‘জঙ্গলের মধ্যে হাত-পা বেঁধে বুক সমান পানিতে নামিয়ে রাখে সারারাত। এর মধ্যে বৃষ্টি পানি মুখে পড়ছে। দম নিতে পারছিলাম না। হাত-ও বাঁধা, পা-ও বাঁধা। না পারছিলাম মুখ থেইক্যা পানি মুছতে, না পারছিলাম উপরে উঠতে। একেকটা সেকেন্ড যায়, মনে হয় মইরা যাইতেছি।’ এভাবেই নিষ্ঠুর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মালয়েশিয়ায় অপহৃত বাঙালি মো. মাহবুব আলম।
মালয়েশিয়ান দূতাবাস, বায়রা ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় মালয়েশিয়া থেকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনে র্যাব। পরে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে অপহৃত অবস্থায় যে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তার বর্ণনা দেন মাহবুব।
এ সময় তিনি জানান, তার গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার চর আইশাতে। ২০০৭ সালে উন্নত জীবনের আশায় মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান তিনি। সেখানকার একটি বিমান বন্দরে তিনি কর্মরত ছিলেন। অপহরণের পরের ঘটনা বলতে গিয়ে মাহবুব বলেন, ‘২৬ নভেম্বর দুই জন নিজেদের মালয়েশিয়ান পুলিশ পরিচয় দিয়ে বলে থানায় যাইতে হবে, চলো। নিচে নাইমা গাড়িতে উইঠা দেখি আরও চারজন বাঙালি আছে। চোখ বাইন্ধা প্রথমে এক জায়গায় নিয়া যায়। গাড়িতেই হাত-পা বাইন্ধা রাখে। জঙ্গলের ভিতরে ঘণ্টা দুয়েকের মতো রাখে। এরপর আরেকটা গাড়ি আসে। গাড়িতে কইরা আরেক জায়গায় নিয়া যায়।’
অপহরণের পরের রাতেই মুক্তিপণ বাবদ ১০ লাখ টাকা চায় অপহরণকারীরা। বাংলাদেশে মাহবুবের বাবা-মা বা আত্মীয়-স্বজন যারা আছে তাদের মাধ্যমে টাকা দিতে চাপ দেয় তারা। দেশে থাকা ভাইকে ফোন দিতে বলে। বাংলাদেশ সময় আনুমানিক রাত দেড়টার দিকে জুলহাস নামের একজন টাকা চেয়ে মাহবুবের ভাই নাজমুল হক সবুজকে ফোন দেয়। প্রথমে ১০ লাখ টাকা চাইলেও ৩ লাখ টাকায় রাজি হয় অপহরণকারীরা। টাকা দেওয়ার জন্য পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত সময় নেন নাজমুল।
এর মধ্যেই নির্যাতন শুরু হয় মাহবুবের ওপর। তিনি বলেন, ‘রাতে জঙ্গলের ভিতরে বুক সমান পানিতে নামিয়ে রাখে। সকালে ভাই টাকা দিতে দেরি করায় পানি থেইকা ওপরে উঠাইয়া মারধর শুরু করে। একের পর এক লাথি-ঘুসি দিতে থাকে। মাথায়-মুখে মারে। সিগারেট দিয়ে শরীরে ছ্যাঁকা দেয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা ৬-৭ ঘণ্টা মারধর করে। মারতে মারতে ওরা বলে, ‘তর কী অবস্থা তুই তর ভাইরে ফোন দিয়া ক।’ আমি ভাইরে ফোনে কই, ভাই আমারে মাইরালাইতাছে, তোমরা য্যামনে পার টাকা দেও। ভাই কয় টাকা মিলতাছে না। এক লাখ টাকা আছে। পরদিন ব্যাংক থাইকা তুইলা বাকি টাকা দিব, কয় ভাই।’
মাহবুবের ভাই নাজমুল পরের দিন এক লাখ টাকা তুলে দেয় অপহরণকারীদের নির্দেশনা অনুযায়ী। বাকি টাকা দেওয়ার জন্য আরও এক দিন সময় নেন তিনি। এর মধ্যে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় মাহবুবের অপহরণকারীরা। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় জঙ্গলের পানিতে ফেলে রাখা হয়। প্রচণ্ড বৃষ্টি আর ঠাণ্ডায় মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন মাহবুব। তিনি বলেন, ‘ভাইয়ে সময় নিয়ার পর সারারাইত আমারে বৃষ্টির মধ্যে পানিতে বাইন্ধা রাখে। প্রচুর বৃষ্টি পানির লাইগা আমি দম ফেলতে পারছিলাম না। একটু পর পর দম বন্ধ হইয়া আসে। এমনে কইরা রাখার পর বৃষ্টি কমলে ওরা আমারে আইসা জিগায়, ঠাণ্ডা লাগছে? কিন্তু আমি কোনও কথা কওনের শক্তি পাই নাই। পরে ওরা আমারে ওপরে তুইলা কয়, ভাইরে তর অবস্থা ক। ভাইরে ফোন কইরা কই, ভাইরে আমারে বাঁচাও। একেকটা সেকেন্ড যায়, মনে হয় মইরা যাইতেছি। তোমরা য্যামনে পার টাকা দেও।’
পরের দিন দুপুর পর্যন্ত বাকি দুই লাখ টাকা দেওয়ার সময়সীমা নাজমুলকে বেঁধে দেয় অপহরণকারীরা। তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকা জোগাড় করতে না পারায় ভাইয়ের জীবননাশের আশঙ্কায় র্যাব-৩-এর অফিসে অপহরণের বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করেন। র্যাব ঘটনার সত্যতা যাচাই করে মাঠে নামে র্যাব। তারা নাজমুলকে অপহরণকারীদের চাহিদামতো বাকি দুই লাখ টাকা মালিবাগ ফ্লাইওভারের নিচে লেনদেনের পরামর্শ দেয়। সেই পরামর্শ অনুযায়ী টাকা লেনদেনের সময় দুলাল ও রুপচাঁদকে আটক করে র্যাব।
এরই মধ্যে অপহৃত মাহবুবকে উদ্ধার করার জন্য মালয়শিয়া দূতাবাস, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বায়রার সঙ্গে যোগাযোগ করে র্যাব। ১ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার পাহাং জেলার কুনতাং পুলিশ স্টেশন এলকার গহীন জঙ্গল থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় মাহবুবকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
৩ ডিসেম্বর র্যাব-৩ গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে প্রথম দফায় একলাখ টাকা গ্রহণকারী রিফাতকে রাজধানীর মালিবাগের চৌধুরীপাড়া থেকে আটক করে। ওই দিনই দিবাগত রাত ১টায় গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মাহবুবকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
অপহরণকারীদের বিষয়ে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘আমাদের জানামতে মালয়েশিয়াতে এরকম বেশ কয়েকটি গ্রুপ কাজ করে। মালয়েশিয়ান ও বাংলাদেশিরা মিলে এই অপহরণের কাজ করে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি অপহরণকারীরা টুরিস্ট ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়ায় যায়। অল্প কয়েকদিনে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে আবার চলে আসে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশি অপহরকারীরা অনেকটা চেইনের মতো কাজ করে। প্রত্যেকই একে অপরের আত্মীয়। নিজেদের মাধ্যমেই এই অপহরণ ও পরবর্তী সময়ে টাকা গ্রহণের কাজটা করে থাকে। টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে অন্যদের ওপর আস্থা রাখতে পারে না তারা।’
দেশে অবস্থানকারী অপহরকারী চক্রের আরও সদস্য যারা আছে তাদের খোঁজ নিয়ে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানান মুফতি মাহমুদ।
আরও পড়ুন-
মুক্তিপণ আদায়কালে র্যাবের হাতে আটক ৩
প্রবাসীকে জিম্মি করে টাকা আদায়ের অভিযোগে গ্রেফতার ৫
/টিআর/