X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘আমার পুতরে থুইয়া বাড়িত যাইতাম না’

জাকিয়া আহমেদ
২৪ জুলাই ২০১৭, ১৬:৩০আপডেট : ২৪ জুলাই ২০১৭, ২২:০০

 

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিদ্দিকুর রহমান। বেডের পাশে বসে আছেন তার মা সিদ্দিকুর রহমান শুয়ে আছেন কেবিনে। দু’চোখ ঢাকা কালো চশমায়। তখন কেবিনের বাইরে চেয়ারে বসা তার মা সুলেমা খাতুনের চোখ ভরে উঠেছে জলে। তাকে ঘিরে আছেন ছেলের সহপাঠী-বন্ধুরা। বন্ধুর মাকে তারা সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কিন্তু সেদিকে তার মন নেই। তিনি একমনে বলেই চলেছেন, ‘আমার পুতরে থুইয়া বাড়িত যাইতাম না।’ রবিবার (২৩ জুলাই) রাজধানীর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ছয়তলার কেবিন ব্লকে দেখা গেলো এই দৃশ্য।

পরীক্ষার রুটিন ও তারিখ ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবিতে গত ২০ জুলাই সকাল ১০টার দিকে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনের সড়কে অবস্থান নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। পুলিশ তাদের ওই জায়গা ছেড়ে যেতে বললে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফুট ওভারব্রিজের পাশের অংশে অবস্থান নেন তারা। তখন তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জসহ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান। এরপর থেকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সিদ্দিকুরের ডান চোখ পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি আর ওই চোখে দেখতে পাবেন না। তবে বাঁ-চোখে দৃষ্টি ফিরে আসতে পারে বলে ক্ষীণ আশা রয়েছে। আগের দিনের চেয়ে তার দুই চোখের অবস্থা নাজুক বলে চিকিৎসকরা জানালেও রবিবার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. গোলাম ফারুক আশার কথা শুনিয়েছেন। শুরুতে তিনি জানিয়েছেন, সিদ্দিকুরের ডান চোখের অবস্থা পুরোপুরি খারাপ। গতকাল (শনিবার) ওই চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। আর বাঁ-চোখের কর্নিয়ায় ইনজুরি আছে। ওই চোখটি ওয়াশ করা হয়েছে। তবে আরও পরিষ্কারের পর অস্ত্রোপচার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘আজ (রবিবার) সকালের এমআরআই  রিপোর্ট দেখে আমরা আশাবাদী হয়েছি। সিদ্দিকুরের বাঁ-চোখ নিয়ে পুরোপুরি না হলেও ক্ষীণ আশা আমরা দেখতে পাচ্ছি।’

হাসপাতালে সিদ্দিকুরের মা ও বন্ধুরা ডা. গোলাম ফারুক আরও জানান, সিদ্দিকুরের চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। রবিবার সকালে তার এমআরআই ও চোখের আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে ও পরে দু’বার বৈঠক করেছেন তারা। পরীক্ষার রিপোর্টকে তাদের কাছে ইতিবাচক মনে হয়েছে।

এদিকে হাসপাতালের বারান্দায় বসে সুলেমা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, সিদ্দিকুরের তিন বছর বয়সের সময় তার বাবা দুই ছেলে ও এক মেয়েকে রেখে মারা যান। বড় ছেলে নায়েব আলী মাধ্যমিক পাস করে লেখাপড়া নিয়ে আর এগোননি। রাজমিস্ত্রীর কাজ করে ছোট ভাইকে লেখাপড়া করিয়েছেন, বিয়ে দিয়েছেন বোনকে।

ছেলের লেখাপড়ার জন্য ছাগল আর মুরগি পালনের মাধ্যমে তা বিক্রি করতেন সুলেমা।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “পুতে আমারে বলিছিল, দুইটা বছর কষ্ট করতে। বলছিল— ‘মা, তুমি অনেক কষ্ট করছো আর কেবল দুইটা বছর অপেক্ষা করো। বিসিএস দিয়া বড় অফিসার হইলে তোমার আর কোনও কষ্ট থাকবো না।’ কিন্তু সেই দুই বছর আর আমার আইলো না। ছেলের দুইটা চোখ যে আন্ধার হইয়া গেলো। পুতের দুই চোখের আলোর সঙ্গে সঙ্গে যে আমাগো সব আশাও শেষ হইয়া গেলো।”

সিদ্দিকুর নিজেও কষ্ট করে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। খিলক্ষেতের একটি মেসে তার সঙ্গে থাকা ফরিদউদ্দীন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কারণ বিসিএস দিয়ে মায়ের অভাবকে দূর করাই ছিল সিদ্দিকুরের জীবনের লক্ষ্য। আর বিসিএস পরীক্ষায় পাস করার জন্য ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়াতে একটি কোচিং সেন্টারেও ভর্তি হয়েছিলেন তারা। রবিবার থেকেই তাদের সেখানে ক্লাস করার কথা ছিল। কিন্তু সিদ্দিকুর এখন হাসপাতালের বিছানায়। আর কখনও চোখে দেখবেন কিনা তা নিয়েও আছে সংশয়।

সিদ্দিকুরের মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন বন্ধুরা হাসপাতালে সিদ্দিকুরের মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক কাজী মো. আল নূর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সবসময় চাই শিক্ষার্থীরা থাকবে ক্লাসের বেঞ্চে। তাদের কাউকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে দেখা আমাদের জন্য কষ্টের। আবার সেটা যদি হয় চোখের আলো হারানোর মতো বিষয়, তাহলে তা হয়ে ওঠে খুবই দুঃখজনক।’

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক জানিয়েছেন, সিদ্দিকুরের চিকিৎসায় তারা কোনও ত্রুটি রাখবেন না, তাকে হাসপাতালের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।

তবে সিদ্দিকুরের চিকিৎসা বিনামূল্যে হওয়ার কথা থাকলেও তহবিল সংগ্রহ করছেন তার সহপাঠী বন্ধুরা। এই প্রতিবেদক হাসপাতালে উপস্থিত থাকাকালে তারা কয়েক জায়গা থেকে টাকা তুলে সুলেমা খাতুনের হাতে তুলে দেন। চিকিৎসার খরচ মেটানো ছাড়াও লক্ষ্য আছে তাদের।

সিদ্দিকুরের বন্ধু রাকিবউদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমরা কোনও কমতি রাখতে চাই না। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পুরোপুরি সুস্থ না পর্যন্ত যেন সিদ্দিকুরের কোনও অসুবিধা না হয় সেটিও মাথায় রেখেছি আমরা। তাই টাকা সংগ্রহ করছি। আর কেবিনের দরজায় লেখা আছে, ‘সিদ্দিকুর রহমানকে সকলে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসুন।’ সেখানে ডাচ বাংলা ব্যাংকের দুটি অ্যাকাউন্ট নম্বর ও একটি বিকাশ নম্বর দেওয়া আছে।”

/জেএ/জেএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়