আইএসএসবি থেকে বাদ পড়েন। তারপরই তিনি কার্টুনিস্ট হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও তিনি আঁকাআকিটা ছোটবেলা থেকেই করতেন। তার মেজো এই ব্যাপারে তাকে বেশ উৎসাহ দিতেন। মিশুর এই আঁকার হাতেখড়িটাও তার মেজো ভাইয়ের কাছ থেকে। এরপরে ২০১২ সাল থেকে তিনি এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। এই অর্জনে তার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই খুশি বলেও জানান মিশু।

 

 

/এএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ