X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ওমর ফারুকের জন্য সহকর্মীদের শোকগাথা

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
৩০ এপ্রিল ২০১৭, ১৯:০৮আপডেট : ০১ মে ২০১৭, ০০:২০

শোক বইয়ে ওমর ফারুকের জন্য সহকর্মীদের শোকগাথা বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ প্রতিনিধি ওমর ফারুক। বয়স যাই হোক না কেন, অপেক্ষাকৃত তরুণদের সঙ্গে তরুণ হয়ে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল তার। সহকর্মীদের চা খেতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিতে ‘নিচে যাইবানি’ বলা কিংবা সামনে নারী কলিগদের পেলে মজা করে ‘থ্যাংক ইউ’ বলা কিংবা ‘কী, সব ঠিক তো’ বলার মধ্য দিয়ে সবার মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। সেই ফারুক ভাই হঠাৎ করেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি ওমর ফারুক আর নেই। আজ (রবিবার) ভোররাত সাড়ে ৩টার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৫১ বছর।
শোক বইয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদক জুলফিকার রাসেলের লেখা
শনিবার দুপুরে সংবাদ সংগ্রহ করে অফিসের প্রবেশের মুখেই হার্ট অ্যাটাক করেন ওমর ফারুক। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ভর্তি করা হয় স্কয়ার হাসপাতালে। তার শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর পেয়ে তার কর্মস্থল বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদক ও হেড অব নিউজ মধ্যরাতে ছুটে গেছেন হাসপাতালে। শেষ সময়ে পরিবারের পাশে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেইসঙ্গে একজন দক্ষ প্রতিবেদক, সুহৃদ সহকর্মী ও ভালো মানুষকে ফিরে না পাওয়ার বেদনায় আহত হয়েছেন। ফারুক ভাই মারা যাওয়ার পরপরই সম্পাদক জুলফিকার রাসেল ফেসবুকে লেখা তাৎক্ষণিক প্রতক্রিয়ায় জানিয়েছেন নিজের অনুভূতির কথা। সেইসঙ্গে ওমর ফারুকের জন্য জানিয়েছেন প্রার্থনা। পরে বাংলা ট্রিবিউনে খোলা শোক বইতে তিনি লিখেছেন, ‘ফারুক ভাই, ভাবতেই পারছি না, আপনি আর অফিসে আসবেন না! এত কঠিন কেন বাস্তবতা? আমরাও একে একে আসবো। আপনার সঙ্গে দেখা হবে। আপনি কি আমাদের এখন মিস করছেন? আমি, বাংলা ট্রিবিউন পরিবার সবাই ভীষণ মিস করছি!’
ফেসবুকে বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ হারুন উর রশিদের স্ট্যাটাস
হেড অব নিউজ হারুন উর রশীদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘প্রতিটি মৃত্যুই যেন আমার মৃত্যুর ঘণ্টধ্বনি...’

ফেসবুকে জামাল উদ্দিনের স্মৃতিকাতরতা সিনিয়র রিপোর্টার জামাল উদ্দিন তার অনেকদিনের সহকর্মী। নিজ নিজ কাজ শেষে চেষ্টা করতেন একসঙ্গে অফিসের দিকে আসতে। তিনি সম্প্রতি তোলা তেমনই একটি ছবি শেয়ার দিয়ে লিখেছেন, ‘কত কথা, কত স্মৃতি! এভাবে ফাঁকি দিলেন ফারুক ভাই।’
ফেসবুকে ওয়ালিউল মুক্তা
সহকর্মী ওয়ালিউল মুক্তা ফেসবুকে ছবি দিয়ে স্মৃতিকথা লিখেছেন যত্ন করে। ‘‘আমি রিপোর্টার মানুষ। যত হাঁটব, তত রিপোর্ট। তাই বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসি না। ঝামেলা হয়। খাবার নিয়ে তো দৌড়াদৌড়ি করা যায় না।’ বাংলা ট্রিবিউন ক্যান্টিনে বসে মুখে ভাত দিতে দিতে এ কথাগুলো বলেছিলেন ফারুক ভাই। খাবার, হাঁটাহাঁটি আর অবশ্যই রিপোর্টিং— এসব থেকে এখন তিনি দূরে, অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে। একজন সহকর্মী হিসেবে এগুলোর বাইরেও অনেক ছোট, ক্ষুদ্র বিষয়েও পোড়াবে, কাঁদাবে, দীর্ঘশ্বাস ঘন করবে। আমাদের মন কাঁদবে ফারুক ভাই। ফারুক ভাই নেই। তার এ কথাটি রয়ে যাক... সবার মনে। ওমর ফারুক ভাই ভালো থাকুন, খুব ভালো...’
ওমর ফারুককে নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের চিফ রিপোর্টার উদিসা ইসলামের লেখা বাংলা ট্রিবিউনের চিফ রিপোর্টার উদিসা ইসলাম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘লোকে বলে কিবোর্ডে হাত দিলেই কয়েকশ শব্দ লিখে ফেলি আমি... ভোর থেকে গত আড়াই ঘণ্টা প্রিয় ফারুক ভাইয়ের চেয়ারের পাশে বসে আছি, একলাইনও লেখা হয়নি। কত কিছু ভুল জানি আমরা! ফারুক ভাই, ভাল থাকুন।’
সিনিয়র রিপোর্টার জাকিয়া আহমেদ লিখেছেন, ‘আপনার বাসা পুরান ঢাকা, আমার মগবাজার। কত কত দিন, একসঙ্গে সিএনজিতে করে অফিসে থেকে বাসায় ফিরতাম আমরা। ডাক্তার গলির মুখে আমাকে নামিয়ে দিয়ে আপনি চলে যেতেন। বলতেন, ‘ভালো থাইকেন জাকিয়া। কাল আবার দেখা হবে।’ আজ আমরা সবাই মিলে আপনাকে বিদায় দিলাম ফারুক ভাই, পুরো অফিস এক হয়ে আপনাকে শেষ বিদায় জানালাম। আপনি আর আসবেন না এই অফিসে, আর একসঙ্গে আমাদের সিএনজিতে যাওয়া হবে না। তবে আপনার মতো করেই বলি, ভালো থাইকেন ফারুক ভাই। হয়তো কাল, নয়তো পরশু— আবার দেখা হবে।’
ফেসবুকে ফাতেমা আবেদীন নাজলা লিখেছেন ওমর ফারুককে নিয়ে
শেষ সময়ে মধ্যরাতে হাসপাতালে দৌড়ে গিয়েছিলেন সহকর্মী ফাতেমা আবেদিন নাজলা। ওমর ফারুকের মৃত্যুর সংবাদটি পরিবারকে জানানোর দায়িত্বটিও পালন করেছেন তিনি। ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখছেন, ‘প্রতিদিন এক ছাদের নিচে বসে অফিস করা সহকর্মী ওমর ফারুক ভাই চোখের সামনে চলে গেলেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। অফিসে দেখা হলেই কারণ ছাড়া বলতেন ‘নাজলা থ্যাংক ইউ’। আমিও উনার মতো করে বলতাম, থ্যাংক ইউ ভাই। কালকেও থ্যাংক ইউ দিলেন। আমিও নিলাম। দু’জনেই বললাম— আমরা কেনও থ্যাংক ইউ দেই, হিটলার ভাইকে বলবো না। ফারুক ভাই, আপনার থ্যাংক ইউয়ের অর্থ বুঝলাম আজকে, এই তিন বছর পরে। আপনি হয়তো জানতেন, আপনার মৃত্যু সংবাদ আমাকেই জানাতে হবে আপনার স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের। তাই তিন বছর ধরে ধন্যবাদ দিয়ে গেছেন।’
নাজলা আরও লিখেছেন, ‘আপনার ছোট মেয়েটার কান ফোড়ানো হয়েছে। ফোড়ের সুতাটা এখনও খোলা হয়নি। স্কয়ার হাসপাতালের সিসিউর সামনে ওর গগণবিদারী আর্তনাদ— আমার বাবা মরতে পারে না, আমাকে রেখে মরতে পারে না। আপনার বড় মেয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, আমাদের কে সামলাবে, মা শক্ত হও। আল্লাহ তাদের সবাইকে এই শোক সহ্য করার শক্তি দিন। আপনাকে আল্লাহ বেহেশতে নসীব করুন। সবাই ওমর ফারুক ভাইয়ের জন্য দোয়া করবেন। তিনি পাঁচ ভাইয়ের সবচেয়ে ছোট ছিলেন। তাকেই ভাইয়েরা আজকে বিদায় দিচ্ছেন সবার আগে। ‘প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর কিয়ামতের দিন তোমাদের পরিপূর্ণ বদলা দেওয়া হবে। তারপর যাকে দোজখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সেই সফলকাম। আর পার্থিব জীবন ধোঁকার বস্তু ছাড়া কিছুই নয়।’— (সূরা আল ইমরান, আয়াত: ১৮৫)’

জাহানারা বেগমের ফেসবুক স্ট্যাটাস সহকর্মী জাহানারা বেগম তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘আবারও মৃত্যু। নিতে পারছি না। এবার সহকর্মীর। প্রতিদিন অফিসে ঢুকে যাদের হাসি মুখগুলো দেখি, তারাও তো আপনজন। কারণ দিনের একটা লম্বা সময় তাদের সঙ্গে কাটাই। আল্লাহ ফারুক ভাইকে বেহেস্ত নসিব করুন, তার আত্মাকে শান্তি দান করুন। আমিন। ফারুক ভাই সবাকেই কিছু না কিছু বলে ক্ষেপানোর চেষ্টা করে আনন্দ পেতেন। যেমন আমাকে দেখলেই বলতেন, জাহানারা আপা, আবার সাজেক যাচ্ছেন কবে? ফারুক ভাই এর জন্য সবাই দোয়া করবেন।’

শেরিফ আল শায়ার লিখেছেন, ‘চশমাটা কপালে তুলে মিটিমিটি হাসি দিয়ে কেউ তো জিজ্ঞেস করবে না, কী শেরিফ কেমন আছ? এমন অবিশ্বাস্য একটা সংবাদ কখনও বিশ্বাস করতে হবে, এটা ভাবতেই তো পারা যাচ্ছে না, ফারুক ভাই।’


সালমান তারেক শাকিল শোকবইয়ে লিখেছেন, ‘গুগলে পুরান ঢাকার এলাকার নাম, রোডের নামগুলো এখন কে উঠাবে? চা খেতে খেতে কে বলবে, চলো শাকিল। বান্দরবান ঘুরে এসে বলবেন না, দেখ, কী ছবি আনলাম! ঘুরাঘুরি, ছবি তোলা ইত্যাকার মানবীয় গুণ এত সুন্দর করে কে দেখাবে? জানেন ফারুক ভাই, আজ থেকে দু’দিন পর আপনার জন্মদিন। তানিয়াকে বলেছিলাম, জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে হাসপাতালে যাব। কিন্তু হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে উঠে গেলেন। আপনার চেয়ার ফাঁকা। চোখ গেলেই আপনার লাস্যময়ী মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। আমি জানি, সভ্যতার ইতিহাসে মানুষের মৃত্যু স্বাভাবিক। কিন্তু আপনার চলে যাওয়া আলাদা। জানেন ফারুক ভাই, নগর সাংবাদিকতার অন্যতম প্রতিবেদক ছিলেন আপনি। আপনি বেঁচে থাকবেন কর্মে, ভালোবাসায়।’
পাভেল হায়দার চৌধুরীর সাথে ওমর ফারুকের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ ‘নিচে যাইবানি’। পাভেল লিখেছেন, ‘সহকর্মী ফারুক ভাই নেই, তার একটি আহ্বান আজকে খুব মনে পড়ছে। অফিসে এলেই হাতের কাজ শেষ করে ডেস্কের সামনে এসে বলতেন, ‘পাভেল, নিচে যাইবানি?’ আসর অথবা মাগরিবের আজানের পরে নিচে যাওয়ার সময় হতো তার। অফিসে আসার পর নিচে নামার সময় কাউকে না কাউকে নিয়েই নিচে নামতেন ফারুক ভাই। এই সময়ে কখনও তার সহযাত্রী হয়েছি; কখনও হাতে কাজ থাকলে বলেছি, এখন যাব না। জবাব পেয়ে ডেস্কের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যেতেন। হাতে কাজ থাকলে মনে হয়েছে, কাজটা আগে সেরে নেই, যাওয়ার সময় তো অনেক হবে। ফারুক ভাই, তিন সত্যি করে বলছি, এত তাড়াতাড়ি না ফেরার দেশে চলে যাবেন বুঝতে পারলে আপনার ‘নিচে যাইবানি’ প্রস্তাব কখনও প্রত্যাখান করতাম না; হাতে যতই কাজ থাকুক!’
পাভেল লিখেছেন, ‘তার নিচে যাওয়ার আহ্বান শুধু আমাকেই নয়, অফিসের প্রায় সব সহকর্মীকেই জানাতেন। অফিসে এসে অবসর পেলেই ঘনিষ্ঠদের নিয়ে নিচে নামতেন। আমি ফারুক ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ ছিলাম কিনা জানি না, তবে নিচে যাওয়ার জন্য তার প্রস্তাব পেতাম প্রায়ই। আজকে আসর, মাগরিব শেষ হলো, ফারুক ভাই আর নিচে যাওয়ার প্রস্তাব নিয়ে ডেস্কের সামনে আসছেন না। অথচ তার প্রস্তাব কতবারই না প্রত্যাখান করেছি, আর আজ ফারুক ভাইয়ের ‘নিচে যাইবানি’ প্রস্তাবের অপেক্ষা করছি! কিন্তু ফারুক ভাই আর সেই প্রস্তাব নিয়ে আসছেন না। ঠিক আছে ফারুক ভাই, আপনি একা একা না ফেরার দেশে চলে গেলেন, আমিও একা একাই নিচে যাচ্ছি!’
হিটলার এ. হালিমের ফেসবুক স্ট্যাটাস কারণ ছাড়াই ‘থ্যাংক ইউ’ বলা নিয়ে ওমর ফারুক বরাবরই মজা করতেন সহকর্মী হিটলার এ. হালিমের সঙ্গে। আজ মৃত্যুর পর হিটলার লিখেছেন, ‘থ্যাংক ইউ, ফারুক ভাই! কিছুদিন ধরে সহকর্মী, বড় ভাই ওমর ফারুক দেখা হলেই বলতেন, থ্যাংক ইউ হিটলার। কারণ জানতে চাইলে মিটি মিটি হাসতেন। কিছু বলতেন না। মাত্র ৫১তেই হঠাৎ না ফেরার দেশে চলে গিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, কেন তিনি থ্যাংক ইউ হিটলার বলতেন। হয়তো সময় ছিল না বিস্তারিত বলার! বাইপাস সার্জারির জন্য আজ সকালে ফারুক ভাইকে রক্ত দেবো, ডাকের অপেক্ষায় ছিলাম, রক্ত দিলে হয়তো তিনি বলতেন, থ্যাংক ইউ হিটলার।’
হিটলার লিখেছেন, ‘২৭ এপ্রিল আমার আব্বার মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। ১৫ বছর আগে ৫২ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে আমার আব্বা হঠাৎ মারা যান। ওইদিন ফারুক ভাই আব্বাকে নিয়ে আমার স্ট্যাটাস দেখে বলেছিলেন, ‘মন খারাপ কইরো না। সবাই চিরদিন থাকবে না।’ ফারুক ভাইয়ের মুখের কথা মুখেই থাকলো! আচ্ছা, চলে যাওয়ার জন্য ৫১, ৫২ কি খুব বেশি বয়স!’
এস এম আব্বাস লিখেছেন ‘ফারুক ভাই নেই। তার সঙ্গে আর কোনোদিনও সাজেকে যাওয়া হবে না। প্রতিদিন বিকালে অফিসে ঢোকার আগে ৩২ নম্বরের লেকপাড়ে বসে চা খাওয়া হবে না। বিকালে অফিস থেকে নেমে আর চায়ের আড্ডায় যাওয়া হবে না। সন্ধার পর দু’জনের আর কোনও গোপন পরামর্শ করা হবে না। এসব এখন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। চেয়ারের পাশে এসে আর বলবেন না, ‘ভাই, নিচে যাইবেননি’। নিচে যাব, শুধু ফারুক ভাই সঙ্গে যাবেন না। ভাবতে পারছি না। নগর উন্নয়ন বিটের রিপোর্টারদের এ বছর দেশের বাইরে ঈদ করানোর ইচ্ছে ছিল ওমর ফারুক ভাইয়ের। আমাকে সে কথা জানিয়েছেন একমাস আগেই। আমি ওই বিটের রিপোর্টার নই। সে কারণে আমাকে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সম্প্রতি তিনি সাজেকে গিয়েছিলেন। আমাকে জোর করে হলেও সাজেকে নিয়ে যাবেন, এমনটাই ইচ্ছা ছিল তার। তাই কিছু টাকা গোছাতেও পরামর্শ দেন। পরের বছর মালোয়েশিয়া নিয়ে যাবেন, এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে বলেন। এ বছর নগর উন্নয়ন বিটের রিপোর্টারদের নিয়ে মালয়েশিয়া ঘুরে এসেছেন। আমাকে নিয়ে তাই পরের বছর যাবেন। মালয়েশিয়া কেন, ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে আর কোনোদিন কোথাও যাওয়া হবে না! সব আগের মতোই আছে, শুধু নেই ফারুক ভাই।’
বাধন অধিকারী শোক বইয়ে লিখেছেন, ‘ফারুক ভাই, ছেলেবেলায় শুনতাম চলে যাওয়া মানুষেরা দূর আকাশের ধ্রুবতারা হয়ে যায়। আপনিও জ্বলতে থাকুন, তারার মতোন।’
মিজানুর রহমান লিখেছেন, ‘আপনার মজার কথাগুলো খুব মিস করব, ভাই। যেখানেই থাকেন, ভালো থাকেন। দেখা হবে আবারও কোনও এক অজানা জগতে। আপনার আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
ওমর ফারুকের আরেক সহকর্মী তরিকুর রহমান সজীব ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সকাল ১০টায় অফিস। বাইরেও প্রচণ্ড রোদ। তবু কেন জানি কালো পাঞ্জাবিটা পরেই বের হলাম। বের হতেই ফোন, ফারুক ভাই আর নেই। আগের দিন বিকালে অফিসে ঢুকেই জানতে পারি, নিউজ নিয়ে অফিসে ঢোকার সময়ই হার্ট অ্যাটাক করেছেন বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ প্রতিনিধি ফারুক ভাই। পাশের স্কয়ার হাসপাতালেই তৎক্ষণাৎ ভর্তি করা হয় তাকে। এনজিওগ্রাম শেষে জানা যায়, দুইটি ব্লক হৃদযন্ত্রে, রিং লাগবে। সন্ধ্যা পেরোতে পেরোতে ডাক্তাররা বললেন, অবস্থা স্ট্যাবল নয়। বাইপাস লাগবে। রক্তের জোগাড়যন্ত্র করে রাখা হলো। কাজের চাপে আর দেখতে যাওয়া হয়নি। অফিস থেকে বের হতে হতে রাত পৌনে ১টা। ভাবছিলাম, কাল তো সকালে ডিউটি। এক ফাঁকে দেখে আসব। সেই সুযোগ আর ফারুক ভাই দিলেন না। অথচ রাতে তার অসুস্থতার খবরও আমার হাতেই ওয়েবসাইটে তোলা।’
সজীব আরও লিখেছেন, ‘আজ থেকে ঠিক পাঁচ মাস আগে বাংলা ট্রিবিউনে জয়েন করার পর ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় কি? না, ঠিক পরিচয় বলা যায় না। তার সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ তো করে উঠতে পারিনি। হক ভাই তাকে বলতেন, বটবৃক্ষ। বেশিরভাগ দিনই বসতাম তার মুখোমুখি ডেস্কে। নিউজ একটা দিয়েই হাস্যোজ্জ্বল মুখে জিজ্ঞাসা করতেন, পাইছ নাকি? নিউজ তোলার পরও মাঝে-মধ্যেই কারেকশন দিতেন, হাসিমুখেই। চশমা কপালের ওপরে তুলে তার হাসিমাখা মুখটাই এখন মনে পড়ছে সবসময়। শুধু তাই নয়, তার মুখে হাসি নেই, এমন কোনও মুহূর্তের কথাও মনেও করতে পারছি না। বয়স হয়েছিল ৫১ বছর। খুব কি বেশি? তবু তো চলেই গেলেন ফারুক ভাই। ভালো থাকবেন, যেখানেই থাকুন।’
আনোয়ার পারভেজ হালিমের ফেসবুক স্ট্যাটাস আনোয়ার পারভেজ হালিম তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘নাজলার ফোন পেয়ে স্কয়ারে ছুটে গেলাম। তখন রাত ২.৩৬/৪০ হবে। ভেবেছিলাম হয়তো গিয়ে কথা বলতে পারব। না, কথা আর হয়নি। রাত একটা-দেড়টা থেকেই তার হার্ট বিট কাজ করছিল না। আর্টিফিসিয়াল সাপোর্টে রাখা হয়েছে। ডাক্তার আমার সামনেই সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছেন। বুকের ওপরে ম্যানুয়ালি প্রেশার দিচ্ছেন, যদি মিরাকলি ফিরে আসে। সব চেষ্টা ব্যর্থ। ততক্ষণে ফারুক ভাইয়ের স্বজনরা সবাই হাসপাতালে এসে গেছেন। তার আগে আলতাফকে নিয়ে নাজলা এসেছে। রাসেল ভাই ও হারুন ভাইও এসেছেন। রাত ৩টা ৩৫ মিনিটে সাপোর্ট খুলে নিয়ে মুত্যু ঘোষণা করলেন ডাক্তার। ভাবী পাথর হয়ে গেছেন। বড় মেয়েটা তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। অন্যরা কাঁদছেন। এরই মধ্যে থেমে থেমে ছোট মেয়েটির ‘বাবা বাবা’ বলে বুকফাটা আর্তনাদ। এ দৃশ্য সহ্য করা কঠিন।’
পারভেজ হালিম লিখেছেন, ‘শনিবার দুপুর দেড়টার দিকে ধানমন্ডি ৩২ থেকে হেঁটে অফিসে আসেন। নিচতলার রিসিপশনে পৌঁছামাত্র বুকে ব্যাথা শুরু হলে সেখানেই সোফার ওপরে শুয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে স্কয়ারে নেওয়া হয়। এনজিওগ্রামে তার দুটো ব্লক ধরা পড়ে। একটা শত ভাগ, আরেকটা নব্বই ভাগ ব্লকড। কথা ছিল মঙ্গলবার বাইপাস সার্জারি করা হবে। সকাল সাড়ে ৫টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিলাম। লাশ হয়ে বাড়ির পথে রওনা হলেন ফারুক ভাই। আমার সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল অ্যাম্বুলেন্সটা। ফিরে এলাম অফিসে। আমার ডেস্কে বসে আছি, আর ভাবছি— ফারুক ভাই কানের কাছে এসে আর কোনোদিনও বলবেন না, ‘ভাই, আমার রিপোর্টটা একটু এক্সক্লুসিভে দিয়ে দেন।’’
শোক বইয়ে বাংলা ট্রিবিউনের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক তানজিমুল নয়নের লেখা ওমর ফারুকের সহকর্মী, বাংলা ট্রিবিউনের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক তানজিমুল নয়ন শোক বইয়ে লিখেছেন, ‘ওমর ফারুক ভাই, সেই আজকের কাগজ থেকে পরিচয় আমাদের। আপনাকে চিনতাম এখন থেকে ১৮ বছর আগে, সেই ’৯৯ সাল থেকে। সবসময় মুখের হাসিটা একইরকম অমলিন দেখেছি, কেবল গতকালটা বাদে। আর আজ আপনি ওপারের মানুষ। গতকাল অফিসে ঢোকার সময়ে সিকিউরিটি গার্ডদের মধ্যে যে মেয়েটা থাকে, সে আমাকে বললো, স্যার আপনাদের একজন এখানে। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই তাকিয়ে দেখি আপনি সেখানে সোফায় শোয়া, ঘামছেন। যে মানুষ কখনও ওই সোফায় বসেননি, অফিস চলাকালে তাকে সেখানে শোয়া দেখেই বুঝেছিলাম পরিস্থিতি ভালো নয়। আপনিই বললেন হাসপাতালে নিয়ে যেতে। আরিফ ভাই ব্যবস্থা করলেন গাড়ির। আমি আর রনি স্কয়ারে নিয়ে গেলাম আপনাকে। হেঁটেই গাড়িতে উঠলেন, হেঁটেই জরুরি বিভাগে গেলেন। আর আজ আপনি এলেন লাশবাহী গাড়িতে। যে মানুষ আপনি ঘেমে একাকার গতকাল, আজ তীব্র গরমেও ভাবতে হলো, আপনার শরীর গরম হয়ে যাবে না তো! আর কী আশ্চর্য, গতকাল যে সোফায় শুয়েছিলেন, আজও এসে শুয়ে পড়লেন (বা আপনাকে বহনকারী খাটিয়াটি এনে বসানো হলো) সেই একই জায়গায়— হোয়াট এ কো-ইন্সিডেন্স! নিশ্চয় শববাহী সহকর্মীদের আজও মনে মনে বলেছেন, ‘থ্যাংক ইউ’, যেমনটা বলতেন মাঝে মধ্যেই; কারণে, অকারণে।’

আরও পড়ুন-

সাংবাদিক ওমর ফারুকের নামে অ্যাওয়ার্ড দেবে ডিআরইউ

শেষ বিদায়ে স্বজন হারানো কান্নায় ভারি বাংলা ট্রিবিউন

বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিক ওমর ফারুক আর নেই
/ইউআই/টিআর/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো