X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাবিতে ছাত্র-শিক্ষক ধাক্কাধাক্কির দায় কার? (ভিডিও)

রশিদ আল রুহানী
৩১ জুলাই ২০১৭, ০০:০৭আপডেট : ৩১ জুলাই ২০১৭, ১০:২৮

সিনেট ভবন চত্বরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ধাক্কাধাক্কির একটি মুহূর্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের জন্য ডাকা সিনেটের বিশেষ অধিবেশনকে কেন্দ্র করে সিনেট ভবনের পূর্ব দিকের গেটে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনায় উভয় পক্ষই একে-অন্যকে দোষারোপ করছে। শিক্ষকরা বলছেন, বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে তাদের কর্মকাণ্ড অনিবার্য ছিল। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষকরা যৌক্তিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বাধা দিয়ে বাড়াবাড়ি করেছেন। শিক্ষার্থীদের ধাক্কাধাক্কি করাটা শিক্ষকদের জন্য ন্যাক্কারজনক। শিক্ষাবিদরাও এই ঘটনার সমালোচনা করেছেন। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
শনিবার (২৯ জুলাই) ঢাবি উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের জন্য সিনেটের ওই বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ অধ্যাদেশের ২০(১) ধারা অনুযায়ী উপাচার্য নির্বাচনে পাঁচ জন ছাত্র প্রতিনিধি থাকার বিধান থাকলেও দীর্ঘদিন ধরেই ঢাবিতে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সিনেটের ওই অধিবেশনের সময় শনিবার বিকাল ৩টায় শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে সিনেট ভবন চত্বরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এসময় প্রক্টরিয়াল বডি মিছিলে বাধা দেয়, গেটে তালাও লাগানো হয়। ভবনটির পূর্ব দিকের ভেতরের পাথ গেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির কয়েকজন শিক্ষক ও নবীন শিক্ষককেও অবস্থান করতে দেখা যায়।
বাণিজ্যিক অনুষদের দিক থেকে শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল সিনেট ভবনের গেটে আসতে দেখে দ্রুত ওই গেটে তালা লাগানো হয়। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা সেই গেটে বাধার মুখে পড়েন। ভেতরে অবস্থান করা শিক্ষকদেরকে গেট খুলে দিতে বলা হলেও গেটটি না খুললে শিক্ষার্থীরা গেটে ধাক্কাধাক্কি করেন। এক পর্যায়ে গেটটির তালা ভেঙে যায় এবং শিক্ষার্থীরা সিনেট চত্বরে ঢুকতে চেষ্টা করলে শিক্ষকরা বাধা দেন। এসময় দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়।
ধাক্কাধাক্কির ভিডিওতে দেখা যায়, গেট ভেঙে সিনেট চত্বরে প্রবেশ করার চেষ্টা করতেই দুইজন ছাত্রীসহ ছাত্রদেরকে প্রতিহত করছেন শিক্ষকরা। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়টির সহকারী প্রক্টর ও মৃৎশিল্প বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রবিউল ইসলামের সঙ্গে ওই দুই ছাত্রীসহ অন্য ছাত্রদের ধস্তাধস্তি হতে দেখা যায়। ধাক্কাধাক্কিতে অংশ নেওয়া অন্য শিক্ষকদের মধ্যে আরও ছিলেন— ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষক মিনা মাহাবুব হোসেন, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও মুহসিন হলের প্রভোস্ট নিজামুল হক ভূঁইয়া। এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) প্রভাষক কাজী ফারুক হোসাইনও ওই ধাক্কাধাক্কিতে অংশ নেন।
ভিডিওতে দেখা যায়, উভয় পক্ষের ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়ে যান দুই ছাত্রী। তাদের একজন ঢাবি শাখা ছাত্র ফ্রন্টের নেত্রী প্রগতি বর্মন তমা, অন্যজন ঢাবি শাখা ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির। ওই দুই ছাত্রীকে ধাক্কাধাক্কির থেকে বের করে আনার চেষ্টা করেন অন্য শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সহকারী প্রক্টর রবিউল ইসলাম তমাকে ধরে রাখেন, সঙ্গে অন্য ছাত্রদেরকেও ধরতে চেষ্টা করেন।
ছাত্র ফ্রন্টের নেত্রী প্রগতি বর্মন তমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষকরা প্রথমেই যে অন্যায়টা করেছেন তা হলো— তারা গেটে তালা দিয়েছেন। গেটে তালা না দিলে তো আমরা ভাঙতে চেষ্টা করতাম না। শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন করব বলেই সেখানে গিয়েছি। কিন্তু শিক্ষকরা আমাদের ওপর যেভাবে হামলা করেছেন, তা আসলেই ন্যাক্কারজনক।’
শিক্ষক-শিক্ষার্থী ধাক্কাধাক্কির ঘটনায় রেহাই পাননি শিক্ষার্থীরাও তমা আরও বলেন, ‘যেসব শিক্ষক ক্লাসে নীতি-নৈতিকতার কথা বলেন, তারাই আবার অবৈধ একটি নির্বাচনের পক্ষে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই ন্যাক্কারজনক হামলার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক সালমান সিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের অন্তত ১০ জন বন্ধু আহত হয়েছেন। ভিডিওতে দেখলেই বোঝা যাবে শিক্ষকরা আমাদের কিভাবে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন। কারও শার্ট ছিড়ে দিয়েছেন, কারও নখ ফেটে গেছে। শিক্ষকদের হামলায় সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন সহকারী প্রক্টর রবিউল ইসলাম, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষক মিনা মাহাবুব হোসেন এবং জগন্নাথের একজন শিক্ষক।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী প্রক্টর রবিউল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সিনেট ভবনের ওই গেটটা আগে থেকেই বন্ধ ছিল। অধিবেশন থাকায় অতিথিরা প্রবেশ করার পরই গেটটি বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এসে তা ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেলে। নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা তাদেরকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছি মাত্র।’
ধাক্কাধাক্কির মধ্যে দুই ছাত্রীর উপস্থিতির বিষয়ে সহকারী প্রক্টর বলেন, ‘ওই ধাক্কাধাক্কির ঘটনায় এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে আমি নিজেকে যতই সরাতে চাইছি, ততই ওই দুই ছাত্রী সামনে চলে আসছে। ওরা দু’জনই মেয়ে হওয়ায় না পারছি তাদের গায়ে হাত দিয়ে সরাতে, না পারছি অন্যদেরকে ঠেলে সরে দিতে।’
ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষক মিনা মাহাবুব হোসেনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
শিক্ষার্থী-শিক্ষক ধাক্কাধাক্কির ঘটনা প্রসঙ্গে ঢাবির ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর এস এম আমজাদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে, আমরা প্রথমে তাতে বাধা দেইনি। কারণ তারা যৌক্তিক আন্দোলন করছে। কিন্তু তারা সিনেট চত্বরে বিশৃঙ্খলা শুরু করলে সেটা তো আমরা প্রতিহত করতে বাধ্য। কারণ ভেতরে অতিথিরা ছিলেন। কিন্তু প্রতিহত করতে গিয়ে যা ঘটেছে তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন না।’
সিনেট ভবন চত্বরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ধাক্কাধাক্কি শিক্ষার্থীদেরকে কোনও শিক্ষক আঘাত করেনি, বরং নিজেদের ঘটনা থেকে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন বলে দাবি করেন ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর। শিক্ষার্থীদের দিকেই আঙুল তুলে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরাই বরং আমাদের একজন শিক্ষকের আঙুল ভেঙে দিয়েছে। এই ঘটনায় উপাচার্যের মাধ্যমে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গতকালের ঘটনা আসলেই অনাকাঙ্ক্ষিত। মিছিল নিয়ে সিনেট ভবনের গেটে ধাক্কা দিয়ে শিক্ষকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া তো ন্যাক্কারজনক। আমার ধারণা, ওই মিছিলে ছাত্রদের সঙ্গে বহিরাগতরাও ছিল। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্তের পরই আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।’
শিক্ষাবিদ ও ঢাবি অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যত দিন যাচ্ছে, ততই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। সম্পর্কটা মধুর থাকলে দুই পক্ষ এমন ঘটনায় জড়াতো না।’
দুই পক্ষেরই সমালোচনা করেন সৈয়দ মনজুরুল বলেন, ‘ঢাকসু নির্বাচন ছাড়া উপাচার্য নির্বাচন অবৈধ বলে শিক্ষার্থীরা যে দাবি করছে, সেটা যৌক্তিক। কিন্তু ২৭ বছর ধরে যে নির্বাচন হচ্ছে না, তা কি এক ঘণ্টার আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা আদায় করতে পারবে? সিনেট চত্বরে ঢোকার চেষ্টা করা ঠিক হয়নি তাদের, তারা বাইরেই আন্দোলন করতে পারত। তবে শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যে আচরণ করেছেন, সেটাও মেনে নেওয়া যায় না। এই ঘটনায় দু’পক্ষেরই অসহিঞ্চু আচরণ দেখেছি। আবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক এসে এখানে মারামারি করেছেন। এটা কেন হবে?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আক্তারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক দেশে দাবি-আন্দোলন হবেই। কিন্তু সেই আন্দোলন অবশ্যই শান্তিপূর্ণ হওয়া উচিত। কিন্তু গতকাল (শনিবার) ঢাবিতে যা হয়েছে, তা কারও কাম্য নয়। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কই আমরা সবসময় আশা করি।’

সিনেট ভবনের সামনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ধাক্কাধাক্কির ভিডিও:

আরও পড়ুন-

শনিবার সিনেটের ঘটনায় শিক্ষকদের পক্ষে ঢাবি ছাত্রলীগ

ঢাবি শিক্ষক-ছাত্রের ধাক্কাধাক্কি: তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি

ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মিছিল, শিক্ষকদের বাধা (ভিডিও)

উপচার্য প্যানেল নির্বাচন নিয়ে ঢাবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জবি শিক্ষকের হাতাহাতি! (ভিডিও)

/আরএআর/টিআর/

সম্পর্কিত
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় বেড়েছে
দারুল ইহসানের বৈধ সনদধারীদের এমপিওতে বাধা নেই
সর্বশেষ খবর
নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান রয়েছে: ডিএমপি কমিশনার
নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান রয়েছে: ডিএমপি কমিশনার
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধে জাতিসংঘের ভোটে রাশিয়ার ভেটো
মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধে জাতিসংঘের ভোটে রাশিয়ার ভেটো
তামাক কর বাস্তবায়নে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ তরুণের অকালমৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব
তামাক কর বাস্তবায়নে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ তরুণের অকালমৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না