X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

তরুণদের নষ্ট হওয়ার পেছনে দায় কার?

শেখ নোমান পারভেজ
১৮ জুলাই ২০১৬, ১৬:০২আপডেট : ১৮ জুলাই ২০১৬, ১৬:০৪

শেখ নোমান পারভেজগুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় গোটা জাতি বিস্মিত। দেশের সকল মানুষ শোকে কাতর। এই রকম ঘটনায় কী করা উচিত, কিভাবে ভাব প্রকাশ করা উচিৎ তা কল্পনাও করা যাচ্ছে না, তারপরেও ১ জুলাইয়ের জঙ্গি হামলার মতো এরকম ঘটনায় দুই দিন রাষ্ট্রীয় শোকের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এবং সমস্ত জাতি শোক প্রকাশ করেছে।
ঈদের ছুটি থাকলেও সমস্ত শ্রেণিপেশার মানুষের কথা বলার বিষয় ছিল ‘হলি আর্টিজানে হামলা’ এবং পাশাপাশি জঙ্গি সম্পৃক্ততার যাচাই বাছাই। কিন্তু জনমনে দ্বিধার অন্ত ছিল না, কারণ জঙ্গি বলতে আগে ধারণা করে নেওয়া হতো এরা মাদ্রাসা ছাত্র কিংবা কট্টর চরমপন্থি হবে। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’ এই পাঁচ জঙ্গির ছবি প্রকাশ করেছে, তাদের একজন বাদে কেউই মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত নয় কিংবা এইরকম উগ্রবাদী চরমপন্থির সঙ্গে সম্পৃক্ততার সন্দেহ তাদের থেকে আসার প্রশ্নই ওঠেনা। তারা সবাই সমাজের উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান, আভিজাত্যের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা এবং উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে লালিত পালিত হওয়া সন্তান। রাজধানীর বিভিন্ন সেরা মানের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ধরেই নেওয়া হয়, এই রকম বিত্তশালী পারিবারিক অবস্থান থেকে নিবরাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজ, মীর সামি মোবাশ্বের এর মতো তরুণেরা সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে। কিন্তু গুলশান হামলার পর প্রশ্ন আসে একটি রাষ্ট্রে তারুণ্য কেন এভাবে নষ্ট হবে? যে জাতি সাম্প্রদায়িক চিন্তা ভাবনাকে মুছে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত, সেই দেশে তারুণ্য এমন ঘটনা কিভাবে ঘটাতে পারে? যে দেশের ১৬ কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, সে দেশে ধর্মের দর্শনকে অপব্যবহার করে তরুণেরা কিশের আশায় জঙ্গি হতে চায়? এবং কিভাবে এই বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চালায়? প্রশ্নগুলো শুধু আমাকে বিচলিত করে না, সাথে সাথে আমি ভয়ও পেয়ে যাই। হামলার পরেই বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে বারবার হামলার হুমকি আসে তখন রীতিমত আমি থমকে যাই এই ভেবে যে, পারস্পারিক ঘটনাগুলোকে শুধুমাত্র সমস্যা বা আইনের ভাষায় অপরাধ এড়িয়ে যেতে পারি না। এই সাধারণ স্বাভাবিক মানুষের জীবন থেকে ধর্মীয় উগ্রপন্থীতে রূপান্তর হওয়ার দায়, পাশাপাশি এর উৎপত্তির কারণ ও ফলাফল এই সমাজ তথা রাষ্ট্র এড়াতে পারে না।

সাইট ইনটেলিজেন্সের প্রকাশিত তথ্য এবং হত্যাকাণ্ডের পর প্রকাশিত ছবি অনুযায়ী ধারণা করা হয় তারা আইএস সদস্য। এখন চিন্তার জায়গাটি হল তারা কিভাবে জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হলো? আইএস-এর পাঠানো অনলাইন বার্তা, লিফলেট এই তরুণদের সুন্দর জীবন থেকে সরে এসে সাম্প্রদায়িকতার দ্বন্দে ফেলে দেয়, একটি রোমান্টিসিজম বা মিথ্যে হেরোইজমের নেশায় তারা ইসলামভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে প্রলুব্ধ হয়। কিন্তু শুধুমাত্র কি জঙ্গি সংগঠন গুলোর একতরফা চেষ্টায় আমাদের মেধাবী তরুণরা জঙ্গি হয়ে ওঠে? এক থেকে দুই বছর আগে চাঞ্চল্যকর আনন্দমুখর সময় পার করা ছেলেগুলো ছয় মাস, এক বছরের মধ্যে মগজ ধোলাইয়ে কখনোই এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব না।

এর দায় আসলে কার? এর দায় আমাদের পচে যাওয়া সমাজ ব্যবস্থার। আমাদের পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র, আমরা সচেতন মানুষেরা কেউই এই দায় এড়াতে পারবো না। যেই অন্ধ শিক্ষায় মেধাবী ছেলেগুলো জঙ্গি হয়ে উঠলো, সেই অন্ধ শিক্ষার বুনিয়াদ আমরা করেছি, সেটি হয়তো পরিবার থেকে কিংবা সমাজ থেকে। আমরা মরু সংস্কৃতির আদলে যেই সমাজ গড়ে তুলেছে, বাঙালি সংস্কৃতি ও জীবনধারার ভিন্নতা না রেখে যে সমাজ গড়ে তুলছি তার একটি বাই প্রোডাক্ট হচ্ছে বর্তমান তরুণ সমাজ কিংবা ওই অভাগা ছেলেগুলো যারা রেস্টুরেন্টে ঢুকে মানুষ মেরে ফেললো। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি আমাদের তরুণ সমাজ একটি সাংস্কৃতিক সংকটে ভুগছে, এই তরুণদের অধিকাংশ দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগে যে সে কোন সংস্কৃতিকে ধারণ করছে আর কোন সংস্কৃতি বহন করছে। আর এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের জায়গাটিকে অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহার করে জঙ্গি সংগঠনগুলো। এই ছোটখাটো সমস্যাগুলোর নিয়ামক সঙ্গে যুক্ত হয় স্ব স্ব পারিবারিক সমস্যা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানান দ্বন্দ্ব-সংঘাত, স্কুলে অতিরিক্ত চাপ, পাশাপাশি অতিরিক্ত সাফল্য প্রত্যাশার বাড়তি চাপ। এই ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বিষয়গুলো রোমান্টিসিজম ও হিরোইজমে ভুগতে থাকা ছেলেগুলোকে আরও বিপথগামী করে ফেলে, নষ্ট করে দেয় তাদের নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।

আমরা একটি সমস্যার মাঝখানে এসে পড়েছি, এটা সত্যি। আর এই সত্যিকে শুধুমাত্র সন্ত্রাসীরূপ দিয়ে এড়িয়ে গেলে চলবে না। আইন শৃঙ্খলার কঠোর নজরদারির পাশাপাশি থাকতে হবে কিছু গুরত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। রাষ্ট্রযন্ত্রের যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে অবশ্যই সঠিক তথ্য নিতে হবে গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী যে শতাধিক তরুণ বাড়ি থেকে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ আছে, তারা কোথায় কী অবস্থায় আছে। পাশাপাশি গুলশানে হামলায় যে ছেলেগুলো হামলা করেছে, সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে যে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড হচ্ছে তার প্রশিক্ষণ সেন্টার এদেশেই রয়েছে। সেগুলো খুঁজে বের করে ধ্বংস করতে হবে। গুরত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো দেশের সব আর্থিক লেনদেন এর ওপর বিশেষভাবে নজরদারি রাখতে হবে। বৈদেশিক রেমিট্যান্স কিংবা যেকোনও অঙ্কের টাকা বাংলাদেশে প্রবেশের দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে, পাশাপাশি এক্সপার্ট দিয়ে সোশ্যাল ও অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। এখনই সময় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জোরদারভাবে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশজুড়ে অসাম্প্রদায়িকতার মূল্যবোধ তৈরি করা। জঙ্গি ও নাশকতা মূলক যেকোনও হামলার সহযোগী সমস্ত রিসোর্স বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে।

পরিবারকে লক্ষ্য রাখতে হবে সাবালক সন্তান অনলাইনে কী করছে, বা কাদের সঙ্গে মিশছে। গুরত্বপূর্ণভাবে সন্তান কী ধর্মান্ধতার দিকে ঝুঁকছে, তার কথা-বার্তায় বা চাল চলনে এমন কিছু প্রকাশ পাচ্ছে কী না, এসব ব্যাপারে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের এই সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনার প্রসার বৃদ্ধি করতে হবে এবং এতে তরুণসহ টিনএজাদের ও যুক্ত করতে হবে যাতে সাম্প্রদায়ীক কলহ এবং ধর্মান্ধতা সম্পর্কে যেকোনও দ্বিধা শুরুতেই কেটে যায়।

আমরা অসাম্প্রদায়িক জাতি। হামলায় জড়িত সেই তরুণরা শুধুমাত্র আইন ও সমাজের দৃষ্টিতে সাবালক তাই শুধু তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এই দায় আমাদের সবার নিতে হবে। তাদের বেড়ে ওঠার পেছনে এই সমাজব্যবস্থায়ই দায়ী। এখন সমাজব্যবস্থাকে আরও শক্ত করতে হবে। এই যুদ্ধে আমাদের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের, পরিবারের, সমাজের সর্বোপরি রাষ্ট্র পরিচালনার সকল যন্ত্রের সহযোগিতামূলক অংশগ্রহণে জয়ী হতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক। স্কুল অব ল’, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ক্যানসারে আক্রান্ত অভিনেতা রুমি, ভর্তি হাসপাতালে
ক্যানসারে আক্রান্ত অভিনেতা রুমি, ভর্তি হাসপাতালে
বুয়েটে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন শিক্ষার্থীদের
বুয়েটে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন শিক্ষার্থীদের
শিশুশিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারপিট, মাদ্রাসাশিক্ষক আটক
শিশুশিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারপিট, মাদ্রাসাশিক্ষক আটক
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা