X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গি আস্তানায় আহমেদ ইমতিয়াজ অমির ৩৭২ দিন

নুরুজ্জামান লাবু
১০ আগস্ট ২০১৭, ১০:৩১আপডেট : ১০ আগস্ট ২০১৭, ১১:০২

জঙ্গি আস্তানায় আহমেদ ইমতিয়াজ অমির ৩৭২ দিন ১ মার্চ ২০১৬। আগে থেকেই কথিত হিজরতের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছিল আহমেদ আজওয়াদ ইমতিয়াজ তালকুদার ওরফে অমিকে। নির্দেশনা অনুযায়ী ঘর ছাড়ার প্রস্তুতি নেয় রাজধানীর সানবীম স্কুলের এ-লেভেলের এই শিক্ষার্থী। তার আগে মা-বাবার উদ্দেশে একটি চিঠি লেখে সে। এরপর নিজের মোবাইল ফোনটি ভেঙে ফেলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সেই থেকে ৩৭২ দিন জঙ্গি আস্তানায় থাকার পর চলতি বছরের ৭ মার্চ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় সে।
বাসা থেকে বের হয়ে অজ্ঞাত এক নেতার নির্দেশে প্রথমে মোহাম্মদপুর যায় অমি। তখন এক ব্যক্তি তাকে কোনোদিকে না তাকিয়ে বাসে উঠতে বলে। মিরপুরের শাহ আলী মার্কেটের সামনে নামে তারা। সেখানে আরেক ব্যক্তির সঙ্গে রিকশায় ওঠে সে। আশেপাশের সড়ক যাতে চিনতে না পারে সেজন্য তার চোখে পড়ানো হয় বিশেষ একটি চশমা। তারপর তারা গিয়ে দাঁড়ায় একটি বাসার সামনে। ভেতরে গিয়ে অমি দেখে সমবয়সী আরও ৫-৬ জনকে। তাকে বলা হয়, নিজের ব্যক্তিগত তথ্য কারও সঙ্গে শেয়ার না করতে। নিজেও যেন কারও সম্পর্কে জানতে না চায়। এরপর তার নতুন নাম দেওয়া হয় ‘হায়দার’।
জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ঘর ছাড়া অমি ৩৭২ দিন পর চলতি বছরের ৭ মার্চ কুমিল্লার চান্দিনা এলাকার একটি বাস থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। এরপর তাকে অন্তত ছয়টি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। জিজ্ঞাসাবাদে সিটিটিসি কর্মকর্তাদের কাছে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় থাকার কথা সবিস্তারে জানিয়েছে অমি।
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার পুরো কাহিনি বলেছে অমি। তার কাছ থেকে জঙ্গিদের মোটিভেশন প্রক্রিয়ার একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে।’

জঙ্গি আস্তানায় আহমেদ ইমতিয়াজ অমির ৩৭২ দিন বাবা-মাকে ‘শিক্ষা’ দিতে ঘর ছাড়ে অমি


অমি জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান সে। তার জন্ম ১৯৯৮ সালের ৬ জানুয়ারি। বাবা মেজর কবির আহমেদ তালুকদার। মায়ের নাম ইয়াসমিন হোসেন। ছোটবেলা থেকেই মা-বাবার যথাযথ মনোযোগ না পাওয়ার অভিযোগ করেছে সে।  তার দাবি, বাবা-মা সারাক্ষণ ঝগড়া করতেন। একপর্যায়ে তারা আলাদা থাকা শুরু করেন। বাবা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আর মা থাকতেন গুলশানে। অমি কখনও মায়ের সঙ্গে, আবার কখনও বাবার সঙ্গে থাকতো। মা-বাবার খিটখিটে মেজাজের কারণে একা হয়ে পড়ে সে। সিটিটিসি সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে এসব তথ্য দিয়েছে। 
জিজ্ঞাসাবাদে অমি আরও জানায়, জঙ্গিবাদে তার জড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো, বাবা-মায়ের মনোযোগ না পাওয়া। তার ভাষ্য, মা-বাবাকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য সে ঘর ছাড়ে। কিন্তু জঙ্গি আস্তানায় গিয়ে বুঝতে বাকি থাকে না, এখান থেকে ফেরার কোনও পথ নেই। কারণ ফিরলেই পুলিশ তাকে ধরবে। এজন্যই আর ফেরা হয়নি তার। তবে বোমা বহন করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে। 

যেভাবে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে অমি 

২০১৪ সালের শেষের দিকের ঘটনা। অমি তখন বাবার সঙ্গে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় থাকতো। সেখানকার একটি মসজিদে নামাজ পড়ার পর এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। সেই তরুণ হলো ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান জিলানী। তার হাত ধরেই মূলত জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে অমি। পরবর্তীতে আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে সিরিয়া গিয়ে নিহত হয় জিলানী।

অমির ভাষায়, জিলানীকে তার খুব ভালো লাগে। বাবাকে এ কথা জানিয়ে ওই তরুণকে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে নেয় সে। টিউশনির ফাঁকে ফাঁকে ইরাক-সিরিয়া-আফগানিস্তানে মুসলিমদের ওপর অত্যাচারের নানা বিষয় তুলে ধরে ‘ব্রেনওয়াশ’ করতো। এভাবে একপর্যায়ে অমিকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে ফেলে সে। ২০১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় চলে যায় জিলানী। এরপরও তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল অমির।
জিজ্ঞাসাবাদে অমি জানায়, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বা ২০১৬ সালের শুরুর দিকে একদিন সন্ধ্যা ৬টায় ধানমন্ডি লেকে একজনের সঙ্গে দেখা করতে বলা হয় তাকে। নির্ধারিত সময়ে টি-শার্ট, প্যান্ট ও জ্যাকেট পরা সমবয়সী এক তরুণ আসে। ধানমন্ডি লেকে বসে কথা বলে তারা। অমিকে জানানো হয়, মাসখানেক পর তাকে জানানো হবে সে হিজরত করার জন্য উপযোগী কিনা। পরবর্তীতে ওই তরুণের নির্দেশনা মতোই ২০১৬ সালের ১ মার্চ ঘর ছাড়ে সে। গোয়েন্দাদের ধারণা, অজ্ঞাত সেই তরুণ হলো নব্য জেএমবি’র রাশেদ ওরফে র‌্যাশ।

বিভিন্ন আস্তানায় ৩৭২ দিন

জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ৩৭২ দিন দেশের বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকটি আস্তানায় ছিল আহমেদ ইমতিয়াজ অমি। ঘর ছাড়ার পর প্রথমে মিরপুরের আস্তানায় আক্বীদা ও মানহাজ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাকে। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে আইএসের বিভিন্ন প্রচারপত্র বাংলায় অনুবাদ করার দায়িত্ব পায় সে। তখন ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী নাফিজ নামে এক তরুণের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এ দু’জনকে পাঠানো হয় পাবনায়। সেখানে আলম নামে এক তরুণও তাদের সঙ্গে থাকতো। শীর্ষনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতো নাফিজ।
গোয়েন্দাদের অমি জানায়, পাবনায় মাসখানেক থাকার পর আস্তানা থেকে পালিয়ে যায় আলম। এরপর নিরাপত্তার কথা ভেবে শীর্ষনেতাদের নির্দেশে ওই আস্তানা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে অমি ও নাফিজ। মিরপুরের আরেকটি জঙ্গি আস্তানায় ওঠে তারা। সেখানে আকাশ নামে এক জঙ্গিস্ত্রীসহ থাকতো।

গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া দুই জঙ্গি রোহান ও নিবরাস তাদের আস্তানায় গিয়েছিল বলে জানায় অমি। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তাদের পাঠানো হয় সিলেটের সুবিদবাজারে। সেখানে বসেই তারা জানতে পারে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার খবর। সিলেট যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জে তামিম চৌধুরীর আস্তানায় গিয়েও কয়েকদিন থাকে সে।
জঙ্গি আস্তানায় আহমেদ ইমতিয়াজ অমির ৩৭২ দিন অমি জানায়, সিলেটের আস্তানায় মাহবুব নামে এক ব্যক্তি তাদের সঙ্গে থাকতো। মাহবুব একদিন তাকে ১৫ হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোন দিয়ে পুরো সিলেট ঘুরে দেখতে বলে। এ সময় সে ডাকবিভাগের মাধ্যমে বাড়িতে একটি চিঠিও পাঠিয়েছিল। তবে নিজের ঠিকানা দেয়নি। ওই চিঠিতে সে বাড়ি ফেরার ইচ্ছার কথা জানায়। তবে তার ভয় ছিল, বাড়ি ফিরে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করতে পারে।
সিলেটে থাকার সময় জঙ্গিদের ওপর সুনির্দিষ্ট কোনও নির্দেশনা ছিল না বলেও জানায় অমি। একদিন সিলেট আস্তানার দায়িত্বশীল মাহবুব ও রাশেদ কোথাও বৈঠক করতে যায়। সেখান থেকে ফিরে তারা অমিকে চট্টগ্রামে চলে যেতে বলে। এরপর পটিয়ার একটি আস্তানায় গিয়ে ওঠে সে। সেখান থেকে নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় বোমা পৌঁছে দেওয়া ছিল তার কাজ। পটিয়ায় কিছুদিন থাকার পর তাদের আস্তানা পাল্টাতে বলা হয়। তারপর তারা গিয়ে ওঠে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে। সেখান থেকে দায়িত্বশীল ফরহাদের নির্দেশনায় সহযোগী হাসানসহ ঢাকায় বোমা নিয়ে যাওয়ার পথে কুমিল্লার চান্দিনায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে।

বেশকিছু জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এমন একজন কর্মকর্তা কথা বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে। তার মতে, ‘অমি খুব বুদ্ধিমান। তার মস্তিষ্ক খুব তীক্ষ্ণ। যে কোনও বিষয় অল্পতেই বুঝতে পারে সে। এ কারণেই নব্য জেএমবি’র শীর্ষনেতারা কোনও অপারেশনে না পাঠিয়ে তাকে দিয়ে বিভিন্ন কাজ করাতো। ধরা না পড়লে এই অমিই হয়তো একসময় হয়ে যেত নব্য জেএমবি’র শীর্ষনেতা।’


/এনএল/এপিএইচ/জেএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী