X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রকল্পে ৯৬ কোটি টাকা তছরুপ!

এস এম আববাস
২৬ আগস্ট ২০১৯, ০৭:৩১আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০১৯, ১১:০৪

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতর বাস্তবায়নাধীন মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম (আইসিটি ফেজ-২) প্রকল্পে অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে মে ও জুন মাসে এই প্রকল্পের আওতায় বেসিক টিচার ট্রেনিং (বিটিটি), হেড অব ইনস্টিটিউট (এইচআইটি) ও শিক্ষকদের ইন হাউজ ট্রেনিংয়ের নামে প্রায় ৯৬ কোটি টাকা তছরুপ করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে।

মাউশি সূত্রে জানা গেছে, অভিযোগ ওঠার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় মাউশি পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. জাহাঙ্গীর হোসেন এবং সহকারী পরিচালক (প্রকৌশল) আব্দুল খালেক তদন্ত করছেন। তবে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের ওএসডি না করে তদন্তকাজ কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাউশির একাধিক কর্মকর্তা।

তদন্ত কমিটির প্রধান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন,  ‘তদন্ত শুরুর পর মাত্র কয়েকদিন সময় পেয়েছি। তারপর ঈদের ছুটি শুরু হওয়ায় তদন্ত শুরুর পর্যায়েই রয়েছে।’

তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রকল্প পরিচালক ড. অধ্যাপক আব্দুস সবুর খান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অভিযোগ সত্য নয়। তদন্তেই তা জানা যাবে।’ 

অভিযোগ মতে, প্রকল্প পরিচালক সরকারি বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো বিল ভাউচার বানিয়ে তার কয়েকজন সহযোগীর মাধ্যমে হিসাব রক্ষণ অফিস থেকে অর্থ উত্তোলন করেছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ ব্যয় চালানোর ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকের ক্ষমতা এককালীন সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যয় করা হয়েছে ৯৬ কোটি টাকা। হিসাব রক্ষণ অফিসকে ম্যানেজ করে মন্ত্রণালয়ের আদেশ ছাড়াই বিল তুলে নেওয়া হয়েছে। 

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ড. অধ্যাপক আব্দুস সবুর খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিধি অনুযায়ী অর্থ ছাড়া হয়েছে। ৩০ লাখ টাকার কোনও লিমিটেশন নেই। সাড়ে তিন মাসের মধ্যেই ১ লাখ ৬১ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।’

তবে প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবে কোনও মিল পাওয়া যায়নি। অর্থ ছাড়ের নথি অনুযায়ী ৯টি নোটশিটে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ছাড় করা হয়েছে ১৮২ কোটি ৪৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। তবে নোটশিটের যোগফলে উল্লেখ রয়েছে ১৪২ কোটি চার লাখ ৫৩ হাজার। এখানে হিসাবে ৪০ কোটি ৩৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকার কোনও খবরই নেই। তবে জুন মাসের মাসিক প্রতিবেদন (বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ফরম অনুযায়ী) হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত ৯৬ কোটির ছাড় হয়েছে। মাত্র সাড়ে তিন মাসে এক লাখ ৬১ হাজার শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে অর্থ তছরুপ করা হয়েছে।

প্রকল্পের অর্থ ছাড়ের নথিতে একজন সহকারী পরিচালক, একজন উপরিচালক ও প্রকল্প পরিচালকের স্বাক্ষর থাকলেও পত্রজারির কোনও ইস্যু নম্বর, তারিখ বা নথিজাতের উল্লেখ নেই। বিটিটি, এইচআইটিও ইন হাউজ প্রশিক্ষণ কোর্সের বরাদ্দ ৪ থেকে ৫টি অর্থনৈতিক কোডে বিভক্ত থাকলেও নথিতে সব টাকা একই কোডে (৩২৩১৩০১) ছাড় দেখানো হয়েছে। এসব নথি প্রস্তুত করা হয়েছে তদন্ত শুরুর পর। আগের তারিখ দেখিয়ে নথি প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রকল্পের বিল পাঠানো ও পাসের নথিও নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে কোনও উত্তর দেননি প্রকল্প পরিচালক ড. সবুর খান।

জানা গেছে, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো সংশ্লিষ্ট হিসাব রক্ষণ অফিস থেকে বিল পাস করে মৌখিক নির্দেশনা অনুযায়ী প্রকল্প কার্যালয়ে টাকা পাঠানো হয়। প্রতিটি প্রশিক্ষণ কোর্সের কো-অর্ডিনেটর এবং প্রধান অতিথির সম্মানীর টাকা এবং অন্যান্য খাতের টাকা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নিয়ে প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট সহযোগীরা ভাগবাটোয়ারা করেন। প্রশিক্ষণে প্রধান অতিথিদের কারও অংশ নেওয়ার সুযোগ ছিল না। দেশের ৩৬ জেলার ১০০ উপজেলা এবং প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে যাওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। অথচ প্রতিটি অনুষ্ঠানেই তাদের উপস্থিতি দেখিয়ে ভাতা নেওয়া হয়েছে।

মাউশি সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম তদারকি করার জন্য কেন্দ্রীয়, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে মনিটরিং কমিটি এবং প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে মেন্টরিং কমিটি করার কথা থাকলেও কোনও কমিটি হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রশিক্ষণার্থীদের ডাটাবেজের সংস্থান থাকলেও তা করা হয়নি। ফলে প্রকৃতপক্ষে কতজন শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাও জানার পথ নেই। 

সরকারি বিধি অনুযায়ী প্রকল্প পরিচালক বছরে সরাসরি ১০ লাখ টাকা এবং কোটেশনে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে পারেন। অথচ এই প্রকল্পে গত অর্থবছরে সরাসরি এবং কোটেশনে প্রায় ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। বিটিটি এবং এইচআইটি কোর্সের ম্যানুয়াল এবং সনদ ছাপানো বাবদ বরাদ্দ ৩৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কোনও টেন্ডার কোটেশন ছাড়াই এ টাকার একটি বড় অংশ ব্যয় করা হয়েছে। 

টেন্ডার কমিটিতে মাউশির কোনও প্রতিনিধি রাখা হয়নি। অথচ ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজালের (ডিপিপি) অর্গানোগ্রাম না মেনে মাউশি পরিচালকের (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) স্বাক্ষর ছাড়াই সরাসরি মহাপরিচালকের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। কেনা দ্রব্যের স্টক এন্ট্রি করা হয়নি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে দ্রব্যসামগ্রীর ডেলিভারি চালান বা রিসিভ করার কোনও ডকুমেন্ট নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ড. অধ্যাপক আব্দুস সবুর খান বলেন, ‘সব ক্ষেত্রে পরিচালক পরিকল্পনার স্বাক্ষর নেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পরিচালকের স্বাক্ষর নিতে হবে।’ 

মাউশি সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে অর্থ লোপাটে দরপত্রে সিন্ডিকেট করে ৩৫ হাজার টাকা মূল্যের মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দে কেনার প্রস্তাব দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রস্তাবে ওই সময় সম্মত না হওয়ায় মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে প্রকল্প পরিচালককে ২০১৮ সালের জুনে অপসারণ করা হয়। 

এরপর প্রকল্প কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান ড. অধ্যাপক আব্দুস সবুর খান। নিয়োগের পর থেকেই সরকারি আর্থিক বিধিবিধান অমান্য করে লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টি করেন বলে অভিযোগ ওঠে। 

এই দুর্নীতির বিষয়ে মন্ত্রণালয় কী পদক্ষেপ নেবে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. অরুণা বিশ্বাস বলেন, ‘মাউশি তদন্ত করে যে সুপারিশ দেবে তার ভিত্তিতেই মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে।’

উল্লেখ্য, প্রকল্পের আওতায় ৪৬ হাজার ৫৫০টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, দুই হাজার ১২০টি স্মার্ট ক্লাসরুম এবং ৫৬৭টি মাল্টিমিডিয়া কনফারেন্স রুম স্থাপন করা হবে। এজন্য প্রায় ৫০ হাজার মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর এবং সমসংখ্যক ল্যাপটপ কিনতে হবে। প্রায় ৮০০ কোটি টাকার এ কেনাকাটায় সিন্ডিকেট করে বড় একটা অংশ লুটপাট করার প্রচেষ্টা চালানো হয়।

আরও পড়ুন:  চালু হয়নি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, ফেরত গেছে ২২০ কোটি টাকা 

/এফএস/ টিএন/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?