X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে তো আপনার কী,আপনে ঘুমান’

উদিসা ইসলাম
১৫ জুন ২০১৬, ১৫:৫৮আপডেট : ১৫ জুন ২০১৬, ১৬:২৩

প্রশান্ত আচার্জি

সম্প্রতি প্রশ্নপত্র ফাঁস-এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক নয়জনের মধ্যে ইকরাম হোসেন একজন, যার ফেসবুকে আহমেদ নিলয় নামে আইডি রয়েছে।তিনি বরাবরই ফেসবুকের এই আইডিতে প্রশ্নপত্র প্রকাশ করে ‘তার কেউ কিছু করতে পারবেন না’ বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতেন। এই আহমেদ নিলয়ের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রথম প্রকাশ করে ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস মানি না, মানব না’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ। কিন্তু তখন তাদের কথা কেউ শুনতে চায়নি। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা সংক্রান্ত কন্ট্রোল রুম, বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ড, জাতীয় মনিটরিং কমিটির সদস্যগণ, র‌্যাব, পুলিশ, বিটিআরসির কর্মকর্তা এবং মিডিয়ায় ইমেইলে পাঠিয়ে, এমনকি শিক্ষাবোর্ডে জানালে, সেখান থেকে পাল্টা পরামর্শ আসে- ‘গুজবে কান দেবেন না।’

হুবহু মিলে যাওয়ার পর গণমাধ্যমে খবর দিয়েও এনিয়ে কারও মনোযোগে খুব বেশি নাড়া দিতে পারেননি তারা। বরং পাল্টা জবাব পেয়েছেন পত্রিকা অফিস থেকে, ‘প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে তো হয়েছে, আপনার কী, আপনে ঘুমান।’ তারপরও গত দুবছর একটানা নিয়ম করে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ, কোন আইডি থেকে ফেসবুকে আসলো সেসব তথ্যসহ শিক্ষাবোর্ডের কন্ট্রোলরুমে পাঠিয়েছেন ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস মানি না, মানব না’ ফেসবুক গ্রুপের কয়েকজন যুবক। তাদেরই একজন প্রশান্ত আচার্জি কথা বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ভেবেছিলাম শিক্ষাবোর্ড আমাদের অভিযোগগুলো আমলে নেবে, কথা শুনবে, শোনেনি। বরং আমাদেরকে গুজবে কান না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে আমরাও কিছুটা হতাশ হয়েছি। তারপরও আমরা প্রমাণগুলো নিয়ে ডকুমেন্টেশনের কাজ করেছি।

শহীদ মিনারে অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের প্রতিবাদ

আপনারা কেন এবং কীভাবে আপনাদের এই গ্রুপটা শুরু করলেন?

আমাদের কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষার সময়। এর কয়েক বছর আগে থেকেই বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ শোনা যাচ্ছিলো। কিন্তু কেউ প্রমাণসহ কোনও অভিযোগ করছিল না। সেবার ইংরেজি পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠে। তখন কিছুটা কৌতূহলী হয়ে আমরা অনেকে ফাঁস প্রশ্ন প্রমাণ হিসেবে সংগ্রহ করি। এবং পরীক্ষা শেষে মূল প্রশ্নের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি, অভিযোগ সত্য। আরও কয়েকটা পরীক্ষার পর আবারও দেখি একই অবস্থা। আমরা তখনও বুঝতে পারিনি কিভাবে কি করব? কার কাছে অভিযোগ করব, কি করব কিছুই জানি না। তখনই একটা ফেসবুকের মাধ্যমে কয়েকজন একত্রিত হলাম। আমরা ঠিক করলাম সব প্রমাণ  শিক্ষা বোর্ড এবং মিডিয়ার কাছে পাঠাবো। প্রথমদিকে আমরা সব প্রমাণ ইমেইলের মাধ্যম  পাঠাই। এরমধ্যে সবচেয়ে হতাশাজনক ব্যাপার হচ্ছে, মিডিয়া প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে পুরোপুরি চুপচাপ। এটা ২০১৪ সালের কথা। এমনও হয়েছে, একটা জাতীয় দৈনিকে আমি ফোন করে জানিয়েছিলাম, আগামী কালের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আপনারা যদি একটু খতিয়ে দেখতেন। সেখান থেকে আমাকে উত্তর দেয়, ‘প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে তো হয়েছে। আপনার কি? আপনে ঘুমান।’

পরীক্ষার আগের দিন রাতে ফাঁস প্রশ্ন প্রমাণ হিসেবে সরবরাহ করার পরও কোনও উত্তর নেই। তখন শিক্ষাবোর্ডগুলোরও একই অবস্থা। তারপরও আমরা মেইল করি। কোনও জবাব আসে না। কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। প্রশাসন থেকে বলা হয়, প্রশ্ন ফাঁস গুজব। এরমধ্যে আমরা  প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ নিয়ে একদিন শহীদ মিনারে অবস্থান করি।

এরপর কিছুদিনের মধ্যে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে একটা কলাম লিখলে সবাই একটু নড়েচড়ে উঠে। আমরাও আমাদের মেইল করা অব্যাহত রাখি। কিন্তু কোনও কিছুই পরিবর্তন হয় না। স্যারকে আমরা সব প্রমাণ, অর্থাৎ ফাঁস প্রশ্ন যে পরীক্ষার আগে বের হয়েছে এবং সেই ফাসঁ প্রশ্ন প্রশাসনের কাছে আমরা পরীক্ষার আগের দিন রাতেই মেইল করছি, সেই প্রমাণাদি দেই। স্যার সেগুলো মিডিয়াকে দেন। কিন্তু তারপরও প্রশাসন বলতে থাকে, ‘প্রশ্ন ফাঁস একটি গুজব, আমাদের কাছে এই ব্যাপারে কোনও প্রমাণ নেই। যা আছে সব সাজেশান।’ অথচ ফাঁস প্রশ্ন সেবার শতভাগ মিলে যাচ্ছিলো। তখন আমরা চরম হতাশার ভেতরেও আমাদের কাজটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

সম্প্রতি প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে আটক নয়জনের মধ্যে সেই আহমেদ নিলয় আছেন। তাকে আপনারা ট্র্যাক করছিলেন কী উপায়ে?

আমরা ফেসবুকে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপে, পেইজে খোঁজ খবর রাখা শুরু করি। সেরকম এক জায়গা থেকে আহমেদ নিলয়ের খোঁজ পাই।

তিনি তো নিয়মিতই প্রশ্ন ফাঁস করতেন, আপনারা তার বিপরীতে কী করতেন?

আমরা আহমেদ নিলয় -এর পেইজে প্রকাশ হওয়া ফাঁস প্রশ্ন এবং অন্যান্য উৎস থেকে প্রকাশিত ফাঁস প্রশ্ন একত্রিত করে শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা সংক্রান্ত কন্ট্রোল রুম, বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ড, জাতীয় মনিটরিং কমিটির সদস্যগণ, র‌্যাব, পুলিশ, বিটিআরসি কর্মকর্তা এবং মিডিয়ার ঠিকানায় মেইল করতাম যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। মেইলটা পরীক্ষা শুরু আগেই করতাম। আর নিজেরা সব প্রমাণ সংরক্ষণ রাখতাম। পরীক্ষার পর মিলিয়ে দেখতাম ফাঁস প্রশ্ন মিলেছে কিনা। মিলে গেলে একটা ফলোআপ মেইলে জানাতাম যে, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আপনারা ব্যবস্থা নিন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনও পজেটিভ রিপ্লাই আমরা পাইনি। বরং বরিশাল বোর্ড থেকে একবার আমাদের জানায়, ‘গুজবে কান দেবেন না । বিভ্রান্তি ছড়ানো থেকে বিরত থাকুন।’ এটা কিভাবে বিভ্রান্তি হয় আমরা জানি না! যেখানে পরীক্ষার আগেই ফাঁস প্রশ্ন পাঠানো হচ্ছে, পরীক্ষার পর সেটা মিলে যাচ্ছে।’

প্রশ্ন ফাঁসের প্রতিবাদ

কিন্তু প্রশাসনতো পরীক্ষা সংক্রান্ত কন্ট্রোল রুম করলো?

হ্যা, আসছি সেদিকে। সেইবার প্রথম দিকে প্রশাসন প্রশ্ন ফাঁসকে গুজব বলে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু যখন সব প্রমাণ হাজির করা হয়, তখন প্রশ্ন ফাঁস মেনে নিয়ে প্রশাসন পরীক্ষা সংক্রান্ত কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে। এই কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব ছিল পরীক্ষার আগে কেউ প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পাঠালে, সেই তথ্য অনুযায়ী প্রশ্ন ফাঁস বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত জেএসসি,এসএসসি, এইচএসসির বিভিন্ন পরীক্ষায় আমরা প্রমাণসহ মেইল করে গেলেও প্রশাসন কোনও ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি। প্রশ্ন ফাঁস নতুন কিছু না। গত কয়েক বছর ধরে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। আমরা অল্প কয়েকজন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সেগুলোর প্রমাণ সংগ্রহ করে প্রশাসনকে পাঠাই। কিন্তু সেই তথ্য ব্যবহার করে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে প্রশাসনের কোনও সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না।

সেইদিক থেকে আহমেদ নিলয়সহ অন্যদের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে একটা কিছু উদ্যোগতো নেওয়া হলো। যিনি ঘোষণা দিয়ে ফাঁস করেছিলেন এবং তাকে ধরা হয়েছে।নিশ্চয়ই অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়েছে। আপনার কি মনে হয়, এটা সিরিয়াসলি নেওয়া হচ্ছে না?

এটা যতটা সিরিয়াস বিষয় ততটা সিরিয়াসলি নেওয়া হচ্ছে না। এই মুহূর্তে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ৩টা সমস্যার লিস্ট করা হলে, এটা সেই তালিকায় থাকবেই। শুধুমাত্র যে এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাসঁ হচ্ছে তা কিন্তু না। এসএসসি, জেএসসি এমনকি আমাদের বাচ্চাদের পিএসসি পরীক্ষাও বাদ যাচ্ছে না। একটা বাচ্চা যদি ছোট বয়স থেকে এসব পাবলিক পরীক্ষায় দুর্নীতির এমন মহোৎসব দেখে তাহলে সে সৎ হওয়ার অনুপ্রেরণাটা পাবে কোথায়? এই একটা ঘটনাই তো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, নৈতিকতা ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

এমন একটা সিরিয়াস প্রবলেম এত হালকাভাবে নিলে তো হবে না। প্রশাসনে ইমেইল করা হলেও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফাঁস করা প্রশ্নের সেট দেখে চাইলে পরীক্ষার হলে অন্য সেটের প্রশ্ন কিন্তু দিতে পারে। সেটা দিচ্ছে না। একটা পরীক্ষায় না হয় প্রশ্ন ফাঁস হলে মানা যায়। পরের গুলো থেকে তো ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তা কিন্তু নেওয়া হচ্ছে না। আর এক আহমেদ নিলয়কে গ্রেফতার করে কী হবে? আরও তো প্রশ্ন ফাঁসের উৎস আছে। ওরাও গ্রেফতার হওয়া দরকার। ওদের ফোন নম্বর পেইজে দেওয়া থাকে। সেদিকে কোনও নজর নেই। আর এখন যেভাবে পরীক্ষার আগে মূল প্রশ্নের ছবি তুলে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে, সেখানে সিস্টেমকে আরও ডায়নামিক করা প্রয়োজন। এই ব্যাপারে বুয়েটের কায়কোবাদ স্যার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যাররা পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্নের সেট তৈরি করে ইমেইলের মাধ্যমে কেন্দ্রে পাঠিয়ে প্রিন্ট করার একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সে ব্যাপারে কোনও অগ্রগতি নেই। মূল কথা, এটা যত বড় সমস্যা সেই মাত্রায় গুরত্ব পাচ্ছে না। যার কারণে সব ঢিমেতালে এগুচ্ছে।

এপিএইচ/

আরও পড়ুন: 
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা: সাহসী পদক্ষেপ, চ্যালেঞ্জও বেশি

‘ভিনগ্রহে থাকি না, সুবিধা-অসুবিধা আমিও বুঝি’

 

 

সম্পর্কিত
আলাপচারিতায় ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম ও মানস ঘোষমুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবাদ সংগ্রহ
করারোপ নীতি শিক্ষা সম্প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করবে: সলিমুল্লাহ খান
বাংলা ট্রিবিউনকে ওয়াসিকা আয়শা খান‘নারীরা যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়ে চলেছেন, এর নেপথ্যে শেখ হাসিনা’
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী