X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১
চুরি হওয়া শিশু উদ্ধার

একজন মায়ের কান্না, একটি ক্লুলেস অভিযান

নুরুজ্জামান লাবু
২৮ মার্চ ২০২৪, ১০:০০আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৪, ১০:০০

রাজধানীর হাজারীবাগের ঝাউচর মডেল টাউনের বাসিন্দা স্বপ্না বেগম। নিজে গৃহিণী। স্বামী নুরুল ইসলাম পেশায় অটোরিকশা-চালক। দুই ছেলেমেয়ে তাবাসসুম ও তাওসীনকে নিয়ে সুখের সংসার তাদের। তাবাসসুম বড় আর তাওসীন ছোট। গত ২১ মার্চ তাদের জীবনে হঠাৎ নেমে আসে বিষণ্ন এক সন্ধ্যা। বিকালে দুই ছেলেমেয়ে খেলছিল বাসার সামনেই। সঙ্গে ছিল তাদের নানি। কয়েক মিনিটের জন্য নানি ঢুকেছিলেন বাসার ভেতরে। এই ফাঁকে বোরকা পরিহিত এক নারী দুই বছর চার মাসের তাওসীনকে কোলে তুলে নেয়। শিশুটিকে ও পাঁচ বছরের বড় বোন তাবাসসুমকে দুটি চিপস কিনে দেয় সেই নারী। তারপর বোনটিকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে চম্পট দেয় ওই নারী।

পাঁচ বছরের তাবাসসুম বাসায় ঢুকে মাকে বলে তার ভাইকে কোলে নিয়ে চলে যাচ্ছে এক আন্টি। সংবিদ ফিরে আসে মায়ের। রান্না ফেলে দৌড়ে আসেন বাইরে। কিন্তু ততক্ষণে বোরকা পরিহিত সেই নারী চলে গেছে। শিশু ছেলেকে হারিয়ে শুরু হয় মায়ের কান্না।

এদিক-সেদিক খোঁজাখুজি, এলাকায় মাইকিংও করা হয়। ছেলেকে না পেয়ে ছুটে যান হাজারীবাগ থানায়। অজ্ঞাত এক নারীর বিরুদ্ধে দায়ের করেন মামলা। সেই মামলার ছায়া তদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) রমনা বিভাগ। ডিবির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আজহারুল ইসলাম মুকুল জানান, শিশু হারানো পরিবারটি নিতান্তই গরিব। কিন্তু মায়ের অনুভূতি তো একই। ছেলে হারানো মায়ের বিরতিহীন কান্না দেখে তারা সিদ্ধান্ত নেন যেকোনোভাবে শিশুটিকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে দেবেন মায়ের কোলে।

ক্লুলেস অভিযান

ডিবির কর্মকর্তারা জানান, তারা প্রথমেই হাজারীবাগের ঝাউচর মডেল টাউন এলাকার সবগুলো সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেন। সময় মিলিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করেন। এক পর্যায়ে শিশু তাওসীনকে কোলে নিয়ে হাঁটতে থাকা সেই নারীর ফুটেজ পাওয়া যায়। কিন্তু শিশুটিকে চুরি করা ওই নারী নিজেকে বোরকায় এমনভাবে আবৃত করে রেখেছিলেন যে, চোখ দুটো ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না তার।

ডিবির কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম মুকুল জানান, চোখ দেখে তো চেহারা বোঝা যায় না। চেহেরা বোঝা না গেলে ওই নারীকে চিহ্নিত করাও সম্ভব নয়। তারপরও তারা সিসিটিভি ফুটেজ ধরে গভীর অনুসন্ধান শুরু করেন। ওই নারী যেসব সড়ক ব্যবহার করেছে খুঁজে খুঁজে সম্ভাব্য সেসব সড়কের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেন।

ডিবি পুলিশ জানায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফুটেজ দেখা আর বিশ্লেষণ করে এক পর্যায়ে তারা দেখতে পান সেই নারী একটি মোবাইল রিচার্জের দোকানে প্রবেশ করেছেন। এরপর শুরু করেন প্রযুক্তিগত অনুসন্ধান। এক পর্যায়ে ওই নারীর মোবাইল নম্বরও চলে আসে ডিবি পুলিশের হাতে।

ডিবির কর্মকর্তারা জানান, ওই নারী মোবাইলে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে— এমন কয়েকজনকে সন্দেহের তালিকায় রেখে শুরু হয় গ্রেফতার অভিযান। এক পর্যায়ে কুমিল্লা থেকে এক তরুণকে আটক করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই তরুণ বোরকা পরিহিত সেই নারীর সঙ্গে কথপোকথনের বিষয়টি স্বীকার করে। সে জানায়, তার বোনের ১৩ বছর ধরে কোনও সন্তান হচ্ছে না। বোনের জন্য একটা শিশু কিনতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু ওই নারীর বাসা সে চেনে না। বাসা চেনে তার এক ভাতিজা। ওই তরুণকে নিয়ে তার ভাতিজার গ্রামের বাড়িতে যায় ডিবি পুলিশের একটি দল। ভাতিজাকে নিয়ে কুমিল্লার লালমাই থানা এলাকার এক গ্রামে গিয়ে ওই নারী সুলতানা আক্তার নেহাকে আটক করেন তারা।

ডিবি পুলিশ জানায়, নেহা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের তাওসীনকে চুরির কথা স্বীকার করে। জানায়, শাজাহান নামে এক সিএনজিচালকের কাছে ৫০ হাজার টাকায় শিশুটিকে বিক্রি করেছে। পরে নেহা ও তার স্বামী সাইফুলকে নিয়ে অভিযান চালানো হয় শাজাহানের বাসায়। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় শিশু তাওসীনকে। আটক করা হয় শাজাহানকেও।

চুরির পর এতিম হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল শিশুটিকে

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সুলতানা আক্তার নেহা জানায়, হাজারীবাগের মাহাদীনগরে তাদের নিজেদের একতলা বাড়ি। ঘটনার দিন হাজারীবাগ এলাকায় একটা মেলা চলছিল। সে মেলায় ঘোরাঘুরি করে ঝাউচর এলাকায় যায় সে। সেখানে দুটি শিশুকে খেলতে দেখে তার নানির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা করে। নানি বাসার ভেতরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশু তাওসীনকে চিপস কিনে দেওয়ার কথা বলে কোলে তুলে নেয়। দুটি চিপস কিনে একটি তাওসীনের হাতে ও আরেকটি বড় বোন তাবাসসুমের হাতে দেয়। তাওসীনকে একটু ঘুরিয়ে আনার কথা বলে তাবাসসুমকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।এরপর শিশুটিকে সোজা নিয়ে যায় নিজেদের বাড়িতে।

সুলতানা আক্তার নেহা জানায়, বাসায় যাবার পথে একটি দোকানে মোবাইল রিচার্জ করে সে। তারপর বাসায় নিয়ে খাবার খেতে দেয় শিশুটিকে। যোগাযোগ করে কুমিল্লার সেই তরুণের সঙ্গে। ৭০ হাজার টাকায় শিশুটিকে বিক্রির করা হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু শিশুটির বয়স দুই বছরের বেশি, আর এতিম হিসেবে কোনও কাগজপত্র না থাকায় ওই তরুণ তার বোনের জন্য কিনতে অনীহা প্রকাশ করে।

নেহা জানায়, পরে সে সিএনজিচালক শাজাহানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। শাজাহানকে জানায়, শিশুটি এতিম, বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। নেহা তাকে জানিয়েছে, শিশুটিকে সে ২০ হাজার টাকায় কিনেছে এবং ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করবে। শাজাহান তাতেই রাজী হয়।

গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে শাজাহান জানায়, ১১ বছর ধরে নিঃসন্তান সে। অনেক চেষ্টা করেও সন্তান হয়নি তাদের। নেহার শাশুড়ির মাধ্যমে তাওসীনের কথা জানতে পারে সে। কিন্তু বয়স বেশি হওয়ায় প্রথমে কিনতে চায়নি। কিন্তু তার স্ত্রী তাওসীনকে দেখে পছন্দ করে। প্রথমে ২৯ হাজার টাকা পরিশোধ করে। বাকি টাকা ঈদের পর দিতে চেয়েছে। তাকে বলা হয়েছিল— শিশুটি এতিম। চুরি করা শিশু হলে সে কিনতো না। কেনার আগে স্ট্যাম্পে লিখিত নিয়েছিল। সেখানে নেহা ও তার স্বামী সাইফুল সই করেছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নেহা জানিয়েছে, শিশু সংগ্রহ করার জন্য সে আজিমপুরের শিশুমনি নিবাস ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপতালের একজন তাকে শিশু পেলে ফোন করবে বলে মোবাইল নম্বরও নিয়েছিল।

ডিবি কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম মুকুল বলেন, গ্রেফতার করা আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এর আগে সে কোনও শিশু চুরি করে বিক্রি করেছে কিনা, তা জানার চেষ্টা চলছে।

শিশু তাওসীনের মা স্বপ্না বেগম বলেন, ‘ছেলেকে হারিয়ে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল— আমার ছেলে আমার কোলে ফিরে আসবে। ডিবি পু্লিশ আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমরা আমরা প্রতি কৃতজ্ঞ।’

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
পুঁজিবাজার নিয়ে গুজব ছড়িয়ে যেভাবে চলতো কারসাজি
ঢাবির জগন্নাথ হলে বসে প্রাথমিকের প্রশ্নের সমাধান!
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
সর্বশেষ খবর
মোহামেডানকে রুখে দিলো পুলিশ, চট্টগ্রাম আবাহনী দিলো ৫ গোল
মোহামেডানকে রুখে দিলো পুলিশ, চট্টগ্রাম আবাহনী দিলো ৫ গোল
হিট অফিসারের পরামর্শে ‘কৃত্রিম বৃষ্টি’ ছিটাবে ডিএনসিসি
হিট অফিসারের পরামর্শে ‘কৃত্রিম বৃষ্টি’ ছিটাবে ডিএনসিসি
চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া কিশোরকে জীবিত উদ্ধার
চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া কিশোরকে জীবিত উদ্ধার
রাসায়নিক দিয়ে পাকানো ৪০০ কেজি আম জব্দ
রাসায়নিক দিয়ে পাকানো ৪০০ কেজি আম জব্দ
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই