X
সোমবার, ২০ মে ২০২৪
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

হ্যান্ডব্রেক ছাড়াই চলে রাজধানীর বাস, পায়ের ব্রেকেও নেই জোর

জুবায়ের আহমেদ
০৮ মে ২০২৪, ২২:০০আপডেট : ০৮ মে ২০২৪, ২২:০০

রাজধানীতে চলাচলকারী বেশিরভাগ বাসের যে বাহ্যিক ফিটনেস ঠিক নেই, তা খালি চোখেই স্পষ্ট। আর চালকের সামনের ড্যাশবোর্ডের ভঙ্গুর অবস্থা দেখলে বাসের ভেতরের ফিটনেসের বেহাল চিত্র ফুটে ওঠে। রাস্তায় চলা বাসের যে বিষয়গুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে ব্রেকিং সিস্টেম অন্যতম। অথচ রাজধানীতে চলাচলকারী বেশিরভাগ বাসেরই ব্রেকিং সিস্টেমের অবস্থা নাজুক। বিশেষ করে কোনও বাসেই নেই হ্যান্ডব্রেক।

সম্প্রতি রাজধানীতে বিভিন্ন কোম্পানির বাস সরেজমিন ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। প্রায় ৩৫টি বাসে খোঁজ নিয়ে একটিতেও হ্যান্ডব্রেকের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। দেখা গেছে, বেশি ত্রুটিপূর্ণ বাসগুলোর দরজার পাশের সিটের নিচে ইট বা কাঠ রাখা হয়, থামানো অবস্থায় বাসগুলোর টায়ারের নিচে ঠেক দেওয়ার জন্য।

যেকোনও বাসে হাত ও পায়ের ব্রেক থাকে। এর মধ্যে পায়ের ব্রেকটি বেশি ব্যবহার করা হয়। হাতের ব্রেক ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবহার হয়ে থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরনো বাসগুলোর ব্রেক বেশিরভাগ তেল নিয়ন্ত্রিত এবং নতুন বাসের ব্রেক হাইড্রোলিক/ হাওয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বর্তমানে বেশিরভাগ বাসের ব্রেকিং সিস্টেম হাওয়া পদ্ধতিতে কাজ করে। একটি গাড়ির পায়ের ব্রেকের হাওয়ার পরিমাণ সাধারণত ১০০ থেকে ৮০-এর মধ্যে থাকা উত্তম। এই হাওয়া পরিমাপের জন্য চালকের আসনের সামনে ছোট একটি মিটার থাকে। তবে বাসগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়—বেশিরভাগ বাসের মিটারই কাজ করছে না, অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ। মিটারগুলোর ওপর ধুলো জমে আছে। কোনও কোনও বাসে এই মিটার ঝুলে থাকতেও দেখা যায়। ফলে ব্রেকে হাওয়া কতটুকু আছে, তা বোঝার উপায় নেই। আবার অনেক বাসের হ্যান্ডব্রেকও নেই।

বেশিরভাগ গাড়ির হ্যান্ডব্রেক থাকে না, থাকলেও তা অকেজো

হ্যান্ডব্রেকের বিষয়ে চালকদের বক্তব্য—এটি তেমন কাজে আসে না। তাই এটি লাগানোরও গুরুত্ব নেই। পায়ের ব্রেকেই কাজ চলে যায়। এদিকে পায়ের ব্রেকের দুর্বলতার কারণ জিজ্ঞাসা করলে চালকরা জানান, হাওয়া একবার দেওয়া থাকলে দীর্ঘ সময় চলে। তবে কমে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করা সম্ভব হয় না। ওভাবেই কয়েক দিন চলতে হয়। আবার বেশি যাত্রী থাকলেও পায়ের ব্রেকের হাওয়ায় প্রয়োজনীয় প্রেসার নিতে পারে না। তাছাড়া ব্রেকশো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পায়ের ব্রেক দুর্বল হয় বলেও জানান চালকরা। একটি ব্রেকশো নষ্ট হলে কতদিন পর পরিবর্তন করা হয়— জানতে চাইলে চালকর জানান, শো ক্ষয় হতে থাকে। এ অবস্থাতেও গাড়ি চালাতে  হয়। যখন একেবারে আর ব্রেক ধরতে চায় না, তখন পরিবর্তন করা হয়।

হ্যান্ডব্রেকের বিষয়ে জানতে চাইলে ‘রাজধানী সুপার সার্ভিস’ পরিবহনের সহকারী বাইজিদ বলেন, ‘বেশিরভাগ গাড়ির হ্যান্ডব্রেক থাকে না, থাকলেও নষ্ট, অথবা খুলেও রাখা হয়।’

প্রজাপতি পরিবহনের স্টাফ মশিউর বলেন, ‘হ্যান্ডব্রেকটা টেকসই থাকে না, নষ্ট হয়ে যায়। অনেকেই ফিটনেস চেকের আগে ঠিক করে বা লাগায়। কিন্তু দেখা যায় আজকে ঠিক করলে কালকে নষ্ট হয়ে যায়। হাওয়া থাকে না। খুব যন্ত্রণায় থাকতে হয় হ্যান্ডব্রেক নিয়ে।’

আসিম পরিবহনের চালক লিটন বলেন, ‘নতুন গাড়ি আনা হলে সেগুলোর হ্যান্ডব্রেক থাকে। তবে একবছর গেলেই এই ব্রেক আর কাজ করে না। তখন পায়ের ব্রেকেই চালাতে হয়। তবে মালিক হ্যান্ডব্রেক লাগিয়ে দিলে আমাদের তো সমস্যা নেই।’

‘হ্যান্ডব্রেক ছাড়া গাড়ি চালাতে অসুবিধা হয় না’, জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যখন কোনও ঢাল দিয়ে ওপরে উঠবেন, তখন হ্যান্ডব্রেকটা কাজে লাগে। ওইটা ধইরা রাখে। আবার যদি ধরেন, বেশি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, অন্য কোনও কিছুতে কাজ হচ্ছে না। তখন হ্যান্ডব্রেক দিলে কিছুটা লাভ হয়।’

বিহঙ্গ বাসের জাহাঙ্গীর বলেন, ‘চালানো অবস্থায় হাত ব্রেকের কোনও কাজ নাই। কোথাও পার্কিং করে রাখলে তখন ড্রাইভার থাকে না। ওই সময় হ্যান্ডব্রেক দিয়ে রাখতে হয়, যাতে গাড়ি না নড়ে বা পেছন থেকে ধাক্কা দিলেও গাড়ি সামনে না আগায়। তবে গাড়ি গিয়ারে ফেলে রাখলে তখন হ্যান্ডব্রেকও কাজে আসে না।

এদিকে পায়ের ব্রেকের দুর্বলতার কারণ সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিকড় পরিবহনের এক চালক বলেন, ‘ব্রেকের সিলিন্ডারে লিক থাকলে হাওয়া নেমে যায়। সিলিন্ডার লিকের অনেক কারণ আছে— ক্ষয় হয়, প্লেট খুলে যায়। তখন হাওয়া লিক করে। এটা সার্ভিসে নিতে হয়। আর প্রত্যেকটার জন্য আলাদা করে সার্ভিসে নিলে বাস বসিয়ে রাখতে হয়। কয়েকটা সিস্টেম নষ্ট হওয়ার পর তা ঠিক করতে একসঙ্গে বাস সার্ভিসে নিয়ে যাওয়া হয়। ততদিন পর্যন্ত এভাবেই চালাতে হয়।’

তবে চালক দক্ষ হলে ব্রেকে সামান্য সমস্যা থাকলেও যাত্রাবাড়ী থেকে মিরপুর পর্যন্ত যাওয়া-আসা সম্ভব জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার রাস্তায় তো বাসের তেমন গতি থাকে না। মাঝে মাঝে নতুন পোলাপাইন সিরিয়ালের জন্য গতি ওঠায়। এমনিতে স্লো-ই থাকে গাড়ি।

রাজধানীতে চলাচলকারী রঙচটা বাস

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সব বাসের হ্যান্ডব্রেক থাকে না তা না, কিছু কিছু বাসের আছে। হ্যান্ডব্রেকের নানাবিধ সমস্যা আছে। এই যেমন ধরেন,  রাতের বেলায় যখন গ্যারেজে রাখি সকালে এসে দেখা যায়, হ্যান্ডব্রেকের হাওয়া নেই। আর হাওয়া না থাকলে চার চাকা লক হয়ে যায়। এছাড়া ব্যাটারি যদি দুর্বল হয়ে যায় তখনও গাড়ি স্টার্ট নেয় না। চালক সকালে এসে যখন দেখে গাড়ির এই অবস্থা, তখন এটা ঠিক করতে সময় লাগে। চালকের সময়ও নষ্ট হয়। অথচ সকালেই তো ট্রিপ থাকে।’

হাওয়া কেন নেমে যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিলিন্ডারের লিকের কারণে এই সমস্যা হতে পারে। তবে এখন বিআরটিএ থেকে হ্যান্ডব্রেকের জন্য কড়াকড়ি চাপ রয়েছে। ফলে অনেকেই হ্যান্ডব্রেক লাগাচ্ছেন।’

যেকোনও চার চাকার গাড়ির জন্য হ্যান্ডব্রেক অত্যন্ত জরুরি জানিয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চালকরা এটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না করলে তো হবে না। এটা যদি গুরুত্বপূর্ণ না হতো—তাহলে গাড়ির মেকানিজমে এটা যুক্ত থাকতো না। জরুরি মুহূর্তে এই হ্যান্ডব্রেক কাজে আসে। যদি কখনও পায়ের ব্রেক কাজ না করে, তখন তো হ্যান্ডব্রেকই কাজে আসবে। এই ব্রেক থাকলে দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব, যদি যথাযথ সময়ে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া ঢালু রাস্তায় চলতে গেলে বা পার্কিংয়ে হ্যান্ডব্রেক আবশ্যক।’

তিনি বলেন, ‘হ্যান্ডব্রেক ছাড়া বাস চলছে, এটিতে প্রমাণ হয় রাজধানীর গাড়িগুলোর ফিটনেসের প্রতি কতটা কম গুরুত্ব দেয় বাস মালিক ও বিআরটিএ। এছাড়া একটি গাড়ির ব্রেকিং সিস্টেম কেবল চোখে দেখার বিষয় নয়, এটি অবশ্যই পরখ করে দেখতে হয়। এই বিষয়ে দুর্বলতা রয়ে গেলে দুর্ঘটনার হার বাড়বে।’

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
ব্যাটারিচালিত ও রঙচটা যান আর চালানো যাবে না ঢাকায়
ঢাকার চেয়ে আফ্রিকার ছোট শহরের বাসগুলোও সুন্দর: সড়কমন্ত্রী
লাঠিসোঁটা নিয়ে মিরপুরে রিকশাচালকদের সড়ক অবরোধ
সর্বশেষ খবর
সাপ্তাহিক ডিজিটাল সেভিংস সেবা চালু করলো বিকাশ
সাপ্তাহিক ডিজিটাল সেভিংস সেবা চালু করলো বিকাশ
একান্ত আলাপে অস্কারজয়ীর মুখে লালন ফকির থেকে শেখ হাসিনা...
কান উৎসব ২০২৪সোনার বাংলা, আই ওয়ান্ট টু ভালোবাসি: এ আর রাহমান
প্রবাসীর স্বর্ণ ছিনতাই: পুলিশের এসআইসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা
প্রবাসীর স্বর্ণ ছিনতাই: পুলিশের এসআইসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা
এক এজেন্সির ২৬০ হজযাত্রীর কারও ভিসা হয়নি, কারণ দর্শানো নির্দেশ
এক এজেন্সির ২৬০ হজযাত্রীর কারও ভিসা হয়নি, কারণ দর্শানো নির্দেশ
সর্বাধিক পঠিত
শনিবার ক্লাস চলবে ডাবল শিফটের স্কুলে
শনিবার ক্লাস চলবে ডাবল শিফটের স্কুলে
ভারতীয় পেঁয়াজে রফতানি মূল্য নির্ধারণ, বিপাকে আমদানিকারকরা
ভারতীয় পেঁয়াজে রফতানি মূল্য নির্ধারণ, বিপাকে আমদানিকারকরা
এনবিআর চেয়ারম্যানকে আদালত অবমাননার নোটিশ
এনবিআর চেয়ারম্যানকে আদালত অবমাননার নোটিশ
হিমায়িত মাংস আমদানিতে নীতিমালা হচ্ছে
হিমায়িত মাংস আমদানিতে নীতিমালা হচ্ছে
আগামী ৩ দিন হতে পারে বৃষ্টি, কমবে তাপপ্রবাহ
আগামী ৩ দিন হতে পারে বৃষ্টি, কমবে তাপপ্রবাহ