X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

রক্তের চেয়ে বড় কোনও বন্ধন হতে পারে না: রক্তদাতা সেঞ্চুরিয়ান জাকারিয়া

জাকিয়া আহমেদ
২৪ জুলাই ২০১৬, ১৮:২৭আপডেট : ২৪ জুলাই ২০১৬, ১৮:৩০

রক্তদাতা জাকারিয়া ‘পৃথিবীকে বাঁধতে হবে রক্তের বন্ধনে। হানাহানির এই দুনিয়ায় এর চেয়ে বড় বন্ধন আর কিছু হতে পারে না’ বলে জানালেন রক্ত দিয়ে সেঞ্চুরি করেছেন যিনি সেই জাকারিয়া বিশ্বাস।
জাকারিয়া বিশ্বাস একজন সেঞ্চুরিয়ান রক্তদাতা। এ পর্যন্ত তিনি ১০০ ব্যাগ রক্ত দিয়ে ফেলেছেন।মানুষকে রক্ত দিয়ে মনের শান্তি খুঁজে পান তিনি। তার রক্তেই আছে মানুষের উপকারের নেশা। বয়সের কারণে চিকিৎসকরা তাকে আর রক্ত না দিতে বলেছেন। কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল। রক্ত দিতে পারবেন না তাতে কী! তারপরও মানুষের জন্য কিছু করতে চান তিনি।
জাকারিয়া বিশ্বাস বলেন, আমি রক্ত দিতে চাই! দিলে কী আর হবে! আমি তো সুস্থই আছি।
শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা হয়, জাকারিয়া বিশ্বাসের সঙ্গে।সেখানেই তিনি বলেন, জীবনে কিছু করতে না পারলে মানুষ হয়ে জন্মানো কেন! আর সব কিছু করতে হলে টাকা থাকতে হবে, তাও নয়।ইচ্ছা থাকলেই মানুষের কল্যাণে কাজ করা যায়!
জাকারিয়া বিশ্বাসকে গত ১৪ জুন ‘নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন দিবসে’ সর্বোচ্চ রক্তদাতা হিসেবে পুরস্কৃত করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। শুধু তাই নয়, এর আগেও তিনি বিভিন্ন সংস্থা থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন।২০১২ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় ‘সর্বোচ্চ স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সম্মাননা ২০১২’, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের উদ্যোগে বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের সম্মাননা ২০১৪, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বোয়ান আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে হামদর্দের পক্ষ থেকে সম্মাননাসহ আরও পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
তবে তিনি জানালেন, পুরস্কার পেয়ে ভালো লাগলেও কাজ করে যেতে চান রক্ত সংগ্রহের।
জাকারিয়া বিশ্বাস খুলনার ঝিনাইখালী গ্রামের হাইস্কুল জেকেএজি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরীর কাজ করতেন। চাকরি শেষ হয়ে যায় ২০১১ সালে।একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।স্ত্রীও মারা গেছেন ১৫ বছর আগে। তারপর আর বিয়ে করেননি তিনি।
রক্ত দেওয়ার কথা বলতেই মেলে ধরলেন কথার ঝাঁপি।
জাকারিয়া বিশ্বাস বলেন, যশোরে আমার সামনেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৮৬ সালে। দুর্ঘটনায় আহত মানুষটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। তখন তার রক্ত দরকার ছিল। সে সময় তাকে রক্ত কিনে দেই। তিনদিন পর আবার তাকে দেখতে যাই। তখন দেখি, সন্ধানী থেকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে হাসপাতালের সামনে।তাদের দেখে সেই যে উৎসাহ পেলাম, সেই যে দেওয়া শুরু করেছি আর থামিনি।
তিনি বলেন, খুলনায় সন্ধানী ছিল না।তখনকার সিভিল সার্জন যিনি ছিলেন তাকে বললাম, খুলনাতে সন্ধানী দরকার। রক্তের দরকার হলে মানুষ কোথায় রক্ত পাবেন। আমি খুলনাতে এমন কিছু একটা করতে চাই যে, রক্তের জন্য মানুষকে আর ভাবতে হবে না।
সিভিল সার্জন দ্বিধা নিয়ে বললেন, তুমি পারবে এটা করতে।আমি তাকে কিছু না বলে কাজ শুরু করলাম, কমিটি করলাম। আমি হলাম সেক্রেটারি আর সভাপতি হলেন তিনি।তখন থেকেই নিয়মিতভাবে এ কাজ করে যাচ্ছি।নিজে রক্ত দিয়ে যাচ্ছি গত ৩০ বছর ধরে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিক্যালে রক্ত দিয়েছি ৪৭ বার। সলিমুল্লাহ মেডিক্যালে ২৮ বার, খুলনায় ১৭ বার। যশোরে চারবারসহ নানা জায়গায় রেডক্রিসেন্টে রক্ত দিয়েছি।আমার ব্লাড গ্রুপ ও পজেটিভ।
কিন্তু এখন আর রক্ত দেওয়া যাবে না বয়সের কারণে জানালেন তিনি।
আর রক্ত দিতে পারবেন না জেনে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জাকারিয়া বিশ্বাস বলেন, ৬০ বছর অতিক্রম করলাম। শুধুমাত্র এই একটি কারণে আর রক্ত দিতে পারবো না, আফসোস হচ্ছে আমার!
তিনি বলেন, কেনও আরও একটু সময় পাচ্ছি না! কেন রক্ত দিতে পারবো না! ঢাকা থেকে খুলনা, খুলনা থেকে ঢাকাতে রক্ত দিয়েছি। সন্ধানী, বাঁধন, রেডক্রিসেন্ট সবার সঙ্গে আমার আত্মার সর্ম্পক! আমার একটা ফোনে তারা সাধ্য মতো চেষ্টা করেন।রক্তের অভাবে যেন কোনও মানুষ মারা না যান। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময়ও অনেককে নিয়ে রক্ত সংগ্রহের কাজ করেছি।
একটা ফাউন্ডেশন নাকি করতে চাচ্ছেন প্রশ্ন করলে জাকারিয়া বিশ্বাস বলেন, ৬০ বছর হয়ে গেছে। চিকিৎসকদের নিষেধাজ্ঞার কারণে যেহেতু নিজে আর রক্ত দিতে পারবো না, তাই নিজে কিছু করার জন্য ‘জাকারিয়া ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ফাউন্ডেশন তৈরির কাজে হাত দিয়েছি। গ্রামের ছেলে, দিনে অন্য কাজ আর রাতে স্কুলে পড়তাম। আমি গরিব মানুষ,আমার অনেক টাকা নেই। ফাউন্ডেশনের জন্য ভবন তৈরি হয়ে গেছে। রক্ত সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ কিনে দিয়ে গেছেন প্রয়াত সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মোহসীন আলী।

প্রয়াত মন্ত্রীর স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন,মন্ত্রী নিজহাতে ফাউন্ডেশনের জন্য ফ্রিজ কিনে আমার কাছে হস্তান্তর করেছেন।

ফাউন্ডেশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রথমে খুলনায় করবো। পরে ধীরে ধীরে এর সম্প্রসারণ কারার ইচ্ছা আছে আমার।কিন্তু কাজ করতে গেলে তো টাকার দরকার হয়।যন্ত্রপাতিসহ নানান কিছু দরকার হয় এই ফাউন্ডেশনের জন্য। রেডক্রিসেন্টের মতো করে এখন এই ফাউন্ডেশনের কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। এজন্য হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি ম্যাগাজিন’ অনুষ্ঠানে গিয়ে দেশের সবার সামনে আমার এই ফাউন্ডেশনের কথা তুলে ধরতে চাই, যেন সবাই এই ফাউন্ডেশনের কাজে এগিয়ে আসেন।

তিনি বলেন, সারা পৃথিবীতে ‘জাকারিয়া ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’ ছড়িয়ে যাবে এই প্রত্যাশা আমার, যেমনটা হয়েছিল রেডক্রিসেন্টের বেলায়।

তিনি বলেন, রক্ত দিলে মানুষের উপকার হয়। নতুন রক্ত তৈরি হয় শরীরে। আর একজন মানুষের যখন রক্তের প্রয়োজন হয়, তখন তাকে রক্ত দিলে যে আনন্দ হয়, পৃথিবীর অন্য কিছুতে সেই আনন্দ আমার হবে বলে মনে হয় না। আমার রক্তে একজন মানুষ বেঁচে উঠছেন এর চেয়ে আনন্দদায়ক আর কী হতে পারে জীবনে! আমার তো মানুষের জন্য অনেক কিছু করার সামর্থ্য নেই; যে টুকু আছে, সেটাকে যদি কাজে না লাগাই তাহলে আর মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়া কেন! মানুষ তো মানুষের জন্যই।

রক্ত দিয়ে নিজে অসুস্থ হননি দাবি করে জাকারিয়া বিশ্বাস বলেন, ৩০ বছর আগে থেকে রক্ত দিচ্ছি, একঘণ্টার জন্যও শুয়ে থাকতে হয়নি, অসুস্থ হইনি। আমার কোনও অসুখ নেই, কোনও নেশাও করি না।

স্বেচ্ছায় রক্তদানের জীবনে কোনও আনন্দময় বা দুঃখের ঘটনার কথা মনে করতে পারেন কি না জানতে চাইলে কিছুক্ষণ ভেবে জাকারিয়া বিশ্বাস বলেন, কয়েক বছর আগে আমি বাড়ি যাচ্ছি। পথে জানলাম দুর্ঘটনায় একই পরিবারের কয়েকজন আহত হয়েছেন। যশোরে নেমেই যশোর সদর হাসপাতালে গেলাম। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পুরো একটি পরিবার হাসপাতালে এসেছে।এর মধ্যে দুইজন নারী,একজন পুরুষ আর এক শিশুর রক্তের দরকার। পরিচয় গোপন করে আমি এক শিশুকে রক্ত দিলাম। এরপর দুই ব্যাগ কিনে দিলাম আর সন্ধানী থেকে আরেক ব্যাগ ফ্রিতে ব্যবস্থা করে দিলাম।

এ ছাড়া একজন এইডস আক্রান্ত নারীকেও রক্ত দিয়েছি। তার সে কী কান্না! আমি চোখ বুজলেও তার কান্না এখনও শুনতে পাই।

জাকারিয়া বিশ্বাস বলেন, ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত, থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত অনেককে রক্ত দিয়েছি। আরেকটি ঘটনা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। সন্তান প্রসবের সময় রক্তের দরকার ছিল তার। সেটি খুলনায়।কোথাও রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। আমাকে হাসপাতাল থেকে ফোন করে। আমি তখন দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলাম। কোনও রকমে হাসপাতালে এসেই রক্ত দিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, খোদা, আমাকে আর ওই মাকে আরেকটু সময় দাও! আমরা আরেকটু সময় পেলে পৃথিবীতে নতুন একজন মানুষ আসবে। সেদিনও খুব আনন্দ হয়েছিল, তাদের সঙ্গে আমার এখনও যোগাযোগ রয়েছে।

এ প্রজন্মের জন্য কী পরামর্শ দেবেন জানতে চাইলে স্বেচ্ছায় রক্তদাতা জাকারিয়া বিশ্বাস বলেন, আমি যেখানেই যাই, সেখানেই কাজ করি। মানুষের জন্য কাজ করার মতো মহৎ কিছু পৃথিবীতে আর নেই! তরুণ প্রজন্মকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ হতে হবে আর যে কোনও ধরনের নেশা থেকে দূরে থাকতে হবে। পৃথিবীকে বাঁধতে হবে রক্তের বন্ধনে। হানাহানির এই দুনিয়ায় এর চেয়ে বড় বন্ধন আর কিছু হতে পারে না!

/জেএ/এবি/

সম্পর্কিত
আলাপচারিতায় ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম ও মানস ঘোষমুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবাদ সংগ্রহ
করারোপ নীতি শিক্ষা সম্প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করবে: সলিমুল্লাহ খান
বাংলা ট্রিবিউনকে ওয়াসিকা আয়শা খান‘নারীরা যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়ে চলেছেন, এর নেপথ্যে শেখ হাসিনা’
সর্বশেষ খবর
দলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
উপজেলা নির্বাচনদলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক