X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
মোট প্রাণহানি ১০৯, শেষ ধাপে ৪

সহিংতায় শেষ হলো ইউপি নির্বাচন

এমরান হোসাইন শেখ
০৪ জুন ২০১৬, ২৩:০৪আপডেট : ০৫ জুন ২০১৬, ০০:০১

নির্বাচনি সহিংসতা ব্যাপক অনিয়ম, সহিংসতা ও শতাধিক প্রাণহানির মধ্য দিয়ে শেষ হলো ৬ ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন (২০১৬)। শনিবার শেষ ধাপের ভোটগ্রহণের মাধ্য দিয়ে এই নির্বাচন শেষ হয়। অন্য ধাপের ধারাবাহিকতায় ষষ্ঠ ধাপের নির্বাচনেও সহিংসতা এড়ানো যায়নি। এদিন নির্বাচনি সহিংতায় মারা গেছেন ৪ জন। অবশ্য নিহতদের মধ্যে একজন পঞ্চম ধাপের ভোটের সময় আহত হয়েছিলেন। এ নিয়ে এবারের  ইউপি নির্বাচনের মোট প্রাণহানির সংখ্যা ১০৯।
প্রথমবারের মতো দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত এই ইউপি নির্বাচনকে সরকারের বড় সাফল্য বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এদিকে, এই নির্বাচনকে সরকার পরিকল্পিত জবরদস্তির নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলেছেন, নির্বাচনের নামে সরকারের ইচ্ছাকে নির্বাচন কমিশন বাস্তবায়ন করেছে। এদিকে, নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা এবারের ইউপি নির্বাচনকে প্রাণঘাতী ও কলঙ্কিত নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করেছেন।
অবশ্য নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় এবারের নির্বাচনে হতাহত ও অনিয়মের কথা স্বীকার করলেও সার্বিক বিবেচনায় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করেছে। যদিও একাধিক নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।

দেশে মেয়াদপূর্ণ হওয়া উপযোগী ৪ হাজার ২৭৫টি ইউপিতে ৬ ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন। এর অংশ হিসেবে গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথমধাপের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২২ মার্চ ৭১৪টি, ৩১ ‍মার্চ ৬৩৯টি, ২৩ এপ্রিল ৬১৫টি, ৭ মে ৭০৪টি, ২৮ মে ৭১৭টি ও শনিবার ৪ জুন ৬৯৮টিসহ মোট ৪ হাজার ৮৭টি ইউপিতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আরও বেশ কিছু ইউপির তফসিল হলেও নির্বাচনকালে অনিয়ম ও আইনি জটিলতার কারণে সেগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।

প্রথমবারের মতো দলীয়ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে শুরু থেকেই মনোনয়নপত্র জমা ও  প্রচারণায় বাধা, কেন্দ্র দখল ও জালভোটসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এ ক্ষেত্রে একাধিক স্থানে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান চালু ও ভোটের আগে রাতে সিল মেনে বাক্সভর্তি করাসহ বেশ কিছু বিষয়ে নির্বাচন কমিশন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়। এবারের নির্বাচনে লক্ষণীয় বিষয়টি ছিল বিভিন্ন ইউপিতে চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া। ৬ ধাপের নির্বাচনে ২০৯ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। যাদের মধ্যে একজন বাদে সবাই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী। এই নির্বাচনে সংসদের বাইরের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি প্রায় সাড়ে ৫’শর মতো ইউপিতে প্রার্থী দিতে পারেনি। এ বিষয়ে দলটির অভিযোগ ছিল সরকারি দল ও প্রশাসনের ভয়ভীতির কারণে তাদের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি।

শনিবার শেষ হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা ও প্রাণহানির রেকর্ড হয়েছে বলে নির্বাচন সংশ্লিষ্টতা জানিয়েছেন। শনিবারের ৪ জনসহ নির্বাচনে মোট ১০৯ জন মানুষ মারা গেছেন। এছাড়া, আহত হয়েছে কয়েক হাজারের মতো। নিহত ১০৯ জনের মধ্যে ছয় ধাপের নির্বাচনে ভোটের দিন মারা গেছেন ৪০ জন। এর মধ্যে প্রথম ধাপের নির্বাচনের দিনে নিহত হন ১১ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৮ জন, তৃতীয় ধাপে ২ জন, ৪র্থ ধাপে ৬ জন, পঞ্চম ধাপে ৯ জন ও শনিবার ষষ্ঠ ধাপে ৪ জন মারা গেছেন।  অবশ্য সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) দাবি অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা ১৩০-এর মতো।

অতীতের ইউপি নির্বাচনের হতাহতের ঘটনায় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে দেশে ৮ বার অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ছিল এরশাদ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত ১৯৮৮ সালের ইউপি নির্বাচন। ওই নির্বাচনে প্রতিবেদন ভেদে ৮৫ থেকে ৯৫ জন মানুষ মারা গিয়েছিলেন। এছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০৩ সালের নির্বাচনেও ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ডেমোক্রেসিওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫১ দিনব্যাপী ওই নির্বাচনে ৮০ জন প্রাণ হারান।  ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে প্রতিবেদন ভেদে ২৭ থেকে ৩৪ জন মারা গিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

এদিকে, অনিয়মের কারণে ৬ ধাপের নির্বাচনে অন্তত ৩৪০টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত হয়। যার কারণে ৯৬টি ইউনিয়ন পরিষদে ফল প্রকাশও স্থগিত হয়েছে। রজমানের পর এসব স্থগিত কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে বলে নির্বাচন কমিশন সূ্ত্রে জানা গেছে।

এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও সহিংসতার অভিযোগ থাকলেও নির্বাচনকে সরকারের সাফল্য বলে মনে করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির সভাপতিমণ্ডলির সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, তৃণমূলের এই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে প্রথমবারের দলীয়ভিত্তিতে এই নির্বাচনের সম্পন্ন করতে পারাই হচ্ছে এই সরকারের জন্য বড় অর্জন ও সাফল্য। এরপরও বলব নির্বাচনে নানারকম অনিয়ম ও কোথাও কোথাও কিছু সংঘাত হয়েছে। যেগুলো যেমনি ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য, তেমনটি বলতে হবে এ ধরনের নির্বাচনে এগুলোকে শতভাগ তৃতীয় বিশ্বের দেশে এগুলো এড়ানো সম্ভব নয়। এবারের নির্বাচনের যেসব ত্রুটি ছিলো তার অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে পাবরে বলে মনে করেন দলের এই নেতা।

এদিকে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান মনে করেন, নির্বাচন মানে হলো জনগণ নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন। সেই হিসেবে এটাকে নির্বাচন বলা যায় না। এখানে বহু লোককে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হয়নি। অনেককে বাধ্য করা হয়েছে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে। নির্বাচনের আগেই ব্যালটবাক্স ভরে ফেলা হয়েছে। আমাদের এজেন্টদের কেন্দ্রে থাকতে দেওয়া হয়নি। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচনি কর্মকর্তারা একজোট হয়ে সরকারি দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করার চেষ্টা করেছে। সব সময় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনগণের উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকে। এই নির্বাচনকে মানুষ একটি উৎসব মনে করে। কিন্তু মানুষ এবারের নির্বাচনে ভয়ের মধ্যে ছিল। তিনি বলেন, এই নির্বাচনে সরকারের ইচ্ছাটাই নির্বাচন কমিশন বাস্তবায়ন করেছে।

এই নির্বাচনে হেরে গেলেও তো সরকারের পরিবর্তনের সুযোগ ছিল না উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম খান বলেন, সংসদ জোর করে নিতে হবে, ইউনিয়ন পরিষদ জোর করে নিতে হবে। পৌরসভা জোর করে নিতে হবে। ‍তাহলে তো নির্বাচনের আর দরকার নেই। জবরদস্তি করে নিলেই হয়। এখানে অস্ত্র দেখিয়ে জনগণকে ভয় দেখিয়ে করা হচ্ছে।

আরও পড়তে  পারেন: ইউপি নির্বাচনের শেষধাপেও ঝরে গেলো চার প্রাণ  

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এটা ছিল ব্যাপক কারচুপি, সহিংসতা ও প্রাণহানির নির্বাচন। আমরা দেখেছি ১৯৮৮ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সব থেকে বেশি প্রাণহানির ঘটনা। যেটাকে আমরা সব থেকে খারাপ নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করে ‍থাকি। এবার তার চেয়ে দেড়গুণের বেশি মানুষের প্রাণ ঝরেছে। এবারের নির্বাচনে কী উপমায় ভূষিত করা যেতে পারে, সেটাই বুঝতে পারছি না। তবে আমার মতে, এই নির্বাচনকে প্রাণঘাতী, রক্তাক্ত, নিষ্কৃষ্টতম, কলঙ্কিত—সব ধরনের নেতিবাচক উপমায় আখ্যায়িত করা যায়।

‘বেড়াই খেত খেয়ে ফেলছে’ বলে মন্তব্য করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যেসব নির্বাচনি কর্মকর্তার নিরপেক্ষ নির্বাচন করার কথা, তারাই বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনি অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। এর মাধ্যমে নির্বাচনি ব্যবস্থার ওপর জনগণের ব্যাপক আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এই নির্বাচন আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে কলুষিত করল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নির্বাচন কমিশনার সামগ্রিকভাবে ইউপি নির্বাচন নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টিত কথা জানান। তিনি বলেন, নির্বাচনটা তারা শেষ করতে পেরেছি ঠিকই কিন্তু যা প্রত্যাশা করেছি তা হয়নি। কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, কোনও বিষয়ে একটু শক্ত সিদ্ধান্ত নিলে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গা থেকে যেভাবে তদ্বির আসে, তাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের কয়েকবার ভাবতে হয়েছে। আর এটাই যদি বাস্তবতা হয়, তাহলে আমাদের কতটা করণীয় থাকে।

এদিকে, শনিবার সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ নির্বাচনে হতাহত ও অনিয়মের কথা স্বীকার করলেও সার্বিক বিবেচনায় নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে কিছু সহিংসতা ও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। তবে সামগ্রিকভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। সমাজে অস্থিরতা বাড়ার কারণেই নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে উল্লেখ করে তিনি  বলেন, সবকিছুর দাম বেড়েছে, একমাত্র মানুষের জীবনের দাম কমেছে।  

/এমএনএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা