নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের আবাসনের জন্য উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পে ফ্ল্যাট নির্মাণ করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।এই ফ্ল্যাট থাকবে ক্রয়সীমার মধ্যে-এমন আশায় অনেকে বুক বেধেছিলেন।কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। নির্মাণাধীন এসব ফ্ল্যাট বরাদ্দে রাজউকের দেওয়া কঠিন শর্ত মেনে একটা ফ্ল্যাট পেতে কোটি টাকা গুণতে হবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষকে। এর ফলে তৃতীয় দফায় সময় বাড়িয়েও কাঙ্খিত আবেদন পাওয়া যাচ্ছে না। তিন মাসে আবেদন পড়েছে দেড়শ’টি। ইতোমধ্যে ফ্ল্যাটের বরাদ্দ পেলেও তা বাতিল করে জমা দেওয়া টাকা ফেরত নিয়ে গেছেন অনেকে।
রাজউকের জারি করা বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, দ্বিতীয়বারের মত ফ্ল্যাট বরাদ্দের আবেদনপত্র বিক্রি ও গ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে গত বছরের পহেলা ডিসেম্বর। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী উত্তরা তৃতীয় পর্বে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত প্রতিটি ১৬৫৪ বর্গফুট আয়তনের আড়াই হাজার ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য বাংলাদেশিদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করা হয়। এ জন্য নির্ধারিত ফরমের দাম ধরা হয়েছে অফেরতযোগ্য দুই হাজার টাকা। এই ফরম পূরণ করে জামানত হিসেবে রাজউকে জমা দিতে হবে চার লাখ টাকা। প্রবাসীদের জন্য এই জামানত নির্ধারিত হয়েছে পাঁচ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার। বরাদ্দযোগ্য ১৬৫৪ বর্গফুটের মধ্যে ১২৭৬ বর্গফুট হবে মূল ফ্ল্যাটের আয়তন এবং বাকি ৩৭৮ বর্গফুট কমনস্পেস। নিয়মানুযায়ী ক্রেতাদের কমনস্পেসের দামও পরিশোধ করতে হবে।
আবেদনকারীদের জন্য রাজউকের তৈরি করা প্রসপেক্টাসে দেখা গেছে, ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের দাম ধরা হয়েছে চার হাজার ৮০০ টাকা। এ হিসেবে ১৬৫৪ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাটের দাম পড়বে ৭৯ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ টাকা। তবে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়লে এই দাম আরও বাড়বে। কারও বরাদ্দ বাতিল হলে প্রদানকৃত টাকার ৫ শতাংশ কেটে রেখে বাকি টাকা বিনা সুদে ফেরত দেবে রাজউক।
প্রসপেক্টাসে বলা হয়েছে, নিচতলায় প্রতিটি গাড়ি পার্কিং স্থানের জন্য এককালীন তিন লাখ টাকা এবং বিভিন্ন ইউটিলিটি সংযোগের জন্য দুই লাখ টাকা এককালীন পরিশোধ করতে হবে। এই পাঁচ লাখ টাকা গ্রাহককে দিতে হবে ফ্ল্যাটের দখল বুঝে নেওয়ার আগে।
রেজিস্ট্রেশন বাবদ গ্রাহককে কত টাকা দিতে হবে সে সম্পর্কে প্রসপেক্টাসে কিছু বলা নেই। তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রেজিস্ট্রেশন বাবদ গ্রাহককে ফ্ল্যাটের মোট মূল্যের ১০ শতাংশ টাকা দিতে হতে পারে।
রাজউকের শর্ত অনুযায়ী, কোনও গ্রাহক ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য নির্বাচিত হলে ফ্ল্যাটের মূল্য জামানতের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। অর্থাৎ প্রদত্ত জামানতের ৪ লাখ টাকা বাদ দিয়ে ফ্ল্যাটের অবশিষ্ট মূল্য দাঁড়াবে ৭৫ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ টাকা। নির্মাণ চলাকালে এই অবশিষ্ট মূল্যের ৫০ শতাংশ (৩৭ লাখ ৬৯ হাজার ৬০০ টাকা) চার বছরে চারটি সমান কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। কেউ ব্যর্থ হলে তাকে পরবর্তী এক বছরের মধ্যে ১২ শতাংশ বিলম্ব ফিসহ কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হবে। তা না হলে বরাদ্দ বাতিল হবে এবং প্রদানকৃত টাকা থেকে ৫ শতাংশ কেটে বাকিটা আবেদনকারীকে ফেরত দেওয়া হবে।
ফ্ল্যাটের অবশিষ্ট টাকা পরিশোধ করতে হবে ফ্ল্যাট বুঝে পাওয়ার পর সর্বোচ্চ আট বছরের আটটি বার্ষিক সমান কিস্তিতে। তবে এ জন্য কিস্তি মূল্যের ১২ শতাংশ টাকা ‘কিস্তি সুবিধা ফি’ হিসেবে দিতে হবে রাজউককে। এর ফলে অবশিষ্ট মূল্যের ওপর শুধু ‘কিস্তি সুবিধা ফি’ দিতে হবে ৪ লাখ ৫২ হাজার ৩০৪ টাকা।
হিসাব করে দেখা গেছে, পার্কিং, ইউটিলিটি, রেজিস্ট্রেশন ও কিস্তি সুবিধা ফিসহ রাজউকের ১৬৫৪ বর্গফুট আয়তনের একটি ফ্ল্যাট পেতে গ্রাহককে গুণতে হবে প্রায় ৯৭ লাখ টাকা। এ টাকা দিতে স্বাভাবিকভাবে সবকিছু চললে। আর কোনও গ্রাহক আর্থিক সমস্যার কারণে কিস্তির টাকা দিতে না পারলে তাকে আরও কয়েক লাখ টাকা অতিরিক্ত গুণতে হবে।
ফ্ল্যাট বরাদ্দে রাজউকের এসব শর্ত প্রসঙ্গে আবু সোলায়মান নামের এক গ্রাহক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নির্মাণ কাজ চলাকালে চার বছরে রাজউককে দিতে হবে প্রায় ৪০ লাখ টাকা। এ টাকা দেওয়ার পরও সময় মত ফ্ল্যাট বুঝে পাব তার নিশ্চয়তা নেই। অথচ ৪০ লাখ টাকা যদি ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখে দেই তাহলে ছয়-সাত বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আর কোনও কারণে ফ্ল্যাটের কিস্তির টাকা সময়মত পরিশোধ করতে না পারলে গুণতে হবে ১২ শতাংশ টাকা জরিমানা। এভাবে একটি ফ্ল্যাটের দাম প্রায় কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। অথচ রাজধানীর ভেতরে বেসরকারি কিছু কোম্পানির ফ্ল্যাট এর চাইতে কম দামে বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, গ্রাহক ব্যর্থ হলে রাজউক সুদসহ নেবে। আর কেউ ফ্ল্যাট না নিতে চাইলে তাকে জমাকৃত টাকার সুদ দেওয়া হবে না। বরং ৫ শতাংশ টাকা কেটে রাখা হবে। এটা কেমন নিয়ম?
ফ্ল্যাট প্রকল্পের এস্টেট শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও রাজউকের জোন-৪ এর পরিচালক একেএম শফিকুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ২০১৩ সালে প্রথমে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬ হাজার ১০০টি। এরপর ২০১৪ সালে দেওয়া হয় আরও ৫৫০টি। সব মিলিয়ে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬ হাজার ৬৫০টি। এর মধ্যে আড়াই হাজার ফ্ল্যাট ফেরত এসেছে। আর্থিক সমস্যার কথা বলে গ্রাহকরা টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। এই ফ্ল্যাটগুলোই বরাদ্দ দেওয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।
রাজউক সূত্র জানিয়েছে, এবার তৃতীয় দফায় ফ্ল্যাট বরাদ্দের কার্যক্রম চললেও ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। গত তিন মাসে আবেদন পড়েছে প্রায় দেড়শ’টি। এ প্রসঙ্গে এক কর্মকর্তা বলেন, প্রথমবার যখন ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয় তখন প্রতি বর্গফুটের দাম ধরা হয়েছিল ৩৫০০ টাকা। এবার তেরশ’ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে দুইবার সময় বাড়িয়েও কাঙ্খিত সংখ্যক আবেদন পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয় বার বাড়ানো সময়সীমা অনুযায়ী আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত ফ্ল্যাটের আবেদন করা যাবে। এর আগে সর্বশেষ সময় ছিল ৩১ জানুয়ারি ও ২৯ ফেব্রুয়ারি।
রাজউকের উত্তরা তৃতীয় পর্বের ১৮ নম্বর সেক্টরে ২১৪.৪৪ একর জমির ওপর ফ্ল্যাট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ‘এ, বি এবং সি’- এ তিন ব্লকে ফ্ল্যাট হবে ১৫ হাজার ৩৬টি। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৩০ কোটি ৭২ লাখ টাকা। প্রকল্পে ১৭৯টি ষোলতলা ভবন হবে। বর্তমানে চলমান ‘এ’ ব্লকের কাজ শেষ হলে পর্যায়ক্রমে ‘বি’ এবং ‘সি’ ব্লকে কাজ শুরুর কথা রয়েছে।‘এ’ ব্লকের ৭৯টি ভবনে ফ্ল্যাট হবে ৬৬৩৬টি।
প্রকল্প পরিচালক এএসএম রায়হানুল ফেরদৌস বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ১৯টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। যত দ্রুত সম্ভব ক্রেতাদের ফ্ল্যাট হস্তান্তর করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ৮৪০টি ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হবে। ২০১৭ সালের জুন নাগাদ আরও তিন হাজার এবং অবশিষ্ট ফ্ল্যাট ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে হস্তান্তর সম্ভব হবে। ফ্ল্যাটের দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিটি কাজের ব্যয় বিশ্লেষণ করে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গতবারের চাইতে এবার প্রতি বর্গফুটের দামও বেড়েছে।
/ওএফ/ এমএসএম/আপ-এআর/
