X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০
দিল্লিতে ফেরার অপেক্ষায় সনু

‘ছেলের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম’

উদিসা ইসলাম
০৪ জুন ২০১৬, ১৯:০২আপডেট : ০৪ জুন ২০১৬, ২০:১৪

বাবা-মায়ের সঙ্গে সনুর ছোটবেলার ছবি সনুর বয়স এখন আনুমানিক দশ বছর।পাঁচ বছর আগে দিল্লি থেকে দুই বাংলাদেশি নারী তাকে অপহরণ করে এনেছিলেন। বাংলাদেশে এনে বরগুনার একটি বাড়িতে আটকে রাখা হয় তাকে। ছেলেকে ফিরিয়ে না দিলেও অপহরণকারীরা ছলেবলে বাবা মায়ের কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসেবে হাতিয়ে নেন লাখ খানেক টাকা।

বাংলাদেশে আসার পর অবহেলা আর অমানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে শিশু সনু তিনবার পালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে ভারতীয় এই শিশুর পরিচয় হয় বরগুনার জামান ইবনে ইউসুফের সঙ্গে। তিনি এই অসহায় শিশুটিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। তার চেষ্টায়ই এক পর্যায়ে সনুকে বরগুনা থেকে নিয়ে গিয়ে রাখা হয় যশোরের সরকারি শিশু-কিশোর সংশোধনালয়ে। এরপর জামান চলে যান ভারতে শিশুটির বাবা মায়ের খোঁজে। জামানকে সনু বলেছিল, ‘তার বাড়ি দিল্লিতে। দিলশান গার্ডেনে। বাবা মেহবুবের গ্যারেজ আছে (পরে জানা গেছে বাবার নাম মেহমুদ)’। এই সূত্রটুকু সম্বল করেই জামান দিল্লি রওনা দেন। কেবল এই আশায়, হারিয়ে যাওয়া শিশুকে যদি বাবা মার কোলে ফিরিয়ে দেওয়া যায়।
বজরঙ্গী ভাইজান নামে খ্যাত জামান ইবনে ইউসূফের সঙ্গে প্রতিবেদক
এদিকে ‘অপহরণকারী’ পরিবারের সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়ে মামলায় জড়িয়ে দেন জামানকে।এসব বাধা ডিঙ্গিয়ে তিনি শেষমেষ ছেলের খবর অভিভাবকের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হন। তারপরও ‘অপহরণকারীরা’ সংগঠিত হয়ে জামানের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, তার ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলাসহ পরিবারের সব সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন একের পর এক। এখনও পাঁচটি মামলা কাঁধে নিয়ে ফিরছেন জামান।

বাবা মায়ের আইডি কার্ড আর সনুর হারানোর স্ক্যান কপি সব কিছুর পরও জামান পৌঁছে যান সনুর বাবা-মা মাধুরী (বিয়ের পর নাম হয়েছে মুমতাজ) ও মেহমুদের বাড়িতে। ২০১০ সালে ছেলে হারানোর শোক ভুলতে বসা মা টেলিফোনে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে সনুর খোঁজ নিয়ে এসেছে শুনে ভেবেছেন ছেলে বুঝি আর নেই। কেউ তার মৃত্যু সংবাদ এনেছে। আমার ছেলে, আমার নাকি প্রমাণ লাগবে। আছে প্রমাণ। মায়ের সামনে ছেলেকে আনলেই প্রমাণ হয়ে যাবে।’
বেড়ে ওঠা ছেলের ছবি দেখে তিনি জড়িয়ে ধরেন জামানের পা। অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়া মাধুরী বলেন, ‘এ আমারই ছেলে, আমি এখনই তার গন্ধ নিতে চাই।’

সনুকে পাওয়া এবং তার প্রমাণাদিসহ জামানের দিল্লিযাত্রা নিয়ে তিনি কথা বলেন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে।
সনু ও জামান বাংলা ট্রিবিউন: ছেলেটিকে যে বাড়িতে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে আপনি তাকে কীভাবে পেলেন?

জামান: এই ছেলেটার মায়া আছে। এত ছোট বয়সে এসেছে। যে মেয়েরা তাকে এনেছেন, তারা অবৈধ পথে ভারতে যাতায়াত করেন বলে অভিযোগ আছে। দিল্লি থেকে তারা এই ছেলেটিকে এনে এলাকায় বোনের সন্তান পরিচয়ে রাখেন। কিন্তু তাকে দিয়ে যেসব কাজ করানো হতো কোনওভাবেই আপনজনকে দিয়ে তা কেউ করাতে পারে না। একদিন ছেলেটি আমাকে জানায় যে, তার বাড়ি ভারতে। বাবার নাম মেহবুব আর মায়ের নাম মাধুরী।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি এলাকার লোকজনকে জানিয়েছিলেন? নাকি নিজেই রওনা দিলেন?

জামান: না, ছেলেটি একাই একাধিকবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমার সঙ্গে দেখা হয় বরগুনা বাসস্ট্যান্ডে। তার কাছে নির্যাতনের কথা শুনে আমি সিদ্ধান্ত নেই তাকে দিল্লি পৌঁছে দেওয়ার। কিন্তু আমি কিছুই চিনি না। বেতাগী থানার পুলিশের সহায়তা পাই নাই। কিন্তু যখন উল্টো আমাকেই অপহরণকারী সাজানোর চেষ্টা করা হলো তখন স্থানীয় মেম্বার, এমপি সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে আমি পরিস্থিতি জানানোর চেষ্টা করি এবং ছেলেটি আদালতে তার জবানবন্দিও দেয়।
জামান ইবনে ইউসুফ বাংলা ট্রিবিউন: শুনেছি আপনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে নিজেই দেখা করেছেন?

জামান: আমার তো পাসপোর্টই ছিল না। শ্যালকের কাছে টাকা ধার করে পাসপোর্ট বানালাম। ভিসার জন্য টাকা লাগে সেটা কোথায় পাবো। সরাসরি হাইকমিশনে গিয়ে হাতেপায়ে ধরলাম। দূতাবাসের এক অফিসারকে বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে পরিস্থিতি বুঝালাম, তিনি আমাকে ভিসা দিয়ে দিলেন। তখন আমার মাথায় নতুন চিন্তা। যদি সনুর বাবা মাকে পেয়েও যাই তাহলে প্রমাণ হিসেবে তাদের কী দেখাব? তখন যশোরের পুলেরহাটে, যেখানে সনুকে সরকারি হেফাজতে রাখা হয়েছে, সেখানে গিয়ে তার একটা ছবি তুললাম। সেই ছবি নিয়ে রওনা দিলাম।

বাংলা ট্রিবিউন: তারপর?

জামান: কোনোভাবে দিল্লি পৌঁছালাম। সেখানে গিয়ে যতোজনকে জিজ্ঞেস করি, সবাই ঠিকানা নাই দেখে আমাকে পাগল ভাবতে শুরু করেন। ছবি দেখিয়ে সেই গ্যারেজের এলাকায় গিয়ে প্রায় দু’শ দোকানের মধ্য থেকে খুঁজে বের করি সনুর বাবাকে। তখনই জানতে পারি সনু তার ঠিক নামটি বলতে পারেনি। সনুর বাবা যখন আমাকে বাড়িতে নিয়ে গেলেন মাধুরী দিদি (সনুর মা) আমার পা জড়িয়ে ধরলেন। তখনই তিনি বাংলাদেশে আসতে চাইলেন। কিন্তু বাংলাদেশে এসে কীভাবে প্রমাণ করবেন তারাই তার আসল বাবা মা, জানতে চাইলে তাদের কাছে জন্মসনদও নেই জানা গেল।

এসময় তারা আমাকে জানান, সনুর হারিয়ে যাওয়ার সময় থানায় জিডি করা হয়েছিল। কাগজেও প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা থানা থেকে সেগুলো সংগ্রহ করি এবং পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দফতরে গিয়ে অনুনয় বিনয় করে পাঁচ মিনিটের জন্য মন্ত্রীর সাক্ষাৎ চাই। মন্ত্রী আমার কথা শুনেছেন। প্রায় একঘণ্টা ধরে বিষয়টা শুনে নিয়ে ঢাকায় ফোন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। এটাই হলো স্বরাজজির সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনা।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি সেই নভেম্বর থেকে এটার পেছনে লেগে আছেন, পরিবারের সদস্যরা এত ভুগলেন,তারা নিষেধ করেনি আপনাকে?

জামান: পরেবারের সবার মাথায় মামলা। ভারতে যাবো টাকা নাই।বউয়ের ভাই নান্নার কাছ থেকে বলে কয়ে ১৫ হাজার টাকা নিয়ে বাসায় বলেছি খুলনা যাবো।আসল কথা বাসায় জানাইনি।ভারতে গিয়ে অপহরণকারী সেই রহিমা, হালিমা ও ফাতেমার নামে ওখানে মামলা আছে কিনা সে খোঁজও নিয়েছি। আমার কোনও স্বার্থ ছিল না। কেবল শিশুটাকে মায়ের কোলে ফেরাতে চেয়েছি। আমার পরিবারের সবাই যে হেনস্তার ভেতর দিয়ে গেছে, তা বলে বোঝানো যাবে না।

সনুর বাবা মাকে খুঁজে বের করেছেন বাংলাদেশের জামান. বাংলা ট্রিবিউন: এখন শেষ পরিস্থিতি কী?

জামান: সনুকে দেখতে তার বাবা মা বাংলাদেশ আসতে চান। তারা পাসপোর্ট করবেন কিনা তাই নিয়ে কথা হচ্ছে। হাইকমিশন যেহেতু দায়িত্ব নিয়েছে, তাই এখন তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। আমাকে জানানো হয়েছে,মেহবুব আর মাধুরী এই ছেলের বাবা মা কিনা সেটা ডকুমেন্ট দিয়ে প্রমাণে না করা গেলে, ডিএনএ টেস্টের ব্যবস্থা করা হবে। পাঁচবছর ধরে সন্তানকে হারিয়ে মা ভেবেছিলেন, আর কোনওদিন ফিরে পাবেন না সনুকে। এখন একটা খোঁজ পেয়েছেন কিন্তু ফেরত কীভাবে পাবেন, সেটা আরও অস্থির করে তুলেছে তাদের। সনুকে ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমি চেষ্টা চালিয়ে যাবো। এর আগে চারটা মামলা থেকে আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এখনও ৫টা মামলা আছে। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া শিশুকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় যে আনন্দ, তা আমার সব হয়রানি ভুলিয়ে দিয়েছে।

ছবি: নাসিরুল ইসলাম

/এপিএইচ/আপ-এমও

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!