লন্ডনের লাটিমার রোডের আগুনে পুড়ে যাওয়া গ্রেনফল টাওয়ার এখন যেন শোকের প্রতিবিম্ব। ভবনটির নিচে অশ্রুসিক্ত নয়নে নিখোঁজ স্বজনের লাশের জন্য প্রতীক্ষা করছেন স্বজনরা। স্বজনদের এ প্রতীক্ষা আদেও শেষ হবে কিনা তাও কেউ জানেন না। এরই মধ্যে পুলিশ, উদ্ধার কর্মীরা জানিয়ে দিয়েছেন পুড়ে যাওয়া সব লাশ মিলবে না।
পুড়ে যাওয়া এ ভবনের ১৭ তলার ১৪৪ নম্বর ফ্লাটে মা-বাবা আর ভাইদের সঙ্গে থাকতেন হোসনা বেগম। জীবিত না হোক মৃত হোসনার লাশ চান তার হবু বর ও স্বজনরা। লাশ পাবেন এই আশাই করছেন তারা।
শুক্রবার (১৬ জুন) এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় হোসনার হাইস্কুলের সহপাঠী ক্যাথি ক্যাস্ট্রো আর মারিয়াম জিয়োডিভার সঙ্গে।
তারা জানান, বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিতই যোগাযোগ ছিল হোসনার। ডাক নাম তানিমা হলেও বন্ধুরা তাকে হোসনা নামেই চিনতো।
ক্যাথি বলেন, স্কুল শেষে হোসনাদের এডমন্টনের বাড়িতে বহুবার গেছি। তখন হোসনার মা রাজিয়া বেগম আর ভাইদেরও সঙ্গে পরিচয় হয়েছে।
বন্ধুদের কথায় জানা গেল, ধর্ম পরায়ন হোসনা হাইস্কুলে থাকতেই হিজাব ও নিয়মিত নামাজও পড়তো। নিরহংকারী আর সহজ কথার, সরল হাসির হোসনা আর কখনও বন্ধুদের আড্ডায় যাবে না-একথা ভেবেই অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন স্কুলের সহপাঠীরা।
ক্যাথি আরও বলেন, ‘জোরে হাসতে ভালোবাসত হোসনা। বন্ধুদের খাওয়াতে কখনও 'না' ছিল না তার। কারফোন ওয়ারহাউজ নামের ফোন কোম্পানিতে কাজ করতে সে। বন্ধুরা নতুন ফোন কিনতে গেলেও স্টাফ ডিসকাউন্ট পাইয়ে দিতো সে। কখনও নিজের ডিসকাউন্ট লিমিট শেষ হলে অন্য সহকর্মীদের সাহায্য নিতেন।’
ফেসবুকে নিজের সেলফি আপলোড করে শো-অফ করা পছন্দ ছিল না হোসনার। ছবি তুলতে ভালোবাসলেও সেগুলো পোস্ট করতেন না। মেধাবী,বিনয়ী হোসনার এভাবে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনরা।
বিয়ে ঠিক হওয়ার খবর বন্ধুদের আগেভাগেই বলে রেখেছিল হোসনা। যাতে সবাই ছুটি নিয়ে তার বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারে। বিয়ের ড্রেস কোডও ঠিক করা হয়েছিল। পরিবারের পছন্দের পাত্রকে নিজেরও খুব পছন্দ হয়েছিল তাও লাজুক হাসিতে বান্ধবীদের জানিয়েছিল হোসনা। বর-কনে দুজনে মিলেই শেষ করেছিলেন বিয়ের কেনাকাটা। সব আয়োজন প্রায় শেষ। ২৯ শে জুলাই লন্ডনের বালহামের মেমন সেন্টারে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে গেছে হোসনার স্বপ্ন।
আগুন যখন গ্রাস করছিল হোসনাদের ফ্লাটটিকে তখন হবু বরের সঙ্গে শেষ কথা হয় হোসনার। কথা বলতে বলতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হোসনার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ৯৮ মাইল পথ পেরুতে ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটাতে থাকেন। কিন্তু যখন হোসনাদের ভবনের নিচে পৌঁছালেন ততক্ষণে সব শেষ।
হোসনার ফোনের ভয়েস মেইলবক্স ভরে আছে স্বজন-বন্ধুদের উৎকণ্ঠার বার্তায়। সেসব মেসেজ আর কখনও শোনা হবে না হোসনার।
হোসনার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়দের প্রশ্ন, সৃষ্টিকর্তা নিপরাধ মানুষগুলোকে পৃথিবী থেকে দ্রুতই কেড়ে নেন। তাদের আশা, ‘যেখানে থাক হোসনা যেন ভালো থাকে। জ্যোৎস্না ফুল হয়ে থাকে।’
শুক্রবার সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপ হয় হোসনার বাবা কমরু মিয়ার লন্ডন প্রবাসী ভাগ্নে সাংবাদিক কে এম আবু তাহির চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানান, কমরু মিয়াদের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল লন্ডনের বেঙ্গল রেস্টুরেন্ট। প্রায় ৯০ বছর বয়সী কমরু মিয়া অবসর জীবন যাপন করছিলেন। তাহির চৌধুরী এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন। লাশ এখনেও উদ্ধার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘লাশ পাওয়া গেলে লন্ডনেই তাদের দাফন কার হবে।’
/এসটি/