নিজের কর্মময় জীবনের রেখে যাওয়া স্মৃতি দিয়ে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্রতি মুহূর্তে আন্দোলিত করে চলেছেন জেমকন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, অধুনালুপ্ত আজকের কাগজ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদ। তার বিভিন্ন স্মৃতির কথা তুলে ধরতে ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছো নয়নে নয়নে’ শীর্ষক স্মরণসভায় অংশ নিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। সভায় বক্তারা বলেন, স্রোতের বিপরীতে নির্ভয়ে কাজ করে গেছেন কাজী শাহেদ আহমেদ। তিনি যে কাজেই হাত দিয়েছেন, সেটাতে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। সব কাজে সফলও হয়েছেন। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন কাজী শাহেদকে বাস্তবে ভোলা যাবে না বলেও উল্লেখ করেন তারা।
শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) রাজধানীর শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব মিলনায়তনে কাজী শাহেদ আহমেদ প্রয়াণে নাগরিক স্মরণসভায় তারা এসব কথা বলেন। এসময় কাজী শাহেদ আহমেদের সহধর্মিণী আমিনা আহমেদ, তাদের তিন পুত্র জেমকন গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ, জেমকন গ্রুপের পরিচালক ড. কাজী আনিস আহমেদ, কাজী ইনাম আহমেদসহ জেমকন গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও কাজী শাহেদ আহমেদের অনুরাগীরা উপস্থিত ছিলেন।
রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদী মুহাম্মদের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় স্মরণসভা। পরে কাজী শাহেদ আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে কাজী শাহেদ আহমেদের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের নানা বিষয় তুলে ধরে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।
স্মরণসভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে কাজী শাহেদ আহমেদের পুত্র, জেমকন গ্রুপের পরিচালক ও বাংলা ট্রিবিউনের প্রকাশক ড. কাজী আনিস আহমেদ বলেন, ‘বাবার যে ব্যক্তিত্ব ছিল, তাকে ঘিরে যে আগ্রহ রয়েছে, তা নিয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে। তিনি দেশবরেণ্য ব্যক্তি ছিলেন, স্বপ্নচারী স্বপ্নপ্রণয়ী মানুষ ছিলেন; স্বপ্ন দেখতে স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসতেন। কাজের ব্যাপারে একনিষ্ঠ ছিলেন। জানার আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড। সীমিত স্রোতের মধ্যে আটকে থাকেননি কাজী শাহেদ। তার রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলোই আমাদের এখন অনুপ্রেরণা। পরিবারের সদস্যসহ সবাইকে নিয়ে সময় কাটাতেন। মানুষের সাথে মিশে যেতে পছন্দ করতেন।’
স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, ‘যারা কাজী শাহেদের সাথে মেশেননি, তাদের অনেক কিছু বোঝানো যাবে না। তার বিষয়ে কিছু বলা আমার জন্য কঠিন। কাজী শাহেদ কোনও কাজে পরাজিত হবেন, তা বিশ্বাস করতেন না। তার আত্মজীবনীতে যা লিখেছেন, তার সব তথ্য সঠিক। বইটিতে কোনও অবাস্তব কিছু উল্লেখ নেই। মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন কাজী শাহেদ আহমেদ। আমার জীবনের ৮০ ভাগ অবদান কাজী শাহেদ আহমেদের।’
কাজী শাহেদ আহমেদের বড় ছেলে, জেমকন গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও যশোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, ‘আমার বাবাকে স্মরণ করার জন্য সবাই একত্রিত হয়েছেন, এ জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমার বাবার সম্পর্কে আমার ভাইয়েরা অনেক কিছু বলে গেছেন, বিভিন্ন ধরনের বর্ণনা দিয়ে গেছেন, সহকর্মীসহ যারা সময় কাটিয়েছেন তারাও স্মরণ করেছেন।
নিজের বাবাকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘পূর্ণতা পাথেয় মানুষ ছিলেন আমার বাবা। বিপদ কিংবা দুর্দিনে থাকলেও জীবনের পূর্ণতা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কাজপাগল একজন লোক ছিলেন, কর্মবীর ছিলেন। সবসময় তিনি চেষ্টা করেছেন, যে কাজটি করবেন সেটি ভালোভাবে সম্পন্ন করতে। বাবার অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে এই কাজটি করে যাওয়ার চেষ্টা করছি। ১৯৭৫ সালে যখন সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন, তারপর আবাহনীর হাল ধরেছিলেন কাজী শাহেদ আহমেদ। তিনি কোনও কিছুতেই আপস করেননি। মানুষের প্রতি দরদ-ভালোবাসা ছিল। সেবাধর্মী কাজ আমাদের মধ্যেও রয়েছে। কাজের মধ্যে বেঁচে থাকবেন কাজী শাহেদ আহমেদ।’
স্মরণসভায় অংশ নিয়ে দৈনিক কালের কণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘এখন যেসব সংবাদপত্র যেভাবে প্রকাশিত হয়, তার পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছেন কাজী শাহেদ আহমেদ। তার প্রতিটি কাজের মধ্যে নতুনত্ব ছিল। তার লেখায় কখনও তিনি বানোয়াট কিছু লেখেননি। আজ শাহেদ ভাই নেই, কিন্তু কিছু মানুষ তাদের চিন্তাশক্তির মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘পরলোকে যাত্রা করলে মানুষ স্মৃতি হয়ে যায়। তারা দাগ রেখে যান, তাদের মানুষ মনে রাখে। কাজী শাহেদ আহমেদ সবার কাছে স্মরণযোগ্য। তিনি খুবই স্নেহশীল ছিলেন, প্রত্যেকের ভালোমন্দ দেখতেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় যেখানে কাজ করে গেছেন, সবার জীবনেই যে স্পর্শ তিনি রেখে গেছেন, সেজন্য সবাই তাকে স্মরণ করবেন।’
জেমকন গ্রুপ, মীনা বাজার কিংবা ইউল্যাবসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে স্বতন্ত্রভাবে তৈরি করেছেন উল্লেখ করে এই কথা সাহিত্যিক বলেন, ‘কাজী শাহেদ আহমেদ কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন। অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ মানুষ ছিলেন, বিনয়ী মানুষ ছিলেন, রসবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। মানুষকে কাছে টানার একটি অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। যারা কাজী শাহেদের সঙ্গে কাজ করেছেন, স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করেছেন। কাজী শাহেদও সেই স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সবার কাছে উদাহরণ হয়ে বাস্তবে বেঁচে থাকবেন কাজী শাহেদ আহমেদ।’
স্মরণসভায় দেওয়া বক্তব্যে ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান বলেন, ‘সংবাদপত্রে অপরিসীম অবদান রেখে গেছেন কাজী শাহেদ আহমেদ। বাংলাদেশের জনগণ কী চায়, তা বুঝে সেসব বিষয় সংবাদপত্রে তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছেন। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
কাজী শাহেদ আহমেদের স্মৃতিচারণ করে এপেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিম মনজুর বলেন, ‘কাজী শাহেদ আংকেলের সঙ্গে আমার পারিবারিকভাবে তিন ধরনের সম্পর্ক ছিল। একজন মানুষের কত রূপ থাকতে পারে, তা আমরা প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে দেখলাম। কাজী শাহেদ আহমেদকে একটা বাক্সে বন্দি করে রাখা যাবে না। তিনি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সবসময় কাজ করার চেষ্টা করেছেন। সবসময় ব্যতিক্রম ছিলেন শাহেদ আংকেল। ব্যবসার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেননি তিনি।’
এসময় কাজী শাহেদ আহমেদের প্রতিষ্ঠিত ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) উপাচার্য প্রফেসর ইমরান রহমান বলেন, ‘আমি শাহেদ ভাইকে চিনি (তার স্ত্রী) আমিনা আপার সূত্রে। এ থেকে ঘনিষ্ঠতা হয়। শাহেদ ভাই যখন ইউল্যাব চালুর সিদ্ধান্ত নিলেন, সে সময় থেকে আমি সম্পৃক্ত। নাম জটিলতায় আটকে পড়েছিল ইউনিভার্সিটির কার্যক্রম। পরে সব জটিলতা দূর করে ইউল্যাবের কার্যক্রম শুরু হয়।’
কাজী শাহেদ আহমেদ বর্ণাঢ্য জীবনযাপন করেছেন উল্লেখ করে কবি কামাল নাসের চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, ‘কিছুটা দূর থেকে, কিছুটা কাছে থেকে তাকে আমি দেখেছি। পৃথিবী থেকে কিছু হারায় না। মানুষের কাজ হারায় না, মানুষের স্বপ্ন হারায় না। মানুষের নিষ্ঠা-নিবেদনও হারায় না, কোনোভাবে যদি সেই নিষ্ঠা-নিবেদনের মধ্যে একটা অসাধারণ কিছু থাকে। সেটি টিকে থাকে। আমার কাছে মনে হয়, তিনি যে কাজগুলো করেছেন ঠিক সেগুলোও সেরকম। তরুণ প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে কাজী শাহেদের কর্মময় জীবন।’
কাজী শাহেদের ছাত্র অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জহিরুল আলম বাহিনীতে যোগদান ও কাজী শাহেদের সঙ্গে তার সম্পর্কের নানাদিক তুলে ধরেন।
এসময় সাংবাদিক জ ই মামুন বলেন, ‘কাজী শাহেদ আমার কাছে অনুপ্রেরণা, আমাকে সাহস জুগিয়েছেন। মালিক হিসেবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় কোনও হস্তক্ষেপ করেননি। পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করে গেছেন। এসব কারণে তার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। শুধু আমি নই, সবার কাছে অনুপ্রেরণা কাজ করে বলে মনে করি।’
আজকের কাগজের তৎকালীন প্রতিবেদক সাংবাদিক আনিস আলমগীর বলেন, ‘শাহেদ ভাই আমার জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’ আজকের কাগজের সেই সময়ের বিভিন্ন স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সাহসিকতায় কাজী শাহেদ আহমেদ ছিলেন অনন্য। বিচক্ষণ ছিলেন, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন তিনি।’