আব্দুর রব। পেশায় ব্যবসায়ী। ১৯৭১ সালে কলেজে দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র ছিলেন। পরিবারের কাউকে না জানিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে চলে যান প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। তারপর ৬ মাস কেটেছে যুদ্ধের ময়দানে। দুই নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন। জুলাই মাসের শেষের দিকে প্রশিক্ষণ শেষে নিজ গ্রাম সিদ্ধিরগঞ্জ ও এর আশেপাশের এলাকায় চালিয়েছেন একের পর এক অপরারেশন। যুদ্ধের মাঠে সহযোদ্ধাকে মারা যেতে দেখেছেন। আর তাই তার মনে হয়, দেশের প্রতি মায়া না জন্মালে মানুষ হওয়া যায় না।
যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে নিজের মতো করে সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রেখেছেন নিজেকে। আব্দুর রব বলেন, বঙ্গবন্ধু একাই সাত কোটি মানুষকে এক করতে পেরেছিলেন। এটা নেতৃত্বের সক্ষমতা। যুদ্ধদিনের কথা এবং আজকের বাংলাদেশ নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের।
যুদ্ধে গেলেন কখন?
যুদ্ধের কথা বলতে গেলে ৭ মার্চের ভাষণ দিয়ে শুরু করতে হয়। আমরাতো একটা দিক নির্দেশনা পেয়েছিলাম। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে আমি সিদ্ধিরগঞ্জ আমার গ্রামেই ছিলাম। আমাদের আদমজী এলাকা শ্রমিক অধ্যুষিত ছিল বলে সেখানে প্রতিবাদের ধরনটা সবসময় ভিন্ন ছিল। ২৭ মার্চ আমরা এলাকার মানুষরা ব্যারিকেড দিয়ে ঠেকাতে চেয়েছিলাম পাকিস্তানি সেনাদের। তারা সেদিন আমাদের এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নেই প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে। এরপর যোগাযোগ করতে করতেই সময় চলে যায়। পরে মে মাসের দিকে শীতলক্ষ্যা পার হয়ে আমরা সোনারগাঁ দিয়ে লঞ্চে উঠে কসবা দিয়ে ভারতে পার হয়ে যাই।
যোগাযোগটা হলো কিভাবে আর কোথায় গেলেন?
যোগাযোগ করি ছাত্রনেতা খালেদ মোহম্মদের সঙ্গে। তিনি একটা চিঠি লিখে আমাদের আগরতলা ক্যাম্প মেলাঘরে পাঠিয়ে দেন। সেখানে একমাস প্রশিক্ষণ শেষে অধিকতর প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের পালাটালা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। মেলাঘর ছিল আমাদের নিজেদের উদ্যোগ আর পালাটালা পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধীনে। ওখানে আরও দেড়মাস প্রশিক্ষণ নিতে হয় আমাদের। আমাদের যাদের প্রশিক্ষণ ছিল না তাদের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে বিস্ফোরক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং পরিকল্পনা নির্ধারণ করে দেশে পাঠানো হয়।
এরপর ঢাকায় ঢুকলেন?
না, সিদ্ধিরগঞ্জে এবং সুখেরটেক মদনপুর এইসব এলাকায়। আমরা সরাসরি একটা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে আমরা আমাদের এক সহযোদ্ধাকে হারাই। পাকিস্তানিরা তখন ব্রিজ সাবস্টেশনগুলো পাহারা দিতো। নদীর এপার ওপারে আমাদের যুদ্ধ হয়েছিল। আমাদের দায়িত্ব ছিল গেরিলার। পাওয়ার স্টেশনগুলো ধ্বংস করার দায়িত্ব ছিল। পারটেক্স-এর ওখানে আমরা একটা অপারেশন করে পাহারায় থাকা ১১ জনকে পরাজিত করি এবং তারা অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। আমরা তাদের মারিনি, তারা বাঙালি ছিল।
যে সামনাসামনি যুদ্ধটা হয়েছিল সেটা কাচপুর ব্রিজ পার হয়ে মদনপুর রেলস্টেশনের একটু আগে আগে। সেখানে একটা বিদ্যুতকেন্দ্র ছিল। আমরা ওই এলাকাগুলোকে পরপর কয়েকটা অপারেশন চালিয়েছি। এতে পাকিস্তানিরা সন্দেহ করেছে নদীর ওপারে মুক্তিবাহিনী ঘাঁটি গেড়েছে। এই সন্দেহ থেকেই তারা ওই গ্রামে আক্রমণ চালায় এবং আমরাও প্রতিরোধ করি।
এরপর ঘোড়াশালে যে ১ লক্ষ ৩২ হাজার কিউবিক টাওয়ার বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয় সেটাও আমরা করেছিলাম। পুরো এলাকার বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। প্রত্যেক পাওয়ার স্টেশনে অ্যাঙ্গেল টাওয়ার থাকে। দিনের বেলায় সেসব এলাকা আমরা রেকি করে আসতাম। অ্যাঙ্গেল টাওয়ারে আঘাত করতে পারলে সবগুলো টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যায়। আর যদি তা না হয় তাহলে টাওয়ার পড়বে না, তারগুলা ঢিলা হয়ে ঝুলে থাকবে। কর্নেল হায়দার আমাদের এসব শিখিয়েছিলেন।
যুদ্ধ সময়ে পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছিল?
কাছে বাড়ি থাকায় আমি দুদিন রাতে গিয়ে দেখা করে এসেছি। না বলে গেছি। তারা রাগ করেননি। যুদ্ধ থেকে ফিরে আসতেও বলেননি। যুদ্ধবিরোধী কিছু মানুষ ছাড়া সেসময় তো সবাই আওয়ামী লীগ। ফলে তারা আমাদের সমর্থন করেছে। বঙ্গবন্ধু একাই ১৯৭১ সালে সাত কোটি মানুষকে এক করতে পেরেছিলেন। এটা তার নেতৃত্বের সামর্থ। আমার বাবা-মা আমাদের চাল দিতেন। এলাকার মানুষ যার যেটুকু সামর্থ ছিল খাওয়াতো। সবাই জানতো, আমাদের যা পাওয়ার তা আমরা তখনই পাব যখন এ দেশ আমাদের হবে। তখনতো অন্য কিছু ভাবার সময় পাইনি। ভেবে যুদ্ধে যাওয়া যায় না।
মেলাঘরের পরিবেশটাও জানা দরকার। আগরতলা থেকে ১৫ কিলোমিটার হবে হয়তো। আজ আর তেমন মনে নেই। সেটা ছোট ছোট পাহাড়ের এলাকা। সেই পাহাড়ে গজারি গাছ কেটে আমাদের টেন্ট করা হতো। আর সে কী বৃষ্টি সেই বছর। তাঁবুর চারপাশে ড্রেন করে রাখতে হতো। শতরঞ্জি ছাড়া আর কিছু ছিল না। ঘুমানোর সময় জামাকাপড়ের ব্যাগ দিয়ে বালিশ বানাতাম। ছোট ছোট ঝর্নার মতো ছিল। সেগুলো থেকে পানি খেতাম। টিউবওয়েল ছিল না।
ছাত্র থেকে হঠাৎ যোদ্ধা হলেন, পরিবর্তনটা কিভাবে?
আমরা ছাত্র ছিলাম বটে, কিন্তু সবার মনে তখন স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা ঢুকে গেছে। যুদ্ধে ছাত্ররাই বেশি গেছে। হয় আমার ছোট বা আমার বড়। মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম জোরালো ছিল। সবার মধ্যে উদ্দীপনা কাজ করেছে। দেশের প্রতি মায়া মমতা না থাকলে এভাবে দলে দলে যুদ্ধে যোগ দেওয়া সম্ভব না। আমাদের ওপর যখন আক্রমণ তখন আমরা কী করে বসে থাকব? তখন কে ছাত্র কে শ্রমিক সে চিন্তাই ছিল না।
যে উদ্দীপনা নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন সেটা অর্জন হয়েছে?
সবসময় মনে রাখবে, যুদ্ধাবস্থায় যা আশা করবে তা কখনই একশভাগ পূরণ হবে না। আবার এও মনে রাখা দরকার আমরা যুদ্ধ করেছি কিছু পাওয়ার আশায় নয়। আবার কী পেলাম না পেলাম সেটার হিসেব রাখার ধারক বাহকও আমরা ছিলাম না। বিভিন্ন গ্রুপ ক্ষমতায় এসেছে, তারা তাদের মতো করে পরিচালনা করেছে।
আমরা যারা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি তারা আজও চেষ্টা করি নিজের মতো করে কিছু করার। এলাকায় সামাজিক কাজগুলো করি নিশ্চুপেই। আমার যা সামর্থ তার মধ্যে যদি আমি দেশের জন্য কিছু করি সেটাই মূল কাজ। মানুষ সেটা করতে পারেনি। জাতিগতভাবে আমরা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে গেছি দিনে দিনে। তবে আমার কাছে কোনও দুর্নীতিবাজের জায়গা নেই।
এখনকার প্রজন্মের জন্য কিছু বলতে চান?
একটা কথাই বলব, মুক্তিযুদ্ধের অনুভূতি আর জাগ্রত নেই। এখন দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করা উচিত। দিন পাল্টেছে অনেক। পাকিস্তানের সময় বড় বড় পোস্টে নন বেঙ্গলি থাকতো বেশি। আমরা যদি স্বাধীন না হতাম তাহলে ওই জায়গাতেই পড়ে থাকতাম। মাঝখানে আমাদের অনেক ভুল হয়েছে। এখন যে জায়গায় পৌঁছেছি সেটা আমাদের আসল জায়গা। একটা যুদ্ধে একটা দল বিজয়ী হয়, একটা দল পরাজিত হয়। যারা পরাজিত হয় তারা আবারও নিজেদের সংগঠিত করতে চায়। বিজয়ীরা যদি উল্লাসেই ব্যস্ত থাকে তাহলে আবারও ছোবলের মুখোমুখি হতে হয়। আমরা যেন সেই ভুল আর না করি সেই চেষ্টা করতে হবে।
ছবি: নাসিরুল ইসলাম
/এফএ/