X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

নিপীড়নের কষাঘাতে নিষ্পেষিত অসংখ্য শিশুর জীবন

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ
১৩ জুন ২০১৬, ১৬:০৩আপডেট : ১৩ জুন ২০১৬, ১৬:০৫

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ ২০১৫ সাল নাগাদ দেশের ঝুঁকিপূর্ণ খাতগুলো থেকে শিশুশ্রম শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি থাকলেও এখনও অধিকাংশ ঝুঁকিপূর্ণ খাতগুলোতে শিশু শ্রমিক রয়েছে। সংখ্যাটা বরং দিন দিন জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলছে। সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগের এক হিসাব মতে, দেশের মোট শ্রমিকের ১২ শতাংশই শিশু শ্রমিক। কম মজুরি, মাত্রাতিরিক্ত কায়িক পরিশ্রম ও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম নিয়ে উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে দেশের শিশুশ্রম পরিস্থিতি। শিশুরা এসব কাজে নিয়োজিত থাকে বেঁচে থাকার নিদারুণ অভিলাষে। দু’মুঠো ভাত খাওয়ার প্রত্যাশায়।
বর্তমানে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখে। ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী এ শিশুরা পূর্ণকালীন শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। সব মিলিয়ে দেশে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কোনও না কোনোভাবে শ্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শিশু শ্রম জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহায়তায় ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, যে শিশুরা শ্রমে নিয়োজিত তাদের বড় অংশ স্কুল শিক্ষার বাইরে রয়ে গেছে। আর্থিক অনটন ছাড়াও পরিবারের সহযোগী হয়ে তারা শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে। দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে যে শিশুরা সপ্তাহে ১ ঘণ্টার বেশি কর্মে নিয়োজিত থাকে, তাদের সংখ্যা ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে ১৭ লাখ শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। সব মিলিয়ে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এর আগে ২০০২ সালের হিসাবে দেশে কাজে নিয়োজিত শিশুদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৫ লাখ।
‘দেশে শিশু শ্রমিকের হার মোটেই কমেনি। অনেক শিশুই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। তাদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সেই সঙ্গে বাসা-বাড়িতেও অনেক শিশু কাজ করছে। বিভিন্ন কারখানায় শিশুদের বয়স বাড়িয়ে কর্মে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এসব বিবেচনায় দেশের শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা মোটেই কমেনি।’ এমন মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান এমরানুল হক চৌধুরী। ২০১৬ সালের মধ্যে শিশু শ্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার লক্ষ্য সরকারের থাকলেও, বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এমন একটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর ঘটা করে পালন করা হয় ‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস’।
১৯৯৯ সালের জুন মাসে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ‘শিশু শ্রম নিরসন সনদ ১৮২’ গ্রহণের পর থেকে প্রতি বছর ১২ জুন বিশ্ব শিশু শ্রম প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ২০১৬ সালে এই দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, 'উৎপাদন থেকে পণ্যভোগ,শিশুশ্রম বন্ধ হোক’।

বাংলাদেশের আরও একটি ভয়ানক সমস্যা হচ্ছে শিশু নির্যাতন। শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমনকি পরিবার থেকেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতনের কারণে তারা অনেক সময় বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিজেদের সংযুক্ত করে। ফলে, শিশুরা হচ্ছে যৌন হয়রানি’র শিকার। শিশু পাচার, শোষণ বা শ্রমদাস ও শিশু পতিতা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শিশুদের উৎপাদনমূলক কাজে ব্যবহারে নিয়োগকারীরা উৎসাহিত হচ্ছেন। কারণ, শিশুশ্রমিক সস্তায় অর্থাৎ অর্ধেক পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে।

এছাড়াও বিভিন্ন নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে তাদের দিয়ে যে কোনও কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। এক হিসেব অনুযায়ী, শুধুমাত্র ঢাকামহানগরীতেই প্রায় আড়াই লাখ মেয়ে শিশু শ্রমিক বাসাবাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে। এদের মধ্যে ৯০ শতাংশ ৯ থেকে ১৬ বছর বয়সী। বাসায় কর্মরত মেয়েরা সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। চাকরিদাতা মনিব কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। এসব নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে সহিংসতা,যৌন নিপীড়ন ইত্যাদি। শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত হচ্ছে আরও অনেক ক্ষেত্রে। জাহাজভাঙা, বিড়ি শিল্প, ব্যটারী তৈরির কারখানা, লেদ কারখানা,কাঁচ বা গ্লাস ফ্যাক্টরি, ইট-পাথর ভাঙা, মটরগাড়ি মেরামত, নির্মাণকাজ, পতিতা পল্লীতে। ইউনিসেফের এক জরিপ অনুযায়ী ৪৭টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা জড়িয়ে রয়েছে।

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের উদ্বেগজনক সমস্যা হচ্ছে শিশু ও নারী পাচার। বাংলাদেশে শিশু ও নারী পাচারের সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায় না। এই সব কাজে আন্তর্জাতিক শিশু ও নারী পাচারকারীরা জড়িত। তারা আন্তর্জাতিক থেকে দেশ এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। আঞ্চলিক দালাল চক্র বিভিন্নভাবে অভিভাবকসহ শিশু ও নারীকে বিভিন্ন প্রলোভন, টাকা, বিদেশে চাকরি দেওয়ার নাম করে সংগ্রহ করে। এরা সীমান্ত দিয়ে ভারত, পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যে শিশু-নারী পাচার করে থাকে। এসব শিশু ভারত-পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যে শিশু পতিতা, উটের জকিসহ বিভিন্নভাবে ব্যবহার হয়। বিভিন্ন সূত্র মতে, ধারনা করা হয় যে, প্রতিমাসে বাংলাদেশ থেকে ২০০ থেকে ৫০০ জন নারী ও শিশু পাচার হয়। যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। এদের বেশীর ভাগই ভারত ও পাকিস্তানে শিশু পতিতা হিসেবে এবং পর্ণছবিতে ব্যবহার হয়। শিশুশ্রম জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে সব মিলিয়ে শ্রমে নিয়োজিত ২৪ লাখ ৭০ হাজার শিশু রয়েছে গ্রামীণ অঞ্চলে। শহরে এই সংখ্যা ৫ লাখ ৭০ হাজার এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার। ২১ লাখ ছেলে শিশু শ্রম দিচ্ছে, অন্যদিকে মেয়েদের সংখ্যা হলো সাড়ে ১৩ লাখ। কর্মে নিয়োজিত শিশুদের ৩১ ভাগ স্কুলে যাচ্ছে। পরিবারের অসহযোগিতার কারণে এক-তৃতীয়াংশ শিশু কখনোই স্কুলে যেতে পারছে না। এর বাইরে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিশুর পরিবার পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে পারছে না। প্রতিবেদন অনুযায়ী দিনে গড়ে একটি শিশু সাড়ে ৬ ঘণ্টা কাজ করছে। মাসে আয় করছে মাত্র ৫ হাজার ৯শ টাকা। সিটি করপোরেশনে তাদের আয় বেশি, গড়ে ৭ হাজার ১শ টাকা। গ্রামীণ এলাকায় গড়ে আয় করছে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। কর্মক্ষেত্রে দুষিত পরিবেশে কাজ করছে ১৭ শতাংশ শিশু। ১৭ শতাংশ শিশু তাদের কর্মক্ষেত্রে মালিক দ্বারা শাসিত হয় এবং নির্যাতিত। আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো, আড়াই শতাংশ শিশু কর্মক্ষেত্রে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। সব মিলিয়ে কন্যা শিশুদের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ যৌন নিগ্রহের শিকার।

২০১৩ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৩৫ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে। শিশু শ্রমিক নিয়ে দেশে আইন থাকলেও কমেনি ঝুঁকি। বন্ধ হয়নি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও-র সর্বশেষ এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৮০টি দেশে প্রতি ৬ জন শিশুর মধ্যে ১ জন শ্রমিক এবং প্রতি ৩ শিশু শ্রমিকের মধ্যে ২ জনই গৃহকর্মের সঙ্গে যুক্ত। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই গৃহকর্মী এ সকল শিশুদের সুরক্ষায় তেমন কোনও ব্যবস্থা নেই। আইএলও-র হিসাবে সারা বিশ্বে প্রায় ২৪ কোটি ৬০ লাখ শিশু নানাভাবে শ্রম বিক্রি করছে। তার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে ১৮ কোটি। আইএলও-র হিসাবে যে সংখ্যা দেওয়া হয়, বাস্তবে তার সংখ্যা আরও বেশি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশুশ্রম পুরোপুরিভাবে বন্ধ করা সম্ভব নয়। কেননা, অনেক শিশুর জীবনে বেঁচে থাকার পূর্বশর্ত হচ্ছে শ্রম বিনিয়োগ করা। তার পারিবারিক অস্বচ্ছলতা তাকে বাধ্য হয়ে শ্রমিক করে তোলে। কিন্তু আমরা জানি প্রতিটা শিশু জন্মগ্রহণ করে স্বাভাবিক কিছু অধিকার নিয়ে। এই অধিকারগুলো আইন দ্বারা রক্ষিত থাকা সত্ত্বেও আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে দিতে পারছি না সুন্দর একটি জীবনের স্বপ্ন। সুন্দরভাবে বিকাশের জন্য প্রতিটি শিশুর প্রয়োজন হয় পরিচর্যা ও আদর ভালোবাসা। লেখাপড়া ও খেলাধুলা শিশুর জন্য একান্তভাবে জরুরি। যে শিশু এইসব থেকে বঞ্চিত হয়, যার শৈশব থেকে কেড়ে নেওয়া হয় আনন্দমুখর দিনগুলোকে, তার নিকট থেকে এ সমাজ বঞ্চিত হবে বৃহৎ কোন কল্যাণের। আমরা আমাদের এই সম্পদকে যথাযোগ্যভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা যদি করি, তবেই একদিন এ দেশে মানুষ সাফল্য অর্জন করবে। দেশ হবে সোনার বাংলা। তাই  শিশুশ্রম প্রতিরোধে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের। আজকের শিশু, আগামীর ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতের স্বার্থে প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।।

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’