X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

কর্মীদের স্বর্ণ চোরাচালান: দণ্ডের ঝুঁকিতে বিমান!

চৌধুরী আকবর হোসেন
০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ২০:১৪আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ২২:২০

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বর্ণ চোরাচালানের দায় মাথায় নিয়ে দণ্ডের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স বাংলাদেশ বিমান। বিমানবন্দরে আটক হওয়া অবৈধ স্বর্ণের একটি বড় অংশ উদ্ধার হয় বিমানের ভেতর থেকে। বিমানের টয়লেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে স্বর্ণ উদ্ধার হলেও এসব ঘটনায় কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বিমান কর্তৃপক্ষ। এসব ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণসহ বিমানের কর্মীদের আটক করেছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। প্রমাণ মিলেছে এসব চোরাচালানে বিমানের কর্মীদের সম্পৃক্ততার। তাই এবার বিমানের কর্মীদের চোরাচালানের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে ঢাকা কাস্টম হাউজ। কর্মীদের নির্দোষ প্রমাণে ব্যর্থ হলে নিজেই অর্থদণ্ডের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ বিমান।
ঢাকা কাস্টম হাউজ সূত্র জানায়, গত বছর ১৭ ডিসেম্বর  ঢাকা কাস্টমস হাউজের কমিশনার লুৎফর রহমান বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে একটি নোটিশ পাঠান। স্বর্ণ চোরাচালানে বিমানের কর্মীরা সম্পৃক্ত রয়েছে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা বিমানের একটি ফ্লাইটের টয়লেটসহ বিভিন্ন স্থানের স্ক্রু খুলে ৬২.৩৭ কেজি স্বর্ণ ও ৩৯৭ গ্রাম স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়। যাত্রী নামানোর পর বিমানের বিশেষ বিশেষ স্থান থেকে স্বর্ণ উদ্ধার হওয়ায় এই চোরাচালানের সঙ্গে  বাংলাদেশ বিমানের কর্মীরা জড়িত বলে মনে করছে কাস্টম হাউজ।
বিমান কর্তৃপক্ষকে এ ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের নামের তালিকাসহ ১৫ দিনের মধ্যে নোটিশের জবাব  দিতে বলে কাস্টম হাউজ। একই সঙ্গে, যদি বিমান দোষীদের তালিকা দিতে এবং কর্মীদের নির্দোষ প্রমাণে ব্যর্থ হয় তাহলে কেন বাংলাদেশ বিমানের ওপর অর্থদণ্ড আরোপ করা হবে না তারও জবাব দিতে বলা হয় নোটিশে। জবাব দিতে ব্যর্থ বলে মামলার গুনাগুনের ভিত্তিতে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিষ্পত্তি করা হবে বলেও নোটিশে জানানো হয়।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বিমানের ওই ফ্লাইটে স্বর্ণ উদ্ধারের আগে বিমানটি যাত্রি নামানো শেষে হ্যাঙ্গারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেসময় শুল্ক গোয়েন্দারা হ্যাঙ্গারে নেওয়ার চেষ্টা বন্ধ করে তল্লাশি করতে বিমানের ভেতরে প্রবেশ করেন। দুইবার তল্লাশি করেও দৃশ্যমান স্থানে কোনও স্বর্ণ পাওয়া যায়নি। গোপন তথ্য থাকায় শুল্ক গোয়েন্দারা বিমানের বিভিন্ন টয়লেটে তল্লাশি চালান। টয়লেটের মিরর কেবিনেটের ভেতর টয়লেট টিস্যু রাখার প্যানেলের স্ক্রু খুলে সেখানে স্বর্ণ পান। এছাড়াও টয়লেটের বেসিনের নিচের চেম্বার খুলে ওয়াটার হিটারের কাছে ও একটি প্যানেল  খুলে স্বর্ণ পাওয়া যায়। একটি হোলের ভেতরে কার্গো হোল সংশ্লিষ্ট প্যানেল বরাবর প্রবেশ করানো কালো রঙ এর দড়িতে বাধা অবস্থায় দুটি খাতাতেও (কালো রংয়ের কাপড়ের মধ্যে সাদা রংয়ের সুতা দিয়ে সেলাই করা যা সাধারণত চোরাকারবারিরা খাতা নামে ডাকে) স্বর্ণ পাওয়া যায়।

এছাড়াও একই বিমানের মাঝ বরাবর যাত্রীদের বসার স্থানে সর্বশেষ সিটের পেছনে রাখা লাইফ জ্যাকেট রাখার ক্যাবিনেটে ৩টি খাতার মধ্যেও স্বর্ণ পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে শুল্ক গোয়েন্দারা ৬২.৩৭ কেজি স্বর্ণ ও ৩৯৭ গ্রাম স্বর্ণালংকার উদ্ধার করেন।তবে এ ঘটনায় সম্পৃক্ত কাউকেই আটক করা যায়নি। শুল্ক গোয়েন্দারা স্বর্ণ উদ্ধারের পর বিমানটি জব্দ করেন।  এই স্বর্ণের মালিকের সন্ধানে ২০১৫ সালের মে মাসের ১২ তারিখে নোটিশ  বোর্ডে কারণ দর্শাও নোটিশ দিলেও কোনও ব্যক্তি স্বর্ণের মালিকানা দাবি করতে আসেনি।

এদিকে বাংলাদেশ বিমান সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উইং কমান্ডার (অবসর প্রাপ্ত) এম এম আসাদুজ্জামান ঢাকা কাস্টম হাউজের নোটিশের জবাব দিয়েছেন গত ১১ জানুয়ারি। নোটিশের জবাবের সঙ্গে এ ঘটনায় ২০১৫ সালের ৩১ মে তারিখের একটি তদন্ত প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়,২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দুবাই থেকে চট্টগ্রাম হয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসা বাংলাদেশ বিমানের বিজি-০৪৮ ফ্লাইট থেকে ৬২.৩৭ কেজি স্বর্ণ ও ৩৯৭ গ্রাম স্বর্ণালংকার  চোরাচালানের সঙ্গে বিমানের কোনও কর্মী জড়িত বলে প্রমান পাওয়া যায়নি। তবে সন্দেহজনকভাবে সেখানে বিমানের  এয়ারক্রাফট ম্যাকানিক আবু সালেহ, আকতারুজ্জান ও টেকনিক্যাল অফিসার আমিনুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। যদিও তারা চোরাচালানে জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। স্বর্ণ চোরাচালান
জানা গেছে, বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারী আটক হয়েছে পুলিশের হাতে।  স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা, কর্মীসহ ৫০ জনের নামের তালিকা রয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে। গত ৬ জানুয়ারি স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টেকনিশিয়ান আবদুস সাত্তারকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৪ সালের ১৯ নভেম্বর বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে বিমানের এক উপ মহাব্যবস্থাপকসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তারা হলেন- বাংলাদেশ বিমানের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এমদাদ হোসেন, প্ল্যানিং অ্যান্ড শিডিউলিং প্রধান ক্যাপ্টেন আবু মোহাম্মদ আসলাম শহীদ, শিডিউল ম্যানেজার তোজাম্মেল হোসেন, উত্তরার ফারহান মানি এক্সচেঞ্জের মালিক হারুন অর রশিদ এবং বিমানের ঠিকাদার মাহমুদুল হক পলাশ। তবে এতো কিছুর পরও বিমান কর্তৃপক্ষ নির্বিকার বলে অভিযোগ রয়েছে। চোরাচালান রোধে উদ্যোগ না নেওয়ায়  রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বাংলাদেশ বিমানই চোরাকারবারিদের জন্য নিরাপদ ও অন্যতম পছন্দের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শুল্ক গোয়েন্দা বলেন, গত বছর ২ ফেব্রুয়ারি বিমানটির যেসব স্থান থেকে স্বর্ণ উদ্ধার হয়েছে সেখানে  বিমানের কর্মীদের সম্পৃক্ততা ছাড়া স্ক্রু দিয়ে খুলে স্বর্ণ রাখা সম্ভব না। বিমানের স্টাফদের সহায়তা না পেলে বিমানে ‍উঠে কোনও যাত্রী স্ক্রু খুলে খুলতেও পারার কথা নয়। এছাড়া একজন যাত্রী ৭/১০ কেজির বেশি ওজনের হাত ব্যাগ নিয়ে বিমানে উঠতে পারেন না। কিন্তু  ৬২ কেজির বেশি পরিমাণের স্বর্ণ উদ্ধার হয়েছে।

কাস্টমস এর নোটিশ

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, কোনও যাত্রীর এই চোরাচালান করে থাকলে তিনি  স্বর্ণ ফেলে যেতেন না, বিমান থেকে নামার সময় তা সঙ্গে নিয়েই নামতেন। কিন্তু স্বর্ণ উদ্ধার হয়েছে সব যাত্রী নামিয়ে বিমানটি যখন হ্যাঙ্গারে দিকে যাচ্ছিল তখন। বিমানের বডিতে লুকিয়ে রাখা এসব স্বর্ণ তাহলে কিভাবে সে যাত্রী পেতেন। এসব ঘটনায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে  বিমানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চোরাচালানে জড়িত।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বিমানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উইং কমান্ডার এম এম আসাদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কাস্টমস হাউজের নোটিশের জবাব আমরা দিয়েছি। তারা (কাস্টমস হাউজ) তদন্ত প্রতিবেদন চেয়েছে, সেটিও দিয়েছি। অন্যান্য এয়ারলাইন্স থেকেও স্বর্ণ ধরা পড়ে। এর মানে এই নয় যে এই এয়ারলাইন্সটিই চোরাচালানে জড়িত। কোনও ব্যক্তির অপর্কমের দায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিমান নেবে না। এর আগেও অনেকের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগ উঠায় তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে।’

বিমানের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে নোটিশের জবাব আসেনি বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন ঢাকা কাস্টম হাউজের কমিশনার মো. লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, ‘বিমানের পক্ষ থেকে একটি নোটিশের জবাব আমরা পেয়েছি। তবে তারা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি। তাদের আবারও যথাযথভাবে জবাব দিতে আবারও চিঠি দেওয়া হবে। এরপর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

/সিএ/এফএস/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হাজারীবাগে ছেলে হত্যার অভিযোগে বাবা গ্রেফতার
হাজারীবাগে ছেলে হত্যার অভিযোগে বাবা গ্রেফতার
ভাটারায় স্ত্রী হত্যার অভিযোগে স্বামী গ্রেফতার
ভাটারায় স্ত্রী হত্যার অভিযোগে স্বামী গ্রেফতার
করের বোঝা ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতি
করের বোঝা ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতি
চুন্নু বাদ, জাপার নতুন মহাসচিব শামীম পাটোয়ারী
চুন্নু বাদ, জাপার নতুন মহাসচিব শামীম পাটোয়ারী
সর্বাধিক পঠিত
প্রসিকিউশন গণহত্যার দালিলিক প্রমাণ দিতে পারেনি: শেখ হাসিনার স্টেট ডিফেন্স
প্রসিকিউশন গণহত্যার দালিলিক প্রমাণ দিতে পারেনি: শেখ হাসিনার স্টেট ডিফেন্স
লোহিত সাগরে জাহাজে হামলায় আগুন, ডুবে যাওয়ার শঙ্কা
লোহিত সাগরে জাহাজে হামলায় আগুন, ডুবে যাওয়ার শঙ্কা
বাংলাদেশে নিজের অনেক ভক্ত জানার পর যা বললেন কেট উইন্সলেট
বাংলাদেশে নিজের অনেক ভক্ত জানার পর যা বললেন কেট উইন্সলেট
নদীতে ইলিশের দেখা মিলছে না কেন
নদীতে ইলিশের দেখা মিলছে না কেন
বিশেষ বিমানে গুজরাট থেকে দুই শতাধিক ‘বাংলাদেশি’কে সীমান্তে পাঠালো ভারত 
বিশেষ বিমানে গুজরাট থেকে দুই শতাধিক ‘বাংলাদেশি’কে সীমান্তে পাঠালো ভারত