ফৌজদারি মামলায় আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণের আগে দায়িত্বপালনরত অবস্থায় সরকারি চাকরিজীবীদের গ্রেফতার করতেকর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার বিধান রেখে কার্যকর করা হচ্ছে ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে গত বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) এই সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ১ অক্টোবর থেকে এই আইন কার্যকর করার কথাও বলা হয়েছে এই প্রজ্ঞাপনে।
গত ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’-এর গেজেট প্রকাশিত হলেও এতদিন আইনটি কার্যকর করা যায়নি। আইনটি কার্যকর করার প্রশ্নে বিভিন্ন মহলের আপত্তি থাকায় এতদিন কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়নি সরকার। কারণ, এর আগে ২০১৩ সালে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি দায়িত্ব পালনকালে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা হলে সরকারের অনুমতি বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গ্রেফতার করা যাবে না—এমন বিধান রেখে দুদক আইন সংশোধন বিল জাতীয় সংসদে পাস হলে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করার অভিযোগ ওঠে। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত দুদক আইনের এই বিলের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে একটি মানবাধিকার সংগঠন। এর পরপর ২০১৫ সালের ৩০ জানুয়ারি আদালতের রায়ে দুদক আইনের সংশোধনীটি বাতিলের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। আবারও সরকার এই বিধান রেখে ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’পাস করে।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘কাউকে ছাড় দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। প্রশাসনের কাজে গতিশীলতা আনতে এই আইনটি কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া যে কেউ অপরাধ করলে তাকে সাজা পেতেই হবে। এতে কোনও ছাড় নেই। সরকার সর্বত্র সুশাসন নিশ্চিত করতে চায়। সে ক্ষেত্রে এ আইনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘প্রশাসনের যে কেউ যে কোনও অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করার বিধান তো থাকছেই। দেশের প্রচলিত আদালতেই সে বিচার সম্ভব। কাজেই নতুন এই আইনটি সেক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হবে না।’
এ প্রসঙ্গে এক প্রতিক্রিয়ায় সাবেক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘সরকার বা প্রশাসনের সবাই অপরাধ করেন না। যারা করে তারা সংখ্যায় খুবই কম। সে ক্ষেত্রে এই কম সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে রক্ষা করার জন্য সবাইকে এক পাল্লায় তুলে সবার জন্য এই আইন করা ভালো নয়। এটা লজ্জারও বিষয় বলে আমি মনে করি। ’
আলী ইমাম মজুমদার আরও বলেন, ‘অপরাধী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অপরাধের ধরন অনুযায়ী মামলা হবে, আর মামলা দায়েরের পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে, এটাই তো স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে অপরাধী কর্মচারী বা কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের প্রয়োজন হলে অনুমতি পাওয়াটা সময় সাপেক্ষ বিষয়। অপরাধীর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি যদি বিলম্বিত হয়, তবে তা প্রশাসনে কীভাবে গতি বাড়াবে?’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘এ আইনের ফলে একজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সুরক্ষা দেওয়া হলো বটে। তবে, এ ধরনের সুরক্ষা তো আমরা সবাই চাই না। কারণ আমরা সততার সঙ্গে চাকরি করি। কাজেই আমাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হওয়ার আশঙ্কা কম। সরকারি চাকরি আইন মেনে অপরাধী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতার করতে হলে অনুমতি আনতে সময় লাগবে। এই সময়ের মধ্যে চাইলে অপরাধী কর্মকর্তা-কর্মচারী পালিয়ে যাওয়ারও সুযোগ নিতে পারে। ফলে আইনের এই ধারায় হয়তো কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড় পাবেন। তাতে অধিকাংশ সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী তেমন কোনও সুবিধা পাবেন না।’
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর সরকারি চাকরি আইনের গেজেট জারি করা হয়। এই আইনে কোনও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সরকারি দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অভিযোগে দায়ের করা ফৌজদারি মামলায় আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণের আগে ওই কর্মচারীকে গ্রেফতার করতে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার বিধান রাখা হয়। আইনে আরও বলা হয়েছে, যে-কোনও সরকারি কর্মবর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেশের যে-কোনও আদালতে ফৌজদারি মামলা থাকলেও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
আইনের ৪২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনও সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড বা এক বছর মেয়াদের বেশি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে রায়ের দিন থেকে তাৎক্ষণিক বরখাস্ত হবেন। তবে, রাষ্ট্রপতির কাছে সন্তোষজনক মনে হলে তিনি সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি কিংবা চাকরিতে পুনর্বহাল করার বিধানও রাখা হয়েছে।
এক বছর বা তার কম মেয়াদের জন্য দণ্ডিত হলে কর্তৃপক্ষ ওই ব্যক্তিকে তিরষ্কার, পদোন্নতি ও বেতন স্থগিত করা, পদ ও বেতন স্কেলের অবনমন করা এবং সরকারি সম্পদের ক্ষতি হয়ে থাকলে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবে।
আইনের ৩২ ধারায় বলা আছে, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ দোষী সাব্যস্ত যে-কোনও কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে লঘু দণ্ড হিসেবে তিরষ্কার, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি ও বেতন-ভাতা স্থগিত করা, বেতন স্কেল অবনমিত করা এবং সরকারি অর্থ ও সম্পত্তির ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ আদায় করা ও গুরুদণ্ড হিসেবে বেতন নিম্ন স্কেলে অবনমিত করা, বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি হতে অপসারণ কিংবা বরখাস্ত করার বিধান রাখা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, একবার কোনও কর্মকর্তা কর্মচারি কেউ বরখাস্ত হলে পরবর্তী সময়ে তাকে প্রজাতন্ত্রের কোনও কাজে বা রাষ্ট্রের অন্য কোনও কর্তৃপক্ষে নিয়োগ না দেওয়ারও বিধান রাখা হয়েছে।