X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

হত্যার তদন্তে প্রতিযোগিতা নাকি সমন্বয়?

আমানুর রহমান রনি
০৮ জুন ২০১৬, ০৬:৫০আপডেট : ০৮ জুন ২০১৬, ১৩:০১

আইন-আদালত যেকোনও হত্যাকাণ্ডের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও বিশেষায়িত বিভাগ তদন্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তদন্তকারী কর্মকর্তারা আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেন। আর তাতে আধুনিক ইক্যুইপমেন্ট ব্যবহৃত হয়, প্রতিটি বাহিনী ও ইউনিটের কর্মকর্তারা আলাদা-আলাদা বক্তব্য-বিবৃতি দেন। এসব হত্যাকাণ্ডের পর কোনও বাহিনী করে ছায়া তদন্ত, কোনও বাহিনী করে মামলার আনুষ্ঠানিক তদন্ত। অথচ সেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন হয় খুব কমই। তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে যখন জানানো হয়, তখন কোনও বাহিনী নিজের অর্জন ছাড়া অন্য বাহিনীর সহযোগিতার কথা কখনও বলে না। এ পর্যন্ত এমন ঘটনা দেখা যায়নি। কোনও বাহিনী নির্দিষ্ট কোনও একটি ঘটনার অগ্রগতির জানালেও তাতে কেবল ওই বাহিনীর নিজস্ব সফলতার কথাই থাকে। তাই অপরাধ বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, তদন্ত কার্যক্রমে তাহলে কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা ইউনিটের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে? তাদের মধ্যে কি কোনও সমন্বয় নেই? অন্যদিকে, তদন্ত সংস্থাগুলোর কাজ  তথ্য আদান-প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ওইসব গোয়েন্দা সংস্থার ‘জঙ্গি’ সেল থাকলেও বিশেষায়িত কোনও ইউনিট নেই।
প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর পরই ঘটনাস্থলে পৌঁছায় থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশের বিশেষ ইউনিট, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), র‌্যাব, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এর সঙ্গে বর্তমানে যোগ হয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। এছাড়াও,বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গি হামলার তদন্ত করে থাকে। অ্যানালগ ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করেন তারা। এসব বাহিনী বা বাহিনীর ইউনিটের কর্মকর্তারা সব সময় দাবি করেন তাদের মধ্যে সমন্বয় হয়। তবে কোনও ঘটনার অগ্রগতি জানানোর সময় এক বাহিনী অন্য বাহিনীর সহযোগিতা বা সমন্বয় করে সফলতা পেয়েছে এমন তথ্য জানা যায় না।

গত ২৫ এপ্রিল কলাবাগানে বাড়িতে ঢুকে ইউএসএআইডি কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে হত্যা করা হয়। ঘটনার পর ওই বাড়িতে পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি, সিটিটিসি, পিবিআই ও গোয়েন্দা সংস্থা কাজ শুরু করে। আলামত সংগ্রহ করে সিআইডি, র‌্যাব ও পিবিআই। এই ঘটনায় কলাবাগান থানায় দু’টি মামলা দায়ের করা হয়।হত্যা মামলা তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ওই রাতে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘সম্প্রতি কয়েকটি খুনের সঙ্গে এই খুনের প্যাটার্ন এক কিনা তদন্ত করে দেখা হবে। ঘটনায় পুলিশের পাশাপাশি ছায়াতদন্ত করে পুলিশকে সহায়তা করবে র‌্যাব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে এসব ঘটনায় কারা জড়িত তা খুঁজে বের করা আমাদের দায়িত্ব। তিনি আরও বলেন, ‘তদন্তের পর আমরা মোটিভ সম্পর্কে জানতে পারব।আপনারা ধৈর্য ধরুন,আমাদের ওপর আস্থা রাখুন।’

পরদিন সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক বলেন,‘প্রত্যেকের সেন্স অব সিকিউরিটি থাকতে হবে। নিজস্ব নিরাপত্তাবলয় তৈরি করতে হবে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা থাকবে। এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছে পুলিশ। দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’

কিন্তু ঘটনার একমাস পার হলেও এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন হয়নি। তদন্তের অগ্রগতিও নেই। অথচ ডিবির পাশাপাশি র‌্যাব, পিবিআই, সিআইডি এই মামলার ছায়া তদন্ত করছে।

এই মামলার তদন্তের সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, মামলাটি তদন্তে র‌্যাব বা অন্য কোনও বাহিনীর সঙ্গে তথ্য উপাত্তের আদান-প্রদান হয়েছে কিনা? উত্তরে ওই কর্মকর্তা বলেন,‘সবাই যার যার মতো করে কাজ করছে। আমরা আমাদের মতো করে কাজ করছি। একজন গ্রেফতার হয়েছে সেও স্বীকার করেছে। আমরাই বেশি কাজ করি, আমাদের এই মুহূর্তে কারও সহযোগিতা লাগছে না।তবে অন্য কেউ কিছু পেলে আমাদের জানাতে পারে।’

আপনার কাছে অন্য কোনও বাহিনী বা তদন্ত সংশ্লিষ্ট কেউ তথ্য চেয়েছিল কিনা? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এখনও এমন কেউ তথ্য চায়নি। তবে অনেকেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তথ্য সংগ্রহ করেছে। ভিডিও ফুটেজ নিয়েছে। তারা তদন্ত করছে।’

জুলহাজ-তনয় হত্যা মামলা তদন্তে র‌্যাবের কোনও অগ্রগতি আছে কিনা জানতে চাইলে বাহিনীর মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘বলার মতো কোনও কিছু নেই। উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলে অবশ্যই জানাব।’

এই মামলার তদন্তের বিষয়ে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে তথ্য আদান প্রদান ও দক্ষতা বিনিময়ে র‌্যাব কাজ করছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা যেসব ঘটনায় মনে করি তথ্য আদান-প্রদান করা দরকার সেগুলো করি। প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই এটা করা হয়।’

এই মামলায় সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য আদান-প্রদান করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি খানিকটা উষ্মা প্রকাশ করে বলেন,‘আমি মনে হয় আপনাকে বুঝাতে পারিনি। আমরা প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রেই তথ্য আদান-প্রদান করি।’

র‌্যাব জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পরের ১১ বছরে তারা ১ হাজার ১৬৫ জন জঙ্গি নেতা ও সদস্যকে গ্রেফতার করেছে, যার মধ্যে ৬০৩ জনই জেএমবির সদস্য।

২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর উত্তরায় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে এ ধারার শুরু হয়। আসিফকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা। এরপর লেখক অভিজিৎ রায়, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন,বগুড়ায় জিয়া উদ্দিন জাকারিয়া বাবু, সিলেটে অনন্ত, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, নাজিম উদ্দিন সামাদ, রাজশাহীতে শিক্ষক হত্যা, পুরহিত ও ধর্মযাজক হত্যা, বিদেশি হত্যার ঘটনাগুলো উল্লিখিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করে। তবে এক সঙ্গে তদন্ত করে কোনও মামলার সফলতা দেখা যায়নি।

পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন,‘কোনও ঘটনার তদন্তের ক্ষেত্রে অন্যান্য বাহিনীর তদন্তের অগ্রগতির বিষয় গণমাধ্যম থেকে জানতে পারি। অফিসিয়াল কোনও তথ্য তেমন দেওয়া হয় না।’

অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জিয়া খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশে যে অবস্থা এখন চলছে তাতে তদন্তে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। তবে আমরা তা দেখছি না। আমরা নারায়ণগঞ্জের সাতখুনের ঘটনায় সাম্প্রতিক সময়ে র‌্যাব-পুলিশের সমন্বয় দেখছি। তবে এরকম আর দেখা যায় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে কারও কারও ব্যক্তিগত ত্যাগ আছে। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এখনও এরকম ত্যাগ দেখা যাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘কমিটেড হয়ে কাজ করারও অভাব রয়েছে। সমন্বয়হীনতার কারণে অনেক কিছু অর্জন করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক হওয়া দরকার। করণীয় কি তাও ঠিক করা উচিৎ। কিন্তু তা আমরা দেখছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ক্রেডিট নেওয়ার প্রতিযোগিতাও আছে। তবে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আরও ক্রেডিট নেওয়া যেতো সেইভাবে অগ্রসর হচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।’

/এআরআর/এমএসএম/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ