X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
শিক্ষকের বঞ্চনা: দ্বিতীয় পর্ব

আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও পাননি বেতনভাতা

এস এম আববাস, পাবনা থেকে ফিরে
০৮ মে ২০১৯, ১০:০১আপডেট : ০৮ মে ২০১৯, ২৩:১৩

শিক্ষক আকবর হোসেন ২২ বছরের বঞ্চনা শেষে আদালতের রায়ে শিক্ষকের দায়িত্ব পেলেও বকেয়া বেতন ও অবসর সুবিধা পাননি মো. আকবর হোসেন। শিক্ষকের মর্যাদা ও বেতন-ভাতা হারিয়ে নিবেদিতপ্রাণ এই শিক্ষকের জীবনের স্বাভাবিক গতিপথই বদলে গেছে। ব্রেইন স্ট্রোকের পর তার শারীরিক অবস্থারও অবনতি হয়েছে।

পাবনার চাটমোহর উপজেলার চিকনাই নদীপাড়ের আটলংকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আকবর হোসেনের জীবনের এই করুণ পরিণতি কারণ স্কুল কমিটির স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতি। একালাবাসী ও সহকর্মীরা বলছেন, মৃত্যুর আগে বেতন ও অবসর সুবিধা দিতে না পারলে এই শিক্ষকের প্রতি চরম অবিচার করা হবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (মাধ্যমিক) ড. আবদুল মান্নান বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক আকবর হোসেনের জীবনের মূল্যবান ২২টি বছর ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তার বঞ্চনা, কষ্ট লাঘব করাও কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবো। বেতন ও অবসর ভাতা পাবেন তিনি।’

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, উচ্চ আদালতের রায়ের এক বছর ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও ২২ বছরের বকেয়া বেতন ও অবসরসুবিধা দিতে পারেনি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। মাউশি থেকে বলা হয়েছে, বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। তার ‘বেতন কোড’ অন্য একজন শিক্ষক ব্যবহার করে বেতন তুলছেন। এ কারণে মন্ত্রণালয়ে নির্দেশনার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে ফাইল পাঠানো হয়েছে।

বঞ্চিত এই প্রধান শিক্ষকের বন্ধু ও প্রতিবেশী চিকনাই হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মজিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় থেকে প্রথম আট বছর প্রধান শিক্ষক আকবর হোসেন নিজের অর্থ খরচ করে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। এই সময়ের মধ্যে নিজের তিন বিঘা জমি বিক্রি করেছেন তিনি। বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করাসহ অন্যান্য খরচ জোগাড় করতে স্ত্রীর জমি ও সোনার শেষ গয়না পর্যন্ত বিক্রি করেছেন।’

আকবর হোসেনের স্ত্রী শিউলী বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিজের জমি বিক্রি করেছি চার বিঘা। তাতেও না হলে আমার যে কয় ভরি সোনার গয়না ছিল তা-ও বিক্রি করেছি স্বামীর জন্য। অথচ আমার স্বামীকে কমিটির লোকজন হত্যার হুমকি দিয়েছে। স্কুল থেকে অপমান করে বের করে দিয়েছে।’

আকবর হোসেনের একমাত্র ছেলে শামীম হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাবাকে অন্যয়ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল। মামলা করার পর আদালতের মাধ্যমে চাকরি ফেরত পেলেও ২২ বছর দুই মাস ২০ দিনের বেতন ও অবসর অবসর সুবিধা পাওয়া যায়নি। ব্রেইন স্ট্রোক করার পর থেকে বাবা অস্বাভাবিক জীবন-যাপন করছেন।’

মিথ্যা অভিযোগে বরখাস্ত

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চাটমোহর উপজেলার মূলগ্রামের আকবর হোসেন। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটি শুরুর পর বিনাবেতনে তিনি চাকরি করেন আট বছর। ১৯৯৪ সালের ১ জানুয়ারি প্রধান শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিওভুক্ত হন। সরকারি বেতন-ভাতার অংশ পান এক বছর। এমপিওভুক্তির পরপরই বিদ্যালয়টিতে শুরু হয় দখলদারিত্ব। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ১৯৯৫ সালের ৩০ মে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি আকবর হোসেনকে চাকরিচ্যুত করে। বিদ্যালয় থেকে টেনেহিঁচড়ে তাকে বের করে দেওয়া হয়।

মামলা চলার সময়নতুন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ

বরখাস্ত আদেশের বিরুদ্ধে আকবর হোসেন পাবনার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিট্রেট আদালতে মামলা করেন। এই মামলা নিষ্পত্তির আগেই ১৯৯৬ সালের ২ মার্চ প্রধান শিক্ষককের পদে আফসার আলী নামের এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয় স্কুল কমিটি।

জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি ইমান আলী বিশ্বাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আরবিট্রেশন কমিটি আকবর হোসেনের বরখাস্ত অনুমোদন করার পর শূন্যপদে আফসার আলীকে প্রধান শিক্ষককের পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।’

যদিও মামলা চলার সময় প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ বন্ধ রাখার নির্দেশ ছিলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব সালমা জাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কমিটি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা না মেনেই একের পর প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। কমিটির দুর্নীতির কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে।’

বেআইনি নিয়োগ দেওয়া প্রধান শিক্ষক অবসরে

নতুন প্রধান শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়ার পর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আকবর হোসেনের পক্ষে পাবনার সহকারী জজ আদালতে মামলার রায় হয় ২০০৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ওই রায়ে আকবর হোসেনের চাকরি ফেরত দিয়ে তাকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে পাবনার জেলা জজ বিদ্যালয়ের পক্ষে আপিল করেন নতুন প্রধান শিক্ষক আফসার আলী। আদালত ২০০৬ সালের ২২ নভেম্বর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আকবর হোসেনের পক্ষে রায় দেন। ওই রায়ের পরও তাকে যোগদান করতে দেওয়া হয়নি। ২০০৭ সালের শুরুর দিকে ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেন নতুন প্রধান শিক্ষক আফসার আলী। তবে মামলা নিষ্পত্তির আগেই ২০১১ সালে আফসার আলী অবসরে যান।

মামলা চলার সময় দ্বিতীয় দফায়প্রধান শিক্ষক নিয়োগ

মামলা চলার সময় আবারও অবৈধভাবে ২০১৪ সালের ৮ ডিসেম্বর আটলংকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আজিজুল হককে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয় কমিটি। তখনও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মানেনি স্কুল কমিটি। এই নিয়োগের কয়েকদিন পর ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রায় দেন প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আকবর হোসেনের পক্ষে। তাকে বেতনসহ সার্ভিস রুল অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে বিদ্যালয়ের সভাপতি ইমান আলী বিশ্বাস সুপ্রিম কোর্টে সিভিল রিভিশন দায়ের করেন। ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই রিভিশন খারিজ হয়ে যায়। হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে।

২২ বছর পর একদিনের জন্য প্রধান শিক্ষক

২০১৬ সালের ২৪ জুলাই রিভিশন খারিজ হওয়ায় হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব ফিরে পান আকবর আলী। ততদিনে পেরিয়ে গেছে ২২ বছর। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরও নিজের হাতে প্রতিষ্ঠা করা স্কুলে যোগ দিতে গিয়ে বার বার বাধার মুখে পড়েন তিনি। ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় যোগদানের সুযোগ পান বটে। তবে ওই দিনই ছিল তার চাকরির শেষ দিন।

শিক্ষক যখন মজুর
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির প্রস্তাবে প্রধান শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন সহকারী প্রধান শিক্ষক আজিজুল হক। অবৈধভাবে নিয়োগের পর প্রধান শিক্ষক পদে এমপিওভুক্ত হন। কিন্তু নিয়োগের এক বছর আট মাসের মাথায় চাকরি হারান তিনি। এই পরিস্থিতিতে সংসার বাঁচাতে দিনমজুরের কাজ করতে হচ্ছে তাকে।
আজিজুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমি এখন মজুরের কাজ করি। বয়স হয়েছে। ঠিকমতো কাজ করতে পারি না, তাই শ্রমিকদের সর্দার হয়ে আপাতত কাজ করছি। এছাড়া সংসার চালানোর মতো আমার কোনও উপায় নেই। আমি শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি চাকরি ফেরত পেতে। মামলাও করেছি হাইকোর্টে। কিন্তু টাকা না থাকায় মামলা চালাতে পারছি না।’
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি (বর্তমানে কমিটি স্থগিত) ইমান আলী বিশ্বাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চাকরি হারিয়ে কাজীপুরে দিনমজুরের কাজ করছেন আজিজুল হক।’ মামলা চলাকালে আজিজুল হককে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শূন্যপদের অনুমোদন নিয়ে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।’
অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষককে বিদ্যালয়ে যোগদানে বাধা সৃষ্টির কারণেই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
সভাপতি তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করলেও এলাকাবাসী জানান, প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষককে ঠেকাতে মামলা চলাকালে গোপনে শূন্যপদের অনুমোদন নিয়ে দুইজন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেন সভাপতি।

আরও পড়ুন:

সব হারিয়ে আকবর হোসেন এখন মানসিক ভারসাম্যহীন

 

 

 

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা