X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

৫৩ বছরে কপিরাইট নিবন্ধন হয়েছে মাত্র ২০ হাজার!

উদিসা ইসলাম
২৫ জুন ২০২০, ১২:০০আপডেট : ২৫ জুন ২০২০, ২৩:১০

৫৩ বছরে কপিরাইট নিবন্ধন হয়েছে মাত্র ২০ হাজার! ১৯৬৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মেধাসম্পদের মালিকানা নিবন্ধন শুরুর পর থেকে খুব নগণ্য পরিমাণ সৃষ্টি নিবন্ধন করানো হয়েছে। কপিরাইট অফিস মনে করে, বই, সংগীত, চলচ্চিত্র কিংবা অন্য কোনও ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির স্বত্ব পেতে নিবন্ধনের বিষয়টিতে সচেতন নন কেউ। বইয়ের ক্ষেত্রে লেখকের সঙ্গে যথাযথ চুক্তি না থাকায় নিবন্ধনের বিষয়টি এড়িয়ে যান প্রকাশকরা। আর প্রকাশকরা বলছেন, নিবন্ধনের ক্ষেত্রে দুইদিকের গাফিলতি আছে। নিবন্ধন কেন জরুরি, বেশির ভাগ সৃষ্টিশীল মানুষের কাছে সেই বিষয়টিই স্পষ্ট নয়। আবার কোনও কোনও প্রকাশক মনে করেন, বইয়ের স্বত্ব লেখকের হলে সেই নিবন্ধন প্রকাশক কেন করবে? সবমিলিয়ে বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে। কিন্তু আগামীর জন্য বিষয়টি মোটেও সুখকর নয়। যার নজির হিসেবে দেখা গেলো, সম্প্রতি ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের স্বত্ব নিয়ে আদালতের মুখোমুখি হতে হয় লেখক-প্রকাশককে।  

কী পরিমাণ বই নিবন্ধন হয়?

মেধাসম্পদ বিষয়ে কপিরাইট অফিসের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিতে বলা আছে, সৃজনশীল ব্যক্তি তার মেধা প্রয়োগ করে যা কিছু সৃজন করেন তাই মেধাসম্পদ। মেধাসম্পদের মালিকানা নিবন্ধনের লক্ষ্যে কপিরাইট অফিস ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কাজ শুরু করে ১৯৬৭ সালে। কপিরাইট অফিস একটি আধা-বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ২০ হাজার ৩২১টি কপিরাইট নিবন্ধন হয়েছে। বইমেলায় যে বই প্রকাশিত হয় তার শতকরা ১ ভাগেরও কপিরাইট নিবন্ধন হয় না।

কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, ‘বার্ন কনভেনশন অনুযায়ী কপিরাইট বাধ্যতামূলক না, কিন্তু আমাদের আইনে মেধাস্বত্বের সুরক্ষা দেওয়া আছে। লেখক-প্রকাশক নিজেদের নিরাপত্তায় সেটি ব্যবহার করুন তা আমরা চাই। সাহিত্য এবং শিল্পবিষয়ক কর্মের সুরক্ষার জন্য দি বার্ন কনভেনশন হলো ১৮৮৬ সালের একটি কপিরাইট সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি যা সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে প্রথম গৃহীত হয়েছিল।’

কী বলছে বাংলা একাডেমি

বারবার তাগাদা দেওয়ার পরেও প্রকাশক ও লেখকের মধ্যে আস্থার সংকটের কারণে চুক্তি হয় না বা কপিরাইটের ঝামেলার মধ্যে তারা যেতে চান না উল্লেখ করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বারবার করে প্রকাশক-লেখককে বলা হয়, বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে বলার পরেও কপিরাইট নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মেলায় বইয়ের ক্ষেত্রে আইএসবিএন নম্বর বাধ্যতামূলক করা আছে। ১৩ ডিজিটের এই নম্বর থাকলেই কিন্তু আপনার তথ্যগুলো সব এক জায়গায় থাকার কথা। সেটির আসলে কী অবস্থা আমরা সঠিকভাবে বলতে পারবো না। একেবারেই সফল হবো না, তা আমরা মনে করি না। ঠেকে শিখতে শিখতে আমরা উদ্ধারের পথ খুঁজে নিই। লেখকদের ভেতরে এক ধরনের দুর্বলতা কাজ করে। তারা মনে করেন, চুক্তির বা রয়্যালটির কথা বললে প্রকাশক যদি বই না ছাপেন; বা প্রকাশ করতে দেরি করেন। আবার যে লেখকরা নিজের টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করেন তারা মনে করেন, যদি প্রকাশক টাকাটা ফেরত না দেন। আর এই এতগুলো যদি-কেন্দ্রিক দুর্বলতার সুযোগ নেন প্রকাশকরা।

অভিযোগও নেই

কপিরাইটের বা মেধাস্বত্ব নিতে হবে এই সচেতনতা যেমন নেই, তেমনি সৃষ্টি কেউ দখল করে নিলে তা রুখে দিতে লড়াইয়ের উদাহরণও খুব কম। গত দুই বছরে এ বিষয়ে ৩৮টি অভিযোগ হয়েছে। এর ২১টি নিষ্পত্তিও হয়ে গেছে।

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন মনে করেন, নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতার ব্যাপার না থাকাটা প্রকাশককে সুযোগ করে দেয়। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি আপনার সৃষ্টির নিবন্ধন না করেন তাহলে তো আপনাকে কেউ ধরতে আসবে না। আমাদের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, বই প্রকাশের পরে কোনও এক সময়ে সেটি জমা দিয়ে আসা। এই কাজটি সঙ্গে সঙ্গে করা হয় না বললেই চলে। কপিরাইট অফিসের সঙ্গে প্রকাশকের নিয়মিত যোগাযোগ তৈরি হয়নি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রেজিস্ট্রার এসেছেন, একেকজন একেক রকমভাবে বিষয়টি পরিচালনা করেছেন।’

মাহরুখ মনে করেন, নিবন্ধন প্রকাশকদের জন্য কতটা লাভজনক সেটি তাদের অবহিত করা দরকার। তিনি বলেন, ‘প্রকাশকরা নিবন্ধনটি দায়িত্ব নিয়ে কেন করবেন সে বিষয়েও জানার আছে। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কপিরাইট আইন কেমন হওয়া উচিত সেটা নিয়েও বিস্তর আলোচনার সুযোগ আছে। এই আইন মানতে গিয়ে নিজেদের জ্ঞানচর্চাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছি কিনা, সেটিও বিবেচনা করে দরকার হলে নতুন করে আইন করতে হবে, যাতে লেখক প্রকাশকের মধ্যে চমৎকার একটি বোঝাপড়া দাঁড় করানো যায়। এসব নিয়ে যথাযথ আলোচনা দেখি না। আমি মনে করি নিবন্ধন না হওয়ার পেছনে সব পক্ষের সমান গাফিলতি আছে।’

আইনে কী বলা আছে

আইনের অধ্যায় ১০-এর কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন অংশে বলা আছে, ‘কোনও কর্মের প্রণেতা, প্রকাশক বা কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী বা সেই সৃষ্টিতে স্বার্থ আছে এমন ব্যক্তি কপিরাইটের রেজিস্টারে বিষয়টির বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করবার জন্য রেজিস্ট্রারের কাছে নির্ধারিত ফরমে এবং নির্ধারিত ফি দিয়ে দরখাস্ত করতে পারবেন। উপরোল্লিখিত কোনও বিষয়ে দরখাস্ত পেলে রেজিস্ট্রার, তার বিবেচনায় উপযুক্ত তদন্ত করে বিষয়টির বিবরণ কপিরাইটের রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করবেন এবং নিবন্ধনের একটি সনদপত্র দরখাস্তকারীকে দেবেন।’

কেন হয় না রেজিস্ট্রেশন?

নিজের সৃষ্টি/সৃজনশীলতার অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে লেখকদের অসচেতনতা নিবন্ধন না করার অন্যতম কারণ। সম্প্রতি ‘মাসুদ রানা’র গ্রন্থস্বত্ব নিয়ে এতদিন পর হওয়া দ্বন্দ্বকে উদাহরণ হিসেবে সামনে এনে মাহারুখ বলেন, ‘শুরুতে যদি আনোয়ার সাহেব লেখক ও প্রকাশকের মধ্যকার চুক্তি নিশ্চিত করে কপিরাইট নিয়ে রাখতেন তাহলে তার আবিষ্কার তারই থাকতো। কপিরাইট নেওয়াটা বাধ্যবাধকতা হিসেবে না থাকায় সমস্যাটা হচ্ছে। নিবন্ধনও খুব সোজা–অনলাইন/অফলাইন উভয়ভাবেই সামান্য ফির বিনিময়ে করা যায়। কিন্তু এটি করা জরুরি কেউই মনে করেন না। বইয়ের ক্ষেত্রে স্বত্ব লেখকের হলে আবেদন কে করবেন, লেখক না প্রকাশক– এ ধরনের বিতর্ক করে এড়িয়ে যাওয়া হয়। যদিও প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বই যখন প্রকাশনায় যাচ্ছে তখন স্বত্ব যারই হোক আবেদন প্রকাশকেরই করার কথা।’

অনুপম প্রকাশনীর মিলন কান্তি মনে করেন, বইয়ের স্বত্বে যদি লেখকের নাম থাকে তাহলে কপিরাইটের আবেদন লেখকেরই করা উচিত। এই বাড়তি ঝামেলা প্রকাশকের ঘাড়ে না চাপানোর পক্ষে তিনি। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের গ্রন্থকেন্দ্রে বই জমা দিতে বলা হয়। আমরা দিই। যা যা নিয়ম আছে মেনে চলি। সেখান থেকে তথ্য এক জায়গায় রেখে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করলেই তো হয়।’

প্রকাশিত সব বইতেই স্বত্ব বিষয়ে লেখক বা প্রকাশকের নাম থাকে, নিবন্ধন না করে শুধু শুধু এটি লেখা যায় কিনা, প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছে করলেই মুখে মুখে এটি লেখা যায় না। অন্তত যদি লেখক বা প্রকাশক দায়িত্বশীল হন।’

কপিরাইট আদালত হবে?

এ বিষয়ে কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার বলেন, ‘আমাদের বর্তমান আইনে আলাদা আদালতের কোনও ব্যবস্থা নেই। পৃথিবীর নানা দেশে আইপি কোর্ট আছে, কিন্তু আমাদের এখানে এখনই দরকার আছে বলে আমি মনে করছি না। এখানে তিনটি ধাপে অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়। প্রথমে কপিরাইট রেজিস্ট্রারের কাছে অভিযোগ আসে। তিনি যথাযথ শুনানি শেষে সিদ্ধান্ত দেন। এরপর আপিল নিয়ে যেকোনও পক্ষ কপিরাইট বোর্ডের কাছে যান এবং সেখানে যে আদেশ দেওয়া হয় সেখানেও সন্তুষ্ট না হলে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হওয়া যাবে।’

/এমএএ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!