X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উত্তর আধুনিক মার্কেটিং

জোসেফ মীর
১৯ জুন ২০১৬, ১৫:০৩আপডেট : ১৯ জুন ২০১৬, ১৫:০৬

জোসেফ মীর কুলিন মার্কেটিয়ারদের জন্য ‘ব্র্যান্ড’ হচ্ছে, মধ্যবিত্ত শিক্ষক বাবার ওড়না মুড়ে কলেজ যাওয়া কিশোরী মেয়ে। ক্যাম্পাসে চোখ এড়িয়ে একটু-আধটু হিন্দি নাচ-গান চলতে পারে, কিন্তু পরিচিত গণ্ডিতে ঢুকলেই মাথা নিচু করে থাকবে, মুরুব্বি দেখলে আদাব-সালাম দেবে, তরুণ-যুবক দেখলে রাস্তার অন্যপাশ দিয়ে যাবে, কণ্ঠস্বর নিচু থাকবে, সবার কথা মেনে চলবে ইত্যাদি। তাছাড়া সবকিছুতে কঠোর ধারাবাহিকতা, নিয়মানুবর্তিতা, সঠিক বা সত্য বলা, নিজের সকল গুণকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা ও দুর্বলতা ঢেকে রাখা এগুলো তো আছেই।
‘সাধারণ নির্বাচনে’ প্রার্থীদের মধ্যে জনমানুষ এমন জিনিসই খোঁজেন। তাই সেখানে ব্যক্তি ও পণ্যের মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকে না। দেখা যাচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথাবার্তায় তথ্যের ধারাবাহিকতা (কন্সিসটেন্সি) নেই; তিনি জনগণের জন্য যে সব সুবিধা (প্রোডাক্ট বেনিফিট) আনবেন, তা স্পষ্ট করে বিস্তারিত বলার চেষ্টা নেই, অনেক ক্ষেত্রে তথ্যের যথাযথ সত্যতাও নেই, কখনও কোনোভাবেই নিজের ভুল স্বীকার না করা, খারাপ সঙ্গ (ব্যাড এসোসিয়েশন)- যেমন, বর্ণবাদী কেকেকে (কু ক্লাক্স ক্ল্যান) -এর সাবেক প্রেসিডেন্টের তাকে প্রকাশ্যে সমর্থন, আর সর্বপরি তার আচরণের প্রবণতা হলো, তিনি মানুষের প্রিয় হওয়ার চাইতে সংবাদের শিরোনামে থাকার চেষ্টাই বেশি করেন। সে অর্থে ‘প্রচলিত মার্কেটিং’ ধারণায় ট্রাম্প মহোদয়ের কর্মকাণ্ড তো আত্মহত্যার নামান্তরই বলা যায়। অথচ তিনি সফল। সে সাফল্য শুধু এটুকুতেই নয় যে পেশাদার রাজনীতিবিদ না হয়েও তিনি রিপাবলিকান পার্টি, যাকে লোকে ‘জিওপি’ বা ‘গ্রান্ড ওল্ড পার্টি’ বলে, তার প্রাচীন রাজনৈতিক ঐতিহ্য ভেঙে নমিনেশনের পালক নিজের মুকুটে পড়েছেন; তিনি নির্বাচন ও মার্কেটিং নিয়ে সাধারণভাবে প্রচলিত ও জনপ্রিয় সকল মতামতগুলোকে জবর একটা ধাক্কা দিয়েছেন।
তিনি তাহলে করেছেনটা কী? প্রাথমিক দৃষ্টিতে তার কর্মকাণ্ড দেখে অনেকে ‘পাগলামী’, ‘ধোপে টিকবেনা’ এমন ধারণা করলেও; এখন এগুলোর মধ্যে সবাই একটা প্যাটার্ন আবিষ্কার করা শুরু করেছেন। প্রথমত, তিনি তার ‘চরিত্র’ বা ‘ব্র্যান্ড ইমেজ’কে সবাই যাতে বুঝতে পারে এমন একটা আকার দেওয়া শুরু করেছেন।  মনে যা আছে মুখের ওপর তা বলে দেন। ভদ্রলোক বা রাজনীতিবীদের মেকি বিনয় সেখানে নেই। রিপাবলিকানদের বিতর্ক অনুষ্ঠানগুলোতে তিনি রীতিমতো অভদ্র, উদাহরণ নেই এমন ভাষায় অন্য প্রার্থীদের আক্রমণ করে তাদের সব প্রস্তুতির ছক ভেঙে দিয়েছেন। সাধারণ অবস্থায় মানুষ বা ব্র্যান্ড যখন অন্যের আক্রমণের শিকার হয়, সে একটু পিছিয়ে, গুছিয়ে প্রতি-আক্রমণের সুযোগ খোঁজে। ট্রাম্প সেখানে পিছানো বা সময় নেওয়া তো দূরে থাক, যুক্তি-কুযুক্তি দিয়ে হাতের কাছে যা পেয়েছেন তা দিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তিনি বলেছেন- ‘রাজনীতিবিদদের শুধু কথাই আছে, অ্যাকশান নেই’। ‘আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ’ আর ‘ব্র্যান্ডিং’ -এর এই যুগে নির্ভীকভাবে তিনি তার মত প্রকাশ করেছেন, মুখের কথা দিয়েই সেই ‘অ্যাকশান’ দেখিয়ে দিয়েছেন, সেখানে কোনও দ্বিধা দেখাননি। তার মূল শ্লোগান ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’- কে মোটা দাগে এবং উচ্চগ্রামে সাধারণ মানুষের সামনে এমন ভাবে এনেছেন, যে তারা তার সামগ্রিক পরিকল্পনাটা আসলে যে কী (?) তা নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছেন না। এগুলো মিলিয়ে সবাই তাকে ‘একটু অপরিশিলিত হলেও খাঁটি মানুষ’ বলে মানছেন এবং মানুষ হিসেবে ‘তিনি এমনটাই’ মনে করে পছন্দও করছেন। দ্বিতীয় আরেকটা বিষয় আছে। সচেতনভাবে হোক আর অসচতনভাবে (সে সম্ভাবনা কম) হোক, তিনি একটি মার্কেটিং রীতি অনুসরণ করছেন। যাকে পোস্টমর্ডান মার্কেটিং বলে। মর্ডান বা আধুনিক বিষয়টি উনিশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের শুরুর দিকে ডালপালা মেলে। যন্ত্রশিল্পের দ্রুত প্রসার, গ্রাম থেকে নগর সভ্যতার উত্থান আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভৎস অভিজ্ঞতা থেকে এই চিন্তার উদ্ভব। মর্ডানিজম এসেই সকল প্রচলিত দর্শন, সাহিত্য, শিল্প, স্থাপত্যবিদ্যা, ধর্মমত, সামাজিক সংগঠন পুরাতন বলে বাতিল করা শুরু করে। নতুন অর্থনীতি, নতুন সমাজ ও রাজনৈতিক কাঠামোতে এক নতুন আদর্শ চিন্তার দাবি জানায়।

সবকিছুকে অস্বীকার করার এই মতের বিপরিতে বিংশ শতকের শেষ ভাগে ‘পোস্টমর্ডান’ বা ‘উত্তর আধুনিক’ চিন্তার জন্ম হয়। যার মতে আধুনিকতার নামে আমরা ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি এবং জনমানুষের চিন্তা, বিশ্বাস, তার স্বাভাবিক বিকাশকে অগ্রাহ্য করছি। পোস্টমর্ডান মার্কেটিং ধারণাটা পোস্টমর্ডানিজমের শিল্প ও দর্শন থেকে এসেছে। অধ্যাপক বার্নাড ক্যোভা’র ধারণায় পোস্টমর্ডান মার্কেটিং-এ মার্কেটিংকে যথাসম্ভব সাধারণ ভোক্তা ব্যক্তির কাছাকাছি নামিয়ে আনা। কনজ্যুমারের নিজস্বতাকে শনাক্ত করা, অনুধাবন করা, স্বীকৃতি দেওয়া এবং সেই অনুযায়ী তাকে সেবা দেওয়া। পোস্টমর্ডান মার্কেটিং-এ ব্র্যান্ড তার কনজ্যুমারের মতো একই ভাবনা-মত-আবেগ ধারণ করে এবং তার (ব্র্যান্ড) দিকে তাকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। ট্রাম্প সাহেবও এ পথে হাঁটছেন। তিনি আম-আমেরিকানের চিন্তার সুরে কথা বলছেন, যারা মনে করেন তারা অবহেলিত এবং পিছিয়ে আছেন। যারা তাদের নিরাপত্তা, চাকরির সুযোগ, ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম শঙ্কায় আছেন। তিনি তাদের আশ্বস্ত করেছেন, বলছেন- ‘আমি জানি আপনারা ক্ষুব্ধ আর আমিও আপনাদের মতো’। তিনি জনসাধারণের মুখের কথা, হোক তা অভদ্রচিত, মঞ্চে তুলে এনেছেন। ভাবটি এমন যে, তিনি তাদের ও তাদের আবেগের প্রতিনিধিত্ব করছেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি খুব সরলভাবে সাধারণের বোধগম্য ভাষাতে কথা বলেন। তার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিগুলোও তাই একদম সহজবোধ্য, অলংকারহীন এবং সরাসরি।

মূল কথা- আমেরিকাকে আবার তার ‘মহান অবস্থানে’ নিয়ে আসবেন। এজন্য তার সরল ৭টি প্রতিশ্রুতি- ১) মেক্সিকো সীমানায় প্রাচীর তোলার ব্যয় ২) স্বাস্থ্যনীতি সংস্কার ৩) ইউএস-চায়না বাণিজ্যনীতি সংস্কার ৪) প্রবীন কল্যাণ ব্যবস্থা সংস্কার ৫) ট্যাক্স সংস্কার ৬) সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী বহাল (যেটি নাগরিকের আগ্নেয়াস্ত্রের অধিকার বিষয়ক) ও ৭) অভিবাসন নীতি সংস্কার। যা একটা বড় জনগোষ্ঠীর ভাবনা ও আবেগকে বহন করে।

তিনি তার চরিত্রে অনমনীয়-দৃঢ় এক ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরেছেন। যে চরিত্র হার মানবে না, ভুল হলেও মাথা নিচু করবে না, আমেরিকার বিশ্ব-নেতার চরিত্র সমুন্নত রাখবে। পোস্টমর্ডান মার্কেটিং-এর উপস্থিতি তার প্রচার কৌশলের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে বিরাজ করছে। যার কাছে রিপাবলিকান পার্টির অন্য সকল প্রার্থী- টেড ক্রুজ, মার্কো রুবিও, জেব বুশরা খাবি খেয়ে পথ হারিয়েছেন। এমনকি ডেমক্রেটদের হিলারিও সাম্প্রতিক জরিপে পিছিয়ে পড়েছেন। ট্রাম্পকে ঘৃণা করুন, পাগল বলুন, ভয় পান কিন্তু তার জনপ্রিয়তা এবং শীর্ষে পৌঁছানোর কৌশলকে অস্বীকার করার কোনও সুযোগই নেই। সুতরাং ট্রাম্পতন্ত্রের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন। আর এজন্যই এখন ব্র্যান্ড বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাড়ির মেয়েটাকে শুধু শুধু রেওয়াজের শিকলে বাঁধবেন না। বরং তাকে স্বাধীন আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে বড় হওয়ার সুযোগটা করে দিন। আখেরে লাভটা আপনারই হবে।

সূত্র: দ্য পোস্টমর্ডান এক্সপ্লেইন টু ম্যানেজারস- বার্নাড কোভা-, ডোনাল্ড জে ট্রাম্প ডট কম, এড এজ, উইকিপিডিয়া, শিল্পকলার ইতিহাস- কামাল আহমেদ

লেখক: ক্রিয়েটিভ ডিরেকটর, পার্ল কমিউনিকেশনস

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মীনা বাজার এখন মিরপুর-১২ নম্বরে
মীনা বাজার এখন মিরপুর-১২ নম্বরে
কুবিতে উপাচার্য-ট্রেজারার-প্রক্টরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, ৩ দফতরে তালা
কুবিতে উপাচার্য-ট্রেজারার-প্রক্টরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, ৩ দফতরে তালা
ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে: ম্যাক্রোঁ
ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে: ম্যাক্রোঁ
রবিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে, শনিবারও ক্লাস চলবে
রবিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে, শনিবারও ক্লাস চলবে
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা