X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাগরে নৈরাজ্য: ৬৭ হাজার ফিশ বোটের মধ্যে নিবন্ধিত সাত হাজার

আমানুর রহমান রনি
১১ অক্টোবর ২০১৯, ১২:২১আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০১৯, ১২:৩৫

সাগরে মাছ ধরার নৌকা সাগরে মাছ শিকারের জন্য যান্ত্রিক যান বা বোটের অনুমতি ও লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও তা নিচ্ছে না কেউ। যে যার ইচ্ছে মতো সাগরে মাছ ধরছে। বিভিন্ন দফতরের সমন্বয়হীনতার কারণে সাগরে ৬৭ হাজারের বেশি যান্ত্রিক বোটের মধ্যে মাত্র সাত হাজার বোটের মাছ শিকারের লাইসেন্স রয়েছে। বাকিরা অনুমোদন ছাড়াই বছরের পর বছর মাছ শিকার করছে। এতে করে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনই সাগরের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে একটি সিন্ডিকেটের আওতায়। বোট মালিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এজন্য পরস্পরকে দায়ী করেছেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলাভিত্তিক বোট মালিক সমিতির শক্তিশালী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দেশের সমুদ্রসীমার মৎস্যসম্পদ। তারা সরকারি নিয়ম অমান্য করে বছরের পর বছর সাগরে মাছ শিকার করে আসছে।  সাগরে কী পরিমাণ ট্রলার মাছ শিকার করছে, তার কোনও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। লাইসেন্স নিয়ে সাগরে মাছ শিকারের আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানছে না কেই। নিজেদের ইচ্ছে মতো যান্ত্রিক নৌযান তৈরি করে উপকূলের মানুষেরা সাগরে মাছ শিকার করে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ৬৭ হাজার যান্ত্রিক ট্রলারের (ফিশ বোট) মধ্যে মাত্র সাত হাজারের লাইসেন্স রয়েছে। নিয়ম অনুসরণ করে লাইসেন্স না নেওয়ায় সাগরে জেলেরা যেমন ঝুঁকিতে থাকে, তেমনই সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে। তবে ট্রলার মালিকদের অভিযোগ— স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠন ও সমিতির দৌরাত্ম্যে এবং লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়ায় তিনটি মন্ত্রণালয়ের অধীন তিন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেওয়ার জটিলতার কারণে লাইসেন্স নিতে চান না মালিকরা।

সাগরে মাছ শিকার করে কত ট্রলার

সাগরে মাছ শিকারের জন্য কত ট্রলার বা ফিশ বোট রয়েছে তার সঠিক কোনও পরিসংখ্যান সরকারি বা বেসরকারি কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সমুদ্র সীমানায় দুই ধরনের ট্রলার বা বোট মাছ শিকার করে,একটি কাঠের তৈরি সাধারণ ট্রলার এবং অন্যটি আধুনিক বাণিজ্যিক বোট। ২০০৯/১০ সালে সামুদ্রিক মৎস্য দফতর, নৌ-পরিবহন অধিদফতর, জেলা প্রশাসন ও স্থানীয়দের নিয়ে একটি জরিপ করা হয়েছিল। প্রায় ৯ বছর আগের করা ওই জরিপে সাগরে সাধারণ কাঠের তৈরি ৬৭ হাজার ফিশ বোট গণনা করা হয়। তবে অযান্ত্রিক আরও অসংখ্য নৌযান রয়েছে। এগুলোও সাগর তীরবর্তী বা ১০ মিটার গভীরতার মধ্যে মাছ শিকার করে থাকে।

চট্টগ্রামের সামুদ্রিক মৎস্য দফতরের সহকারী পরিচালক নাজিম উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সারাদেশে ৬৭ হাজার যান্ত্রিক ছোট কাঠের ট্রলার মাছ শিকার করতে সাগরে যায়। এই ট্রলারগুলোকে আমরা আর্টিসান ট্রলার বলে থাকি। এদের মধ্যে আমাদের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়া আছে মাত্র সাত হাজার ট্রলারের। বাকিগুলোর লাইসেন্স নাই। তারা লাইসেন্স ছাড়াই সাগরে মাছ শিকার করতে যায়।’

তিনি বলেন, ‘নৌ বাণিজ্য অধিদফতর ট্রলারের ফিটনেস দেখে লাইসেন্স দেওয়ার অনুমতির জন্য আমাদের কাছে সুপারিশ করে।  এরপর আমরা লাইসেন্স দেই। তবে মূল কাজটা নৌ বাণিজ্য অধিদফতর করে।’

নাজিম উদ্দিন জানান, সাগরে লাইসেন্স-বিহীন মাছের ট্রলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও সংস্থাটির কিছু করার নেই। মূলত কোস্টগার্ড সমুদ্রে কাজ করে। তবে  জনবল সংকটের কারণে বিশাল সমুদ্রসীমার মধ্যে হাজার হাজার ট্রলারের বিরুদ্ধে তারাও ব্যবস্থা নিতে পারে না।

লাইসেন্স দেওয়া হয় যেভাবে

বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, সাগরে মাছ শিকারের জন্য দুই ধরনের যান্ত্রিক বোট আছে। এর একটি হলো কাঠের তৈরি সাধারণ বোট এবং অন্যটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল বোট। ইন্ডাস্ট্রিয়াল বোট সরকারের অনুমোদন নিয়ে আনতে হয়। এগুলো গভীর সাগরে মাছ শিকার করে। বাংলাদেশে এধরনের ২৫৫টি বোট রয়েছে। তবে কাঠের তৈরি ট্রলার রয়েছে ৬৭ হাজারের বেশি। সাগরে যেকোনও যান্ত্রিক যানের ফিটনেস সনদ দেয়  নৌ-পরিবহন অধিদফতর। সেই নিয়ম অনুযায়ী মাছের ট্রলার বা বোটেরও ফিটনেস দেখে এই সংস্থাটি। ফিটনেস দেখার পর বোট তৈরিতে মোট খরচের ১৫ শতাংশ হারে সরকারকে ভ্যাট দিয়ে ফিটনেস সনদ নিতে হয়। সমুদ্র নৌ-পরিবহন অধিদফতরের ফিটনেস সনদ নেওয়ার পর সমুদ্র মৎস্য দফতরের লাইসেন্সের জন্য নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে আবেদন করতে হয়। এক্ষেত্রে বোটের ওজন বহনের ওপর লাইসেন্সের ফি কম বেশি হয়ে থাকে। এক  থেকে ১০ টন ওজনবাহী বোটের জন্য ১৫শ’ টাকা ফি এবং ২২৫ টাকা ভ্যাট দিতে হয়। ১০ থেকে ২৫ টন বোটের জন্য ৩ হাজার টাকা ফি এবং ৫৫০ টাকা ভ্যাট, ২৫ থেকে ৪০ টন ওজনবাহী মাছের বোটের জন্য ৫ হাজার টাকা ফি এবং ৭৫০ টাকা ভ্যাট জমা দিতে হয়। এরপর সব কাগজপত্র ঠিক থাকলে সমুদ্রে মাছ শিকারের সনদ বা লাইসেন্স পেয়ে থাকেন বোট মালিকরা। অভিযোগ আছে, বোট মালিকরা এসব প্রক্রিয়া কেউ অনুসরণ করেন না। লাইসেন্সের ধার ধারেন না সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলার বা বোট মালিকদের অনেকে। নিজেদের ইচ্ছে মতো ট্রলার বা বোট তৈরি করে কোনও অনুমতি ছাড়াই সাগরে মাছ শিকারে যান তারা। যেসব দফতর ও অধিদফতর ট্রলারের লাইসেন্স দেয়, সাগরে তাদের কোনও নজরদারি নেই। জানা গেছে,সাগরে অনুমোদনহীন নৌযান দেখভাল করে থাকে কোস্টগার্ড। তবে তাদেরও জনবল কম থাকায় এসব ট্রলারের ওপরে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই বলে দাবি  সংশ্লিষ্টদের।

চট্টগ্রামের নৌ-পরিবহন অধিদফতরের মার্কেন্টাইল মেরিন অফিসের নৌ সার্ভেয়ার শেখ মো. জালাল উদ্দিন গাজী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা নৌ-যানের ফিটনেস দিয়ে থাকি। কেউ একটি নৌ-যান তৈরি করলে সেটির ব্যবহারের ধরন অনুযায়ী ফিটনেস দেখা হয়। মাছ শিকারে সাগরে যাওয়া বোটেরও ফিটনেস আমরা দিয়ে থাকি। তবে অসংখ্য ফিটনেসবিহীন বোট সাগরে চলাচল করে। সেগুলোর জন্য আমাদের কাছ থেকে কোনও ফিটনেস সনদ নেওয়া হয়নি। এগুলো দেখার দায়িত্ব কোস্ট গার্ডের। সাগরে গিয়ে আমাদের চেক করার সুযোগ নেই।’

ক্যাম্পেইন করা হলেও সারা মেলে না বোট মালিকদের

সাগরে মাছ শিকারে যাওয়া ট্রলার বা বোটের নিবন্ধনের জন্য বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন অধিদফতর, সামুদ্রিক মৎস্য দফতর, জাতীয় রাজস্ব বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে বছরে দুবার উপকূলীয় জেলাগুলোতে সপ্তাহ ও মাসব্যাপী ক্যাম্পেইন করা হয়। তবে এসব ক্যাম্পেইনের সময়ও বোট মালিকরা তাদের লাইসেন্স বা নিবন্ধন করেন না।  মালিকদের দাবি, নিবন্ধন ছাড়া সাগরে মাছ শিকারে কোনও সমস্যা হয় না। পটুয়াখালীর মহিপুর ফিসিং বোট সমবায় মালিক সমিতির সভাপতি মো. দেলোয়ার গাজী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটা বোট বানাতে অনেক টাকা ব্যয় হয়। জেলা শহরে নিবন্ধন করার কোনও সুযোগ নেই। এজন্য খুলনা অথবা চট্টগ্রামে যেতে হয়। এছাড়া,এখন ভ্যাট দিতে হয় অনেক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেনা করে ট্রলার বা বোট তৈরি করা হয়। এরপর এত  টাকা দিয়ে লাইসেন্স নেওয়া সম্ভব না। তাই অনেকেই লাইসেন্স ছাড়া বোট নিয়ে সাগরে যান।’

তিনি বলেন, ‘লাইসেন্স ছাড়া মাছ ধরতে গেলে মাঝেমাঝে কোস্ট গার্ড আটক করে। তবে তারা লাইসেন্স করার নির্দেশসহ সামান্য শাস্তি (জরিমানা) দিয়ে ছেড়ে দেয়।’

সিন্ডিকেটের কারণে নিবন্ধন হয় না

স্থলে যেমন পরিবহন মালিকদের সিন্ডিকেট রয়েছে, সাগরেও তেমনই একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। পটুয়াখালী, খুলনা, কক্সবাজার, মংলা, চট্টগ্রাম, বরগুনা ও ভোলায় এসব সিন্ডিকেটের প্রভাবে মাছের ট্রলার মালিকরা নিবন্ধন করতে আগ্রহী হন না। মৎস্য অধিদফতরের সূত্র জানায়, বোট মালিক ও জেলেদের বিভিন্ন সংগঠনের কারণে নিবন্ধনের বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করা যায় না। চট্টগ্রাম ও ভোলাতে বোট মালিকদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে।

আন্তর্জাতিক আদালতে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় বর্তমানে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার টেরিটোরিয়াল সমুদ্র ও ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে বাংলাদেশের। তবে গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করার জন্য তেমন কোনও বোট নেই দেশে। গভীর সমুদ্রের বিশাল অংশে কখনও দেশের জেলেরা মাছ শিকার করতে যান না।

/এপিএইচ/

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়