X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রিটেনে হেট ক্রাইম: উদ্বেগ বাড়ছে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে

মুনজের আহমদ চৌধুরী, লন্ডন
২৭ জুলাই ২০১৭, ১৩:১৯আপডেট : ২৭ জুলাই ২০১৭, ১৪:৩৮

বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কর্মী মাজ সেলিম ব্রিটেনে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের নতুন অস্ত্র হিসেবে আর্ভিভূত হয়েছে এসিড সন্ত্রাস। আর এ সন্ত্রাসের মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে মুসলিম জনগোষ্ঠী, বিশেষত ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটি। একের পর এক এসিড হামলার ঘটনায় ব্রিটেনজুড়ে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বিরাজ করছে গভীর উদ্বেগ আর চাপা উৎকণ্ঠা। সন্তানরা বাইরে বের হলে ঘরে না ফেরা অবধি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকছেন মা-বাবাসহ স্বজনরা।

বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে গত দেড় মাসে অন্তত আটটি এসিড হামলার ঘটনা ঘটেছে। বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসে সর্বশেষ মঙ্গলবার (২৫ জুলাই) রাতে দুই ব্রিটিশ বাংলাদেশি তরুণ এসিড সন্ত্রাসের শিকার হন। শুধু তাই নয়, ম্যানচেস্টার ও লন্ডনে চলতি বছর সন্ত্রাসী হামলার পর ব্রিটেনে মুসলমানদের ওপর হেট ক্রাইম বা হামলা অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেড়েছে। বাস বা ট্রেন স্টেশনে টেনে ধরা হচ্ছে মুসলিম মেয়েদের হিজাব। অনেক ঘটনায় আক্রান্তরা পুলিশে রিপোর্ট না করায় প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না পরিসংখ্যানে।

মঙ্গলবারও (২৫ ‍জুলাই) লন্ডনে ধারাবাহিক এসিড হামলার প্রতিবাদে বাঙালি কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্টদের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কাউন্সিলর মাইয়ুম মিয়ার সভাপতিত্বে সভা পরিচালনা করেন সাবিহা কামালী।

ব্রিটেনে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পরিচিত মুখ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী মাজ সেলিম। তার বাবা মোহাম্মদ সেলিমকে ২০১৬ সালে ব্রিটেনের বার্মিংহামে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীরা হত্যা করে। তিনি মঙ্গলবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এসিড হামলা নয়, এখন ব্রিটেনে যা চলছে, তা হলো এসিড সন্ত্রাস এবং এটি বর্ণবাদী হামলা।’

ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটির প্রবীণ নেতা কে এম আবু তাহির চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘গত ছয় মাসে লন্ডন ও ওয়েলসে চারশ’র বেশি এসিড হামলার ঘটনা মেট্রোপলিটন পুলিশের পরিসংখ্যানে রয়েছে। ব্রিটেনের শহরগুলোর মধ্যে নিউহাম, বার্কিং ও টাওয়ার হ্যামলেটসে এসিড হামলার ঘটনা ঘটছে সবচেয়ে বেশি। এ তিনটি শহরেই বিপুলসংখ্যক ব্রিটিশ বাংলাদেশির বাস।’ তিনি বলেন, ‘বাঙালিদের ওপর হামলার ঘটনার সবগুলো যে শুধু হেট ক্রাইম, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে এসিড ছুঁড়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তির গাড়ি, টাকা-পয়সাসহ সর্বস্ব।’

একের পর এক এমন হামলা ঘটার কারণ জানতে চাইলে তাহির চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমান ব্রিটিশ সরকার বাজেট কাটের নামে পুলিশ কমিয়েছে কয়েকগুণ। সন্ত্রাসী হামলা বেড়ে যাওয়ার এটি একটি বড় কারণ। টাওয়ার হ্যামলেটসে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাবেক মেয়র লুতফুর রহমানের আমলে ৪১ জন পুলিশ অফিসারকে কাউন্সিলের অর্থে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এখন এ সংখ্যা মাত্র ছয় জন। এত অল্পসংখ্যক পুলিশ দিয়ে এত বড় এলাকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ।’

মায়ের সঙ্গে মাজ সেলিম টাওয়ার হ্যামলেটসের বর্তমান মেয়র ও লেবার পার্টির নেতা জন বিগস বলেন, ‘আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সাধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছি।’

ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেত্রী ও সাবেক কাউন্সিলার ডা. আনোয়ারা আলী বলেন, ‘এসিড সন্ত্রাস ঠেকাতে সরকারকে তিন ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমত, এসিডের সহজলভ্যতা কমিয়ে বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে; দ্বিতীয়ত, কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং তৃতীয়ত, মানুষের মধ্যে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের ব্যবস্থা করতে হবে।’

ইউকে-বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও চ্যানেল আই ইউরোপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী সোয়েব বলেন, ‘বরিস জনসন লন্ডনের মেয়র থাকাকালে নাইফ ক্রাইমের (ছুরিকাঘাত) কথা শোনা গেলেও এসিড হামলার কথা শোনা যায়নি। সম্প্রতি এমন ঘটনা বাড়ছে। এর মধ্যে একই রাতে পাঁচ বার এসিড হামলা হয়েছে পূর্ব লন্ডনে। পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেনের বাংলা টাউনে সম্প্রতি ছুরিকাঘাত করা হয়েছে এক ব্রিটিশ বাংলাদেশিকে। অপরাধ এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পূর্ব লন্ডনের সাধারণ মানুষও এখন এসব বিষয় নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।’

পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হচ্ছে এসিড হামলার শিকার দুই তরুণের মাথার ক্ষতস্থান ফয়সল চৌধুরী আরও বলেন, ‘২০১৪ সালে লন্ডনে এসিড হামলা হয়েছিল দু’শটি। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪৩১টি। সেই হিসাবে প্রতি ২০ ঘণ্টায় একটি করে এসিড হামলা হচ্ছে। সম্প্রতি দেড় ঘণ্টার মধ্যে পাঁচবার এসিড হামলার ঘটনাও ঘটেছে। শুধু তাই নয়, এ বছরে গোটা যুক্তরাজ্যে সংঘটিত এসিড হামলার অর্ধেকেরও বেশি হয়েছে লন্ডনেই।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির উগ্র জাতীয়তাবাদের ধারা অভিবাসী কমিউনিটির ওপর দেশে দেশে নিগ্রহের প্রধান একটি কারণ। ব্রিটেনের পথে-ঘাটে, টিউব স্টেশনে এখন আশঙ্কাজনকভাবে হামলা আর বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন মুসলিমরা। হেট ক্রাইমের ঘটনাগুলো সহনশীলতার বিপরীতে গড়ে তুলছে ঘৃণার দেয়াল। চক্রান্তকারীরা ইসলামের অপব্যাখ্যা সুকৌশলে ছড়িয়ে দিয়েছে ব্রিটিশদের মধ্যে।

ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা বলছেন, যুক্তরাজ্যে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে অগ্রণী ছিলেন তাদের পূর্বসুরীরাই। লন্ডনে কৃষ্ণাঙ্গদের ব্রিকস্টন রায়টের পর এই আন্দোলনের অগ্রভাবে ছিলেন বাংলাদেশিরাই। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে শহীদ আলতাব আলীদের লড়াই আর ত্যাগের স্মারক হিসেবে গড়ে তোলা পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্ক তারই প্রমাণ।

যুক্তরাজ্য প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টি নেতা ও লেখক নুরুর রহিম নোমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হেট ক্রাইমের ঘটনায় হামলাকারী ও হামলার শিকার— উভয়ই তরুণ। এ দেশে একটা প্রোপাগান্ডা আছে— বিদেশিরা এদেশে এসে শ্বেতাঙ্গদের কাজ নিয়ে যাচ্ছে। শ্বেতাঙ্গদের কৌশলে উসকে দেওয়া  হচ্ছে। জনগণের হতাশা, সরকারি বেনিফিট সিস্টেম, অর্থনৈতিক বৈষম্য এর জন্য দায়ী। ধর্ম এখানে উপলক্ষ মাত্র। মাইনরিটি কমিউনিটির ওপর এ নির্যাতন হতাশা, হীনমন্যতা ও বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ।’

/টিআর/ এপিএইচ/

আরও পড়ুন: লন্ডনে দুই বাঙালি তরুণের ওপর এসিড হামলা

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা