X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশিদের জমজমাট নৌকা বাইচ

মোরশেদ আখতার বাদল, বার্মিংহাম থেকে
২৪ জুলাই ২০১৭, ২২:২০আপডেট : ২৪ জুলাই ২০১৭, ২২:২০

নৌকা বাইচে অংশ নেন নারীরাও দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে, যুক্তরাজ্যে থাকেন তারা। কেউ স্থায়ী হয়েছেন, কারও জন্মই হয়েছে সেখানে। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বসবাস কিন্তু নাড়ির টান বা শেকড়ের মূল তাদের গাঁথা রয়েছে বাংলাদেশেই। যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাই সুযোগ পেলেই মেতে ওঠেন নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতির চর্চায়। তারই প্রমাণ মেলে গত ১৬ জুলাই, যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম শহরের এজবাস্টন রিজরভয়রে। সেখানে বাংলাদেশিরা মেতে ওঠেছিলেন বার্ষিক নৌকা বাইচের আয়োজনে। কেউ হাতে করে, কেউ লাঠির মাথায় বেঁধে নিয়ে এসেছিলেন লাল সবুজের পতাকা। নৌকার গলুইয়ে পতপত করে উড়ছিল বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। পাড়ে উপচে পড়া ভিড় ছিল শিশু থেকে বৃদ্ধ- নানা বয়সী প্রবাসী বাংলাদেশির।

পুরো এলাকা যেন হয়ে উঠেছিল একখণ্ড বাংলাদেশ। আয়োজনটি পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশিদের মিলনমেলায়।

নৌকা বাইচ দেখতে আসা বাংলাদেশিদের ভিড় এই নৌকা বাইচের আয়োজন শুধু বাংলাদেশিদেরই নয়, মাতিয়েছিল ব্রিটিশদেরও। তাদের অনেকেরই সরব উপস্থিতি ছিল আয়োজন স্থলজুড়ে। বাইচ উপলক্ষে বাণী দিয়েছিলেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথও। যাতে তিনি আয়োজকদের অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি নৌকা বাইচ সম্পর্কে তার জানার আগ্রহের কথাও তুলে ধরেছেন। বিশ হাজারেরও বেশি দর্শকের সমাগমে এলাকাটি কোলাহলমুখর হয়ে ছিল সারাদিন।

শুধু নৌকা বাইচ-ই নয়, ছিল ঢাকার পহেলা বৈশাখের আদলে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।

আয়োজনটি পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশিদের মিলনমেলায় সেখানেই দেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সাবেক ছাত্র সুমিতা-জায়িদ দম্পতির ছেলে ১১ বছর বয়সী মাহিনের সঙ্গে। নৌকা বাইচ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইয়ার সিক্সে পড়া ছেলেটি বলল, ‘নৌকা বাইচের নৌকাগুলো হচ্ছে স্বাধীনতার প্রতীক, পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যেন ওরা সবাই ছুটে চলছে।’ শুধু মাহিনই নয়, ওর মতো আরও অনেকেই এসেছিলেন বার্ষিক এই নৌকা বাইচ দেখতে, অংশ নিতে।

যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নৌকা বাইচে এবার আঠারোটি দল অংশ নেয়। এর মধ্যে দু’টি নারী দলও ছিল। প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় বার্মিংহামের দল সিলেট স্পোর্টিং ক্লাব। তবে প্রতিযোগিতা বা হার-জিত নয়, বরং  অংশগ্রহণই ছিল বড় কথা। নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে পেরেই উৎফুল্ল ছিলেন একেকজন ‘প্রতিযোগী’। প্রতিটি দলে ছিল চৌদ্দ থেকে ষোলজন প্রতিযোগী। প্রায় চল্লিশ ফিট দৈর্ঘ্যের তিনটি বাইচের নৌকা সাজানো হয়েছিল বিচিত্র রঙে। উপচে পড়া দর্শকের ভিড়ে উত্তেজনাপূর্ণ ও আনন্দঘন পরিবেশে বিভিন্ন গ্রুপে এ বাইচগুলো অনুষ্ঠিত হয়।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাণী নারী প্রতিযোগীদের দুটি দল এক্সিবিশন বাইচে অংশ নেয়। জলের ভয় দূর করে নারীরা বৈঠা হাতে পাল্লা দিয়েছেন দুটি নৌকা নিয়ে। গায়ে লাইফ জ্যাকেট চড়িয়ে তারা মাথায় বেঁধেছিলেন গামছা। বার্মিংহাম সিটি কাউন্সিল এ বছর আয়োজন করছে ‘উৎসব’ নামের দক্ষিণ এশীয় অনুষ্ঠানমালা, যার মধ্যে এ নৌকা বাইচ দখল করে এক উল্লেখযোগ্য স্থান।

এবার জানা যাক শুরুর কাহিনী। ২০০৭ সালে অক্সফোর্ড শহরটি তার ১০০০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ওই অঞ্চলে বসবাসকারী প্রতিটি ভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষের উল্লেখযোগ্য ও ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উপাদান প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে এক জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। সে উদ্দেশ্যে প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রতিনিধি ড. আজিজুর রহমানের কাছে প্রস্তাবনা চাওয়া হয়। তিনি বাংলাদেশের সংস্কৃতির বহুল প্রচলিত ও পরিচিত এক সাংস্কৃতিক উপাদান নৌকা বাইচের বিষয়টি প্রস্তাব করেন। বাংলাদেশ থেকে এ জন্য বিশেষ নৌকা বয়ে নিয়ে আসারও প্রস্তাব দেন তিনি।

মাথায় গামছা বেঁধে বৈঠা হাতে নারী প্রতিযোগীদের একটি দল এ প্রসঙ্গে আজিজুর রহমানের ছেলে আবদুর রহমান জানান, তার বাবা বাংলাদেশ থেকে নৌকা নিয়ে আসার প্রস্তাবটি করেছিলেন অনেকটা খেয়ালের বশে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে কর্তৃপক্ষ তিনটি নৌকা আনার আয়োজন করতে বলে। কাজটি ছিল দুরুহ। তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতার কারণে এটি সম্ভব হয়েছিল। এক সময় থাই এয়ারওয়েজের একটি বিমানে কয়েক খণ্ডে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশের বাইচের নৌকা পাড়ি জমায় অক্সফোর্ডে। শুধু তা-ই নয়, বাইচ শেষে স্থান করে নেয় সেখানকার জাদুঘরেও।

সেই থেকে প্রতিবছর অক্সফোর্ডে নিয়মিতভাবে আয়োজিত হয়ে আসছে এ বাইচ। বাঙালি-অবাঙালি সবার কাছেই আদৃত হয়ে ওঠে ব্যতিক্রমী এ আসরটি। শুধু যে দর্শকের সংখ্যাই বাড়তে থাকে তা নয়, অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও বাড়ছে ফি বছর। ফলে অক্সফোর্ডের সীমিত পরিসরে আর সংকুলান হচ্ছিল না। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়ে নতুন ঠিকানার। নতুন স্থান খুঁজতে গিয়ে এক বছর ছেদ পড়ে বাইচ আয়োজনে। পরে ব্র্যাডফোর্ড নামের শহরটি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে সেখানে এক বছরের জন্য বাইচ আয়োজিত হয় বটে, কিন্তু তা স্থায়ী আয়োজনের জন্য উপযুক্ত ছিল না।

নৌকা বাইচের প্রতিযোগীরা ঠিক সে সময়েই নদী-নালা, খাল-বিলে পূর্ণ বার্মিংহাম সিটি কাউন্সিল আর্থিকসহ অন্যান্য সহযোগিতার নিশ্চয়তা দিলে ২০১৫ সাল থেকে এখানেই নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে অনুষ্ঠানটি। বার্মিংহাম হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশের আবাসভূমি, যোগাযোগের দিক থেকেও দেশের সমস্ত অঞ্চলের সঙ্গে সহজেই যুক্ত। জলাভূমির পাশাপাশি আছে বিপুল খরচ বহনের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার নিশ্চয়তাও।

নৌকা বাইচ-২০১৭ এর চেয়ারপারসন জহুর উদ্দীন বলেন, ‘ভবিষ্যতে যুক্তরাজ্যের মাটিতে বাংলাদেশের নৌকা বাইচকে একই সঙ্গে ক্রীড়া ও শরীরবিদ্যার অংশ হিসেবে জনপ্রিয় করে তুলে আয়োজনটিকে বৃহত্তর আকার দেওয়া এবং পর্যায়ক্রমে স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্বকারী একটি গোষ্ঠী গঠন করা এ আয়োজনের অন্যতম একটি লক্ষ্য।’

ছিল সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানও নৌকা বাইচে ইতালি থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসী অন্তত বিশটি পরিবার এসেছিল দর্শক হিসেবে। এ দলের একজন বলেন, এখানে সারা বছরজুড়েই আছে নানা অনুষ্ঠান। কিন্ত বাংলাদেশি হিসেবে পরিবারের সবাইকে নিয়ে উপভোগ করার মতো এটিই (বাইচ) হচ্ছে সেরা আয়োজন। আরেক দর্শক খুরশিদ জানান, গত প্রায় তিরিশ বছর ধরে তিনি এদেশে বাস করছেন, কিন্ত এমন প্রাণবন্ত আয়োজন আগে কখনও দেখেননি। তার মতে এটিই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়বাহী উল্লেখযোগ্য একটি আয়োজন।

নৌকা বাইচ অনুষ্ঠানের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘পূর্বনাট’-এর প্রধান ব্যক্তি মুরাদ খান জানান, তাদের দায়িত্ব ছিল এই ব্যাপক আয়োজনে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিচয়টিকে তুলে ধরা। সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তারা একটি শোভাযাত্রারও আয়োজন করেন। এতে নৌকা, পালকি, পেঁচা, বাঘ, হরিণ, শাপলাসহ নানা উপাদান যেমন প্রদর্শিত হয়েছে, তেমনি ‘পূর্বনাট নৌকা বাইচ হেরিটেজ মঞ্চ’ থেকে পরিবেশিত হয়েছে বাউলসহ বাংলা গান ও শিশুদের নৃত্য।

গল্প আড্ডায় মেতেছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা নৌকা বাইচের আয়োজনটি বাংলাদেশের নিজস্ব বর্ণিল সংস্কৃতিসত্ত্বার প্রবল প্রকাশ ঘটানোর সব যোগ্যতায় ঋদ্ধ। মাত্র একযুগ আগে লন্ডন শহরে শুরু হওয়া বৈশাখী মেলার শোভাযাত্রা আজ অর্জন করেছে ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম শোভাযাত্রার মর্যাদা।

অদূর ভবিষ্যতে এ নৌকা বাইচও তেমন কোনও গৌরবের আসনে বসলে তা বিচিত্র বা অভাবনীয় হবে না। এভাবেই যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি প্রবাসী সম্প্রদায় মূলধারার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার পাশাপাশি আপন সংস্কৃতির জন্যও স্বতন্ত্র স্থান তৈরি করে নিচ্ছে। কখনও তা নিজস্ব ধারাকে সচল রেখে, আবার কখনও মূল সাংস্কৃতিক ধারাকে প্রভাবিত করে।

/এএম/টিএন/

সম্পর্কিত
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
কানাডায় দ্বিতীয়বার ‘ডিরেক্টরস ক্লাব অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন মাহবুব ওসমানী
বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে ম্যানিলায় শিশু-কিশোরদের মিলনমেলা 
সর্বশেষ খবর
চট্টগ্রামে জব্বারের বলী খেলা ২৫ এপ্রিল থেকে
চট্টগ্রামে জব্বারের বলী খেলা ২৫ এপ্রিল থেকে
যে কারণে ১৫ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপান ছাড়তে উৎসাহী হবে
যে কারণে ১৫ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপান ছাড়তে উৎসাহী হবে
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন দিবস পালিত হলো কলকাতায়
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন দিবস পালিত হলো কলকাতায়
সরকারি চাকরির বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, বেতন স্কেল ৯৩০০-২২৪৯০ টাকা
সরকারি চাকরির বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, বেতন স্কেল ৯৩০০-২২৪৯০ টাকা
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
তৃতীয় ধাপে যেসব উপজেলায় ভোট
তৃতীয় ধাপে যেসব উপজেলায় ভোট