X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের ধরন ও মাত্রা নির্ধারণ জরুরি: ওয়াহিদা বানু

জাকিয়া আহমেদ
১২ জুন ২০১৬, ১১:২৬আপডেট : ১২ জুন ২০১৬, ১১:৩৩

১৯৯৫ সালে ছিন্নমূল শিশুদের সহযোগিতার লক্ষ্যে গঠিত হয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশ।২১ বছর ধরে অপরাজেয় বাংলাদেশ ঢাকা মেট্রোপলিটন সিটি, খুলনা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, জামালপুর, রাজশাহী, কুড়িগ্রাম এবং রংপুরে কাজ করে  আসছে ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে। এই সময়ে ধীরে ধীরে তাদের কাজের পরিধিও বেড়েছে। সারাদেশে ৫৫টি সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমে অপরাজেয় বাংলাদেশ কাজ করছে। বস্তিবাসী শিশু এবং মা, পথশিশু, ঝুঁকিপূর্ণ শিশু, আইনি জটিলতায় পড়া শিশু, জেলখানায় থাকা শিশু, রাস্তা-পার্কে কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার শিশু,যৌনকর্মী মায়েদের শিশু নিয়ে কাজ করছে এই সংগঠনটি। বাংলাদেশে প্রায় দু’শোটির মতো শেল্টার হোম রয়েছে এই সংগঠনের। এসব শেল্টার হোমে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা থাকা শিশুদের সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার ৮০০। আর সারাদেশের স্কুলগুলোতে অপরাজেয় বাংলাদেশের ৩ লাখ শিশু লেখাপড়া করছে। ৩৫ হাজার বস্তিবাসী এবং যৌনকর্মে নিযুক্ত মাকে বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে সংস্থাটি, যেন তারা স্বাবলম্বী হতে পারেন। বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষ্যে কথা হয় অপরাজেয় বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানুর সঙ্গে।

ওয়াহিদা বানু বাংলা ট্রিবিউন: শিশুশ্রমের বর্তমান চিত্রটা কী বলে মনে করেন আপনি?

ওয়াহিদা বানু: সর্বশেষ ২০১৩ সালে শিশুশ্রমিকদের নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো একটি জরিপ করেছিল। এর মধ্যে কেটে গেছে আরও তিনটি বছর।এই সময়ে হয়তো সেই জরিপের তুলনায় কোথাও কোথাও শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে, আবার কোথাও বেড়েছে। এতোদিন ধরে শিশুশ্রম নিয়ে কাজ করলেও সরকারি-বেসরকারি বা আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর ভেতরে কোনও সমন্বয় ছিল না। বাংলাদেশে কতদিনে শিশুশ্রম থাকবে এই ভাবনা নিয়েও কাজ করা হয়নি।

বাংলা ট্রিবিউন:শিশুশ্রম নিয়ে ভাবনার জায়গাটা কোথায় বলে আপনি মনে করেন?

ওয়াহিদা বানু: শিশুশ্রমের অনেকগুলো দিক রয়েছে বাংলাদেশে। গার্মেন্ট কারখানাগুলো কমপ্লায়েন্স মানে না, সেখানে শিশুরা কাজ করছে।  কৃষিকাজে,সমুদ্রে মাছ ধরার কাজে, শুঁটকি খাত, জাহাজ ভাঙার কাজে শিশুরা কাজ করছে দেদারছে।এসব বিষয়  শিশুশ্রমিকের জরিপে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ছিল। যৌন কাজের সঙ্গে লিপ্ত শিশুরা, সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুরা,অটিস্টিক-প্রতিবন্ধী কিংবা গৃহকাজে নিয়োজিত রয়েছে অনেক শিশু। এই পরিসংখ্যানগুলো আমরা পৃথকভাবে পাইনি, যেটা পাওয়া উচিত ছিল। যেসব পথশিশু যৌন কাজে জড়িত তাদের উদ্ধার করা এবং সুন্দর জীবন দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। আবার গৃহশ্রমে যারা রয়েছে তাদের পরিসংখ্যানটা সব সময় বলা হয় ৪ লাখ,কিন্তু এটা কোনও নির্ভরযোগ্য সংখ্যা নয়। ঢাকায় বসবাসরত ২ কোটি মানুষের ভেতরে ৪৬ শতাংশ বস্তিতে বসবাস করে। এদের আশি শতাংশই আবার বাসা-বাড়িতে কাজ করে এবং তাদের সন্তানেরা স্কুলে যায় না। তাই শুধু পরিসংখ্যান হলে হবে না। জাতীয়ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের ধরণ এবং মাত্রার পরিসংখ্যান থাকা খুব জরুরি। কেননা,নীতি নির্ধারণী পর্যায়েও এখন অনেকে মনে করেন শিশুরা কাজ করবে-এটাই সহজাত। আবার যারা নিয়োগকর্তা রয়েছেন তারাও মনে করেন,আমরা কাজ দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছি। কিন্তু এদের শারীরিক, মানসিক, দৈহিক বা স্পিরিচুয়াল গ্রোথ যে ব্যাহত হচ্ছে, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না, শিশুদের মারধর করছে, বকা দিচ্ছে, যৌন নির্যাতন করছে,আনওয়ান্টেড প্রেগন্যান্ট (অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ) হলে বের করে দিচ্ছে-এ বিষয়গুলো কঠোরভাবে দমন করার জন্য আমাদের কাজ করা জরুরি। তবে এই মুহূর্তে জরুরি হলো, সব ধরনের শিশুশ্রমের সঙ্গে যে শিশুরা রয়েছে তাদেরকে তুলে আনা। তাদের জীবনের পরিবর্তন আনা, যার মাধ্যমে একটা বিকল্প এবং সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা।

বাংলা ট্রিবিউন:পরিবার,সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে এক্ষেত্রে?

ওয়াহিদা বানুর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদক জাকিয়া আহমেদ

ওয়াহিদা বানু: যে বাবা-মা শিশুকে কাজে পাঠাচ্ছে তারা কিন্তু দরিদ্র হবার কারণে সন্তানকে কাজে পাঠায়।তাদেরকেও আয়বর্ধন কর্মকাণ্ডে সহায়তা করতে হবে সরকারকে। বিদ্যালয়ের অনেক খরচ দেওয়ার মতো সামর্থ্য দরিদ্র পরিবারগুলোর নেই,এক্ষেত্রে যদি পরিবারগুলোকে সেভাবে সহযোগিতা দেওয়া যায় তাহলে অবশ্যই তারা সন্তানকে কাজে না পাঠিয়ে স্কুলে পাঠাবে। যদি সরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার হিসেবে ঘোষণা করেন,সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত যে সময়টুকু শিশুদের বিদ্যালয়ে থাকার কথা সেই সময়ে কোনও শিশু কোনও জায়গায় কোনও রকম শ্রমে জড়িত থাকতে পারবে না। না কৃষিকাজে, না বিড়ি ফ্যাক্টরিতে, না গার্মেন্ট কারখানায়, না বাসাবাড়িতে। কর্মজীবী শিশুদের যদি বিদ্যালয়ে যাওয়া নিশ্চিত করা যায় তা হলে অর্ধেকের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম কমে আসবে। কারণ,কোনও শিশু যদি দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করে,নিজ সামর্থ্যের বাইরে কাজ করে,বেতন না দেয়,যদি অত্যাচার করা হয়,যদি বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়া হয়,কর্মপরিবেশ যদি ভালো না হয়, তাহলেই তাকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বলা হয়ে থাকে। সরকার যদি শিক্ষা পদ্ধতিকে আধুনিক করে, বিদ্যালয়ের আনন্দময় পরিবেশ,শারীরিক শাস্তিকে বন্ধ করে দেয় তাহলেই শিশুশ্রম কমে যাবে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন-বন্যা,ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের সময় শিশুরা বাড়ি ছাড়া হয়ে যায় উপকূলীয় এলাকাগুলোতে।আবার আদিবাসী, প্রতিবন্ধী শিশুদের দিকেও নজর দেওয়া জরুরি।তারাও যেন কাজ করতে গিয়ে কোনও শোষণ বা নির্যাতনের শিকার না হয়।আবার যারা শ্রমজীবী শিশুদের নিয়ে কাজ করে সরকারি-বেসরকারি কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থা-এদের কারও ভেতরে কোনও কার‌্যকর সমন্বয় নেই, ইফেক্টিভ কো-অর্ডিনেশনটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি। সেই সঙ্গে যেসব সংগঠন কাজ করছে তাদের শিশুশ্রম নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে কিনা, কৌশল-অঙ্গীকার রয়েছে কিনা এ বিষয়গুলোও দেখা দরকার। তা নাহলে ইচ্ছে মতো প্রজেক্ট খুলে বসার সম্ভাবনাও থেকে যাবে-এতে করে আমরা হয়তো শ্রমজীবী শিশুর সেই পরিসংখ্যানটাই পাবো। কিন্তু তাদের জীবনে গুণগত কোনও পরিবর্তন আসবে না। শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে এ ক্ষেত্রে কঠোর মনিটরিং দরকার,একটি ইউনিট দরকার যারা দেখবে কাজগুলো ঠিকমতো হচ্ছে কিনা। শিশুশ্রম বন্ধে পিতা-মাতা এবং নিয়োগকর্তার ভূমিকা অনেক বেশি। সমাজে তাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।এলাকাভিত্তিক, কমিউনিটিভিত্তিক সচেতনতাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যে শিশু যে এলাকায় কাজ করছে, সেই এলাকার সাধারণ মানুষ,স্কুল,হাসপাতাল,স্থানীয় প্রশাসন মিলে যদি শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিতে এগিয়ে আসে তাহলে একটা বড় পরিবর্তন আসবে।তারা দেখবে,কম বয়সী কোনও শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করবে না, কম বয়সে বিয়ে হবে না, কোন শিশু স্কুলের বাইরে থাকবে না,পাচারের শিকার হবে না,এলাকার মানুষের দায়বদ্ধতা থাকবে এতে। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদেরও বড় ভূমিকা রয়েছে বলে আমি মনে করি। তাদেরও এসব বিষয় দেখভালের দায়িত্ব রয়েছে। সব মিলিয়ে যদি সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারি এবং যে বাজেট বরাদ্দ থাকে তা যথাযথভাবে খরচ হয় তা হলে আমি মনে করি অনেক তাড়াতাড়ি দেশ থেকে শিশুশ্রম নিরসন করতে পারবো বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে শিশুদের উদ্ধার করতে পারবো।

আরও পড়ুন: দেশে ৭৪ লাখ শিশু শ্রমিক!

জেএ/ এমএসএম / আপ-  এপিএইচ/   

সম্পর্কিত
বাংলা ট্রিবিউনকে ওয়াসিকা আয়শা খান‘নারীরা যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়ে চলেছেন, এর নেপথ্যে শেখ হাসিনা’
‘মেয়েদের নিয়ে কেউই ঝুঁকি নিতে চায় না’
নারী দিবস উপলক্ষে একান্ত সাক্ষাৎকারে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী১৫ বছরে নারী শক্তির জাগরণ হয়েছে
সর্বশেষ খবর
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’